খুচরো ব্যবসায় বিদেশি লগ্নির বিরোধিতা করতে গিয়ে সিপিএম দেশি পুঁজিপতিদের বিরোধিতা করতে ভুলে গিয়েছে বলে প্রশ্ন উঠেছে বামপন্থী মহলেই। অন্য বাম দলের নেতাদের বক্তব্য, ‘সিপিএমের অবস্থান দেখে মনে হচ্ছে ওয়ালমার্ট বা টেসকো-রা এলেই কৃষকদের ঠকিয়ে মুনাফা করবে। আর এ দেশের পুঁজিপতিরা সকলে জনকল্যাণে খুচরো ব্যবসায় নেমেছেন।’ কংগ্রেসের তরফে একে সিপিএমের ‘দ্বিচারিতা’ বলেও প্রচার করা হচ্ছে।
বস্তুত দেশের বড় ব্যবসায়ী সংস্থাগুলি অনেক দিন আগে বহু ব্র্যান্ডের খুচরো ব্যবসায় নেমেছে। বামফ্রন্টের আমলেও পশ্চিমবঙ্গে বহু ব্র্যান্ডের খুচরো ব্যবসার জন্য বহু ‘ডিপার্টমেন্টাল স্টোর’ খোলার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। সেখানেও কৃষকদের থেকে কেনা শাকসব্জি বিক্রি হচ্ছে। সিপিএম বলছে খুচরো ব্যবসায় বিদেশি লগ্নি এলে কৃষকরা ফসলের জন্য বেশি দাম পাবেন এবং ক্রেতারা সস্তায় কিনতে পারবেন, এই যুক্তি ভুল। বিদেশি লগ্নি এলে খুচরো ব্যবসায়ী সংস্থাগুলি কৃষকদের ‘ক্রীতদাসে’ পরিণত করে কম দামে ফসল বিক্রি করতে বাধ্য করবে। সংগঠিত খুচরো ব্যবসার চাপে ছোট মুদির দোকান উঠে যাবে।
কংগ্রেসের তরফে পাল্টা যুক্তি এ দেশের রিল্যায়্যান্স, ভারতী, বিগ বাজার, স্পেনসার্সের মতো বহু সংস্থা খুচরো ব্যবসায় নেমেছে। তারা লাভের অঙ্ক মাথায় রেখেই ব্যবসা করে। সিপিএমের অভিযোগ সত্যি হলে সেগুলো ওই সব সংস্থার ক্ষেত্রেও সত্যি। তা হলে সিপিএম দেশীয় সংস্থাগুলির খুচরো ব্যবসার বিরোধিতা করছে না কেন? প্রশ্ন তুলছেন কংগ্রেস নেতারা। দলীয় মুখপত্র ‘পিপল্স ডেমোক্র্যাসি’-র আগামী সংখ্যার সম্পাদকীয়তে পলিটব্যুরো সদস্য সীতারাম ইয়েচুরির যুক্তি, “বহুজাতিক সংস্থাকে প্রবেশাধিকার দেওয়ার সিদ্ধান্ত কোটি কোটি মানুষকে দারিদ্রের দিকে ঠেলে দেবে।” কিন্তু দেশীয় সংস্থাগুলিকে নিয়ে তিনি নীরব। কেন? ইয়েচুরির বক্তব্য, “ওঁরা আইনি অনুমতি নিয়েই ব্যবসা করছেন। তার বিরোধিতা করা কী ভাবে সম্ভব!” এ বিষয়ে সিপিআই-এর মতো শরিক দলের অবস্থান সিপিএমের বিপরীত। সিপিআইয়ের মত হল, দেশি বা বিদেশি, কোনও বড় সংস্থাই খুচরো ব্যবসায় নামলে কৃষকের লাভ হয় না। কৃষকরা যে তিমিরে, সেই তিমিরেই থাকে। দলের নেতা গুরুদাস দাশগুপ্তের বক্তব্য, “আমরা ভিন্ন দল। তাই আমাদের মধ্যে মতপার্থক্য থাকতেই পারে। আমরা মনে করি, কৃষকরা যদি নিজেদের মধ্যে সমবায় করে সরাসরি বিক্রি করতে পারে, তা হলে ক্রেতা-বিক্রেতা দু’পক্ষই লাভবান হয়। সেখানে সরকার সহজে ঋণ, গুদাম বা হিমঘরের ব্যবস্থা করে সুরাহা দিতে পারে।”
সিপিএমের নেতারা অবশ্য বলছেন দেশীয় সংস্থাগুলির খুচরো ব্যবসার ক্ষেত্রেও সিপিএম চায়, রাশ সরকারের হাতে থাকুক। প্রথম ইউপিএ সরকারের জমানাতেই বিষয়টি স্পষ্ট করে দেওয়া হয়। সিপিএম চায়, কেন্দ্র বড় খুচরো ব্যবসায়ী সংস্থাগুলির উপরে নিয়ন্ত্রণ রাখতে জাতীয় নীতি প্রণয়ন করুক। সেখানে খুচরো ব্যবসায় লাইসেন্স দেওয়ায় কড়াকড়ি থাকুক। একটি শহরে সর্বাধিক ক’টি বিক্রয়কেন্দ্র হবে, তার সর্বোচ্চ সীমা বেঁধে দেওয়া হোক। রিল্যায়্যান্সের মতো সংস্থাকে কখনওই পাড়ায় পাড়ায় ছোট দোকান খুলতে দেওয়া যাবে না। কোনও সংস্থা যাতে একচ্ছত্র আধিপত্য তৈরি করতে না পারে, তারও কড়া নিয়ম হোক।
কংগ্রেসের নেতারা বলছেন, সিপিএম নেতৃত্ব আসলে রাশ টেনে সংগঠিত খুচরো ব্যবসার পক্ষেই মত দিচ্ছেন। মার্কিন বিরোধিতায় অন্ধ সিপিএমের আপত্তি পুঁজির রং নিয়ে, বড় পুঁজি নিয়ে নয়। তাঁরা যে রাশ টানার কথা বলছেন, সেই অধিকার মনমোহন সরকার রাজ্যকে দিয়েই দিয়েছে। খুচরো ব্যবসায় বিদেশি বিনিয়োগের পক্ষে প্রচারে নেমে কংগ্রেস সিপিএমের এই অবস্থানকেই ‘চ্যালেঞ্জ’ জানাতে চাইছে। |