তাঁকে যে খুনের চেষ্টা চলছে, স্বপন মণ্ডল অনেক আগেই তার আন্দাজ পেয়েছিলেন। আর তাই খুন হওয়ার প্রায় চল্লিশ দিন আগে নিজের আশঙ্কার কথা জানিয়ে কেষ্টপুরের ওই তৃণমূল নেতা খোদ মুখ্যমন্ত্রীকে একটি চিঠি পাঠিয়েছিলেন বলে তাঁর পরিবারের দাবি।
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে লেখা স্বপনের সেই চিঠির প্রতিলিপি বৃহস্পতিবার আনন্দবাজারের হাতে এসেছে। গত ১৯ অক্টোবর লেখা চিঠিটির প্রতিলিপি পাঠানো হয়েছিল স্থানীয় বিধায়ক-মন্ত্রী পূর্ণেন্দু বসু, সাংসদ সৌগত রায়, তৃণমূলের উত্তর ২৪ পরগনা জেলা পর্যবেক্ষক জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক, দলের জেলা সভাপতি নির্মল ঘোষ এবং কার্যকরী সভাপতি রথীন্দ্রনাথ ঘোষকেও। দেখা যাচ্ছে, স্বপন-হত্যায় অন্যতম প্রধান অভিযুক্ত হিসেবে টুলকো নামে যে দুষ্কৃতীকে পুলিশ বুধবার ডানকুনিতে গ্রেফতার করেছে, স্বপন নিজেই তার নাম চিঠিতে জানিয়ে দিয়েছিলেন। জানিয়েছিলেন টুলকোর পিছনে থাকা ‘ষড়যন্ত্রকারীদের’ নামও।
টুলকোকে জেরা করার পরে পুলিশও সেই চক্রান্তকারীদের এক জনকে (সত্য বৈদ্য) খুঁজছে। অন্য দিকে স্বপন হত্যায় জড়িত অভিযোগে ধৃত টুলকো ওরফে বিশ্বজিৎ দাস এবং রাধাকান্ত ঘোষকে এ দিন বারাসত আদালতে তোলা হলে আদালত তাদের পাঁচ দিন পুলিশি হেফাজতে রাখার নির্দেশ দিয়েছে।
স্বপন মুখ্যমন্ত্রীকে কী জানাতে চেয়েছিলেন?
স্বপন চিঠিতে লিখেছিলেন, “গত ১১ ফেব্রুয়ারি, ২০১১ যে সমস্ত সিপিএম মদতপুষ্ট হার্মাদ আমাকে ৪টি গুলি করে মেরে ফেলার চক্রান্ত করেছিল, যার ফলে আমার জীবন সংশয় হয়েছিল...। কিন্তু আজ অতিশয় দুঃখের সঙ্গে জানাচ্ছি যে, দল ক্ষমতা লাভের পর আমাদের রাজারহাট-গোপালপুর পৌরসভার অন্তর্গত কৃষ্ণপুর এলাকায় ৩৩ নং ওয়ার্ডে সেই সকল হার্মাদ (সত্য বৈদ্য, ননী বৈদ্য, টুলকো দাস প্রমুখ) এসইউসিআই মদতপুষ্ট ও কতিপয় আমাদের দলের সদস্য দ্বারা গঠিত নাগরিক কমিটির আশ্রয় ও প্রশ্রয়ে এলাকায় সন্ত্রাস কায়েম করেছে। যার ফলে আমি ভীষণ ভাবে শঙ্কিত ও নিরাপত্তার অভাব বোধ করছি।” |
বারাসত আদালতে তোলা হচ্ছে ধৃতদের। ছবি: সুদীপ ঘোষ |
বিষয়টি যাতে গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করা হয়, চিঠিতে সেই আর্জি জানান স্বপন। যদিও মুখ্যমন্ত্রীর বাড়িতে আসা চিঠিপত্র তদারকির ভার যাঁদের, তাঁদের দাবি,“এমন চিঠি পেলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হতো। মুখ্যমন্ত্রীকে পাঠানো শুভেচ্ছাপত্রেরও চটজলদি জবাব দেওয়া হয়।”
মুখ্যমন্ত্রীকে লেখা চিঠির প্রতিলিপি যাঁদের পাঠানো হয়েছিল, তৃণমূলের সেই নেতারা কী বলছেন?
স্থানীয় সাংসদ সৌগত রায় এ দিন বলেন, “আমি এমন কোনও চিঠি পাইনি। স্বপনের জীবন যে বিপন্ন, তা আমার জানা ছিল না। প্রথম বার যখন স্বপন গুলি খায়, তখন ওকে হাসপাতালে ভর্তি করাতে আমি সাহায্য করেছিলাম।” তৃণমূলের জেলা সভাপতি নির্মলবাবু জানাচ্ছেন, “আমি চিঠিটা পেয়েছি ওঁর মৃত্যুর পরের দিন। যে দিন স্বপনের দেহ ময়না-তদন্তের জন্য মর্গে আনা হল। আমি সেখানে গিয়েছিলাম। তখন এক দলীয় কর্মী আমাকে চিঠিটা দেন। তার আগে আমি জানতাম না, ওঁর জীবন বিপন্ন।” পূর্ণেন্দুবাবুর সঙ্গে এ ব্যাপারে বার বার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি।
তবে নেতারা না-জানলেও স্বপনের আশঙ্কা যে ‘সত্যি’ ছিল, টুলকোকে জেরা করে পুলিশ সে ব্যাপারে মোটামুটি নিশ্চিত। পুলিশ-সূত্রের খবর: জেরায় টুলকো যে সব তথ্য জানিয়েছে, তা হল: · স্বপনকে খুনের ছক কষেছিল সত্য ও শঙ্কর নামে স্থানীয় দুই দুষ্কৃতী। ওরা আগে ছিল সিপিএমের আশ্রয়ে। রাজ্যে রাজনৈতিক পালাবদলের সঙ্গে সঙ্গে তৃণমূলে যোগ দেয়।
• সত্যের একটা চোলাইয়ের ঠেক রয়েছে। টুলকো সেখানে কাজ করে।
• ১৯৯৭ থেকে ২০০৩ পর্যন্ত স্বপন রাজারহাট-নিউটাউন-বাগুইআটি-কেষ্টপুরে ‘সিন্ডিকেট’-এর অধীনে কাজ করতেন। তখন তিনি ছিলেন কংগ্রেসের ছত্রচ্ছায়ায়। তাঁর নামেও খুন-ডাকাতি-তোলাবাজির একাধিক অভিযোগ আছে পুলিশের খাতায়। ২০০৩-এ শঙ্কর-সত্য জুটি তাঁকে এলাকাছাড়া করে।
• স্বপন যাওয়ার পরে তোলাবাজির বখরা নিয়ে সত্য ও শঙ্করের মধ্যেও কাজিয়া লাগে। ২০০৯-এ সংঘর্ষে জড়িয়ে দু’জনেই জেলে যায়।
• সত্য-শঙ্করের অনুপস্থিতিতে স্বপন ফিরে এসে ধীরে ধীরে এলাকার ‘দখল’ নেন। তখন তিনি কংগ্রেস ছেড়ে তৃণমূলে।
• ২০১১-র গোড়ায় সত্য ও শঙ্কর জেল থেকে বেরোয়। স্বপনকে সরাতে আবার দু’জনে হাত মেলায়।
• স্বপনকে নিকেশ করতে শঙ্কর কাজে লাগায় দুই শাগরেদকে কৃষ্ণ ও বাপি। সত্যের তরফে দায়িত্ব নেয় টুলকো। বাইরের তিনটি ছেলেকেও ‘টিমে’ নেওয়া হয়, যাদের তারা চেনে না বলে টুলকো জানিয়েছে। টুলকোর দাবি, হামলার সময়ে ওরাও স্বপনকে লক্ষ্য করে বার কয়েক গুলি চালিয়েছিল।
• খুনের হাতিয়ার জোগাড়ের ভার ছিল রাধাকান্তের উপরে। সে ঝাড়খণ্ড থেকে আগ্নেয়াস্ত্র এনে স্থানীয় দুষ্কৃতীদের সরবরাহ করত। রাধাকান্ত পাঁচ হাজার টাকায় চারটে পিস্তল আর কুড়িটা কার্তুজ দিয়েছিল টুলকোদের।
• গত রবিবার স্বপনকে কেষ্টপুর মোড়ে সাগরের চায়ের দোকানে বসে থাকতে দেখে কৃষ্ণ ফোন করে শঙ্করকে। শঙ্কর খবরটা সত্যকে দেয়। বার্তা পৌঁছায় টুলকোর কাছে। সে তখন ছিল পাচুরিয়ায়। সেখান থেকে মোটরবাইক নিয়ে বাগুইআটি আসে। তার পরে বাপিকে মোটরবাইকে তুলে কেষ্টপুর মোড়ে, চায়ের দোকানের সামনে।
• অবশেষে ‘অ্যাকশন।’ স্বপনকে দু’বার গুলি করে টুলকো।
• গুলি চালানোর পরে টুলকো হেঁটে গিয়েছিল ভিআইপি রোডে। সেখানে ট্যাক্সি ধরে লেকটাউনের দিকে চলে যায়। কৃষ্ণ ও বাপি মোটরসাইকেলে চেপে গা ঢাকা দেয়। অন্য তিনটে ছেলে কী ভাবে পালিয়েছে, টুলকো সে সম্পর্কে অন্ধকারে বলে পুলিশকে জানিয়েছে। · ভিআইপি রোডে উঠেই কৃষ্ণকে ফোন করেছিল টুলকো। কৃষ্ণ তাকে বলে, উল্টোডাঙা ব্রিজের কাছে পৌঁছে ট্যাক্সি ছেড়ে দাঁড়িয়ে থাকতে। সে তা-ই করে। কিছুক্ষণ পরে কৃষ্ণ আসে। টুলকোর বক্তব্য, কৃষ্ণ তার হাতে তিনশো টাকা ধরিয়ে দেয়। তা নিয়ে সে চলে যায় ডানকুনিতে।
টুলকো পুলিশের জালে পড়ল কী ভাবে?
পুলিশ জানিয়েছে, ডানকুনির এক দুষ্কৃতীর মাধ্যমে টুলকোর গতিবিধির হদিস মিলেছিল। তাকে টোপ দিয়ে ওখানকার এক ধাবায় আনা হয়। সেখানেই তদন্তকারীরা তাকে পাকড়াও করেন। |