মাওবাদীদের সঙ্গে শান্তি-প্রক্রিয়া ছেড়ে সরে দাঁড়ালেন সরকার-নিযুক্ত মধ্যস্থদের অধিকাংশ। সোমবার নিজেদের মধ্যে এক বৈঠকের পর মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে চিঠি পাঠিয়ে ছ’জন মধ্যস্থতাকারীর মধ্যে সুজাত ভদ্র, ছোটন দাস-সহ পাঁচ জনই ওই দায়িত্ব থেকে ‘অব্যাহতি’ নিয়েছেন। ষষ্ঠ জন, দেবাশিস ভট্টাচার্য ওই দায়িত্ব ছাড়েননি। দেবাশিসবাবু তাঁদের সঙ্গে ‘ভিন্নমত’ বলে বাকিরাই জানিয়েছেন।
তবে প্রশাসনের কাছে মধ্যস্থদের এ দিনের সিদ্ধান্ত ‘প্রত্যাশিত’ই ছিল। বিশেষত, মাওবাদী শীর্ষনেতা কিষেণজি যৌথ বাহিনীর সঙ্গে গুলির লড়াইয়ে নিহত হওয়ার পর। বস্তুত, প্রশাসনের একাংশ মনে করছে, কিষেণজির মৃত্যুর ফলে মধ্যস্থরা সরে যাওয়ার একটা ‘সম্মানজনক’ রাস্তা পেলেন। মাওবাদীরা তাঁদের উপর ‘অনাস্থা’র কথা খোলাখুলিই জানিয়েছিল।
তবে সরকারের তরফে এ নিয়ে প্রকাশ্যে কোনও মন্তব্য করা হয়নি। মন্তব্য করতে চাননি মুখ্যমন্ত্রী মমতাও। এর পর অন্য মধ্যস্থ নিয়ে শান্তি-প্রক্রিয়া আবার নতুন করে শুরু হবে কিনা বা আদৌ আর শান্তি-প্রক্রিয়ায় সরকার আগ্রহী কিনা, তা-ও এ দিন জানা যায়নি। এর আগেও এক বার সুজাতবাবুরা চিঠি দিয়ে ওই দায়িত্ব থেকে ‘অব্যাহতি’ চেয়েছিলেন। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রীই তাঁদের আলোচনা চালিয়ে যেতে অনুরোধ করেন। তার পরেই কিষেণজির নিহত হওয়ার ঘটনা এবং ‘অক্ষমতা ও অসহায়তা’ জানিয়ে সুজাতবাবুদের এ দিনের চিঠি।
সুজাতবাবুরা বুধ বা বৃহস্পতিবার ‘নথিপত্র’ পেশ করে জানাবেন, কেন তাঁরা সরে আসতে ‘বাধ্য’ হলেন। যে যুক্তির সঙ্গে ‘সহমত’ নন দেবাশিসবাবু। তবে এ দিনের বৈঠকে তিনি ছিলেন না। ছোটনবাবু জানান, দেবাশিসবাবু শহরের বাইরে ছিলেন। সুজাতবাবুর কথায়, “দেবাশিসবাবু মনে করেন, এর পরেও আলোচনার প্রক্রিয়া চালানোর চেষ্টা করা যেত।” কমিটির সদস্যদের একাংশের মতে, দেবাশিসবাবু মুখ্যমন্ত্রীর সচিবালয়ে একটি ‘গুরুত্বপূর্ণ’ দায়িত্বে রয়েছেন। ফলে তাঁর পক্ষে সরকারের ঘোষিত নীতি (আলোচনা চালিয়ে যাওয়া) থেকে সরে আসা সম্ভব নয়।
সুজাতবাবুদের সিদ্ধান্তের কথা জেনে মাওবাদীদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষাকারী এক নেতা বলেন, “কিষেণজির মৃত্যুর পরে ওঁদের সরে যাওয়া ছাড়া উপায় ছিল না। মধ্যস্থ হিসাবে সরকার তাঁদের নিয়োগ করেছিল। আমরা প্রথম থেকেই তাঁদের ভূমিকায় সন্দেহ প্রকাশ করেও আলোচনা করছিলাম। কিন্তু কিষেণজির মতো শীর্ষনেতার মৃত্যুর পর আর আলোচনা প্রক্রিয়ায় আমরা বিশ্বাস করছি না। ভবিষ্যতে আলোচনার পরিস্থিতি তৈরি হলে কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠকে সিদ্ধান্ত হবে।”
সুজাতবাবু-সহ পাঁচ মধ্যস্থতাকারীর ‘অব্যাহতি’ নেওয়ার কারণ মূলত তিনটি।
প্রথমত, কিষেণজির মৃত্যুর পরে মাওবাদীরা মধ্যস্থদের কাছে অভিযোগ করেছে যে, তাঁকে আলোচনায় ডেকে হত্যা করা হয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে, কারা তাঁকে আলোচনায় ডেকেছিল? এ ক্ষেত্রে ইঙ্গিত মধ্যস্থদের দিকেই।
দ্বিতীয়ত, সুজাতবাবু এবং ছোটনবাবু মধ্যস্থতাকারী কমিটির সদস্য হলেও একই সঙ্গে মানবাধিকার কর্মীও বটে। সুজাতবাবু গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষা সমিতির (এপিডিআর) রাজ্য
সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য এবং ছোটনবাবু বন্দি মুক্তি কমিটির নেতা। কিষেণজির মৃত্যুর পরে ওই সংগঠনগুলির তরফে দু’জনের উপর প্রবল ‘চাপ’ তৈরি হয়েছে। ওই দুই সংগঠনই মনে করে, কিষেণজিকে অন্যায় ভাবে ‘হত্যা’ করা হয়েছে। তাঁর মৃত্যুর তদন্তও দাবি করেছে ওই দুই সংগঠন।
তৃতীয়ত, মাওবাদীরাই জানিয়েছে, কিষেণজির মৃত্যুর পরে তারা সারা দেশেই আর কোনও শান্তি আলোচনায় যাবে না।
ফলে সুজাত-ছোটন, যাঁদের সঙ্গে মূলত মাওবাদী নেতা আকাশের শান্তি আলোচনা চলছিল, তাঁরা মনে করছেন, মধ্যস্থ হিসেবে তাঁদের আর কোনও ‘ভূমিকা’ থাকছে না। কমিটির বাকি তিন জন নদী বিশেষজ্ঞ কল্যাণ রুদ্র, অধ্যাপক অশোকেন্দু সেনগুপ্ত ও কবি প্রসূন ভৌমিক সরাসরি মাওবাদীদের সঙ্গে শান্তি আলোচনায় অংশ নেননি। তাঁরা মানবাধিকার কর্মীও নন। তাঁদের অভিমত, সুজাত-ছোটন মধ্যস্থতা না-করলে তাঁদেরও দায়িত্বে থাকা অর্থহীন। কল্যাণবাবু আগেই কমিটি থেকে বেরিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। মুখ্যমন্ত্রীর অনুরোধে তিনি থেকে যান।
তবে মধ্যস্থদের মধ্যে সামনের সারিতে-থাকা ওই দু’জনের কিন্তু সরকারের বিরুদ্ধে ‘গুরুতর অভিযোগ’ রয়েছে। তাঁরা মনে করেন, কিষেণজিকে ‘খুন করা’ হয়েছে। ওই ঘটনার বিচারবিভাগীয় তদন্ত হওয়া উচিত। ঘটনাচক্রে, সল্টলেকের একটি সংগঠন ‘ফ্রেন্ডস অফ ডেমোক্র্যাসি’ও এ দিন বিবৃতি দিয়ে ওই একই দাবি জানিয়েছে। ঘটনাচক্রে, ওই দুই মধ্যস্থ সেই সংগঠনের সদস্য। সুজাত-ছোটনের আরও অভিমত, জঙ্গলমহলে যৌথ বাহিনীর অভিযান এবং মাওবাদীদের সঙ্গে সরকারের শান্তি আলোচনা একসঙ্গে চলতে পারে না। সরকারের যৌথ বাহিনী প্রত্যাহার করা উচিত ও সমস্ত রাজনৈতিক বন্দিকে নিঃশর্তে মুক্তি দেওয়া উচিত। তবেই শান্তি আলোচনার পথ খোলা থাকে। নচেৎ নয়।
সরকার-নিযুক্ত মধ্যস্থ হিসেবে সেই অবস্থান সুজাত-ছোটনবাবু প্রকাশ্যে জানাতে না-পারায় তাঁরা
ওই সংগঠনের মঞ্চ ব্যবহার করে ওই দাবিগুলি তুলেছেন। কিষেণজির মৃত্যুর দিনই ওই দু’জন যৌথ বাহিনীর বিরুদ্ধে ৩০২ ধারায় খুনের মামলা করার দাবি তুলেছিলেন।
কিষেণজির মৃত্যু সংঘষের্র্ না ‘ভুয়ো’ সংঘর্ষে, তা নিয়ে মানবাধিকার সংগঠনগুলি বিতর্ক জারি রেখেছে। এই পরিস্থিতিতে মুখ্যমন্ত্রী মমতা ‘পাশে’ পেয়েছেন জেল-বন্দি সিপিএম বিধায়ক তথা রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী সুশান্ত ঘোষকে। দাসেরবাঁধ কঙ্কাল-কাণ্ডে অভিযুক্ত সুশান্তবাবু এখন জেলে। এ দিন মেদিনীপুর আদালতে হাজিরা দিতে-আসা সুশান্তবাবুকে কিষেণজির মৃত্যু নিয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি সরাসরি কোনও জবাব দেননি। তাঁর বক্তব্য, “বাইরের জগতের সঙ্গে আমার সম্পর্ক নেই। কাগজে পড়ে জেনেছি। তাই এ নিয়ে মন্তব্য করব না। তবে যৌথ বাহিনীর কাজকে সমর্থন করি।” এক সময়ে যৌথ বাহিনীর পাশাপাশি সিপিএম-ও দলগত ভাবে জঙ্গলমহলে মাওবাদীদের বিরুদ্ধে যে ‘প্রতিরোধ অভিযান’ শুরু করেছিল, তাতে সুশান্তবাবুর ‘গুরুত্বপূর্ণ’ ভূমিকা ছিল। সুশান্তবাবু এবং তাঁর ‘ঘনিষ্ঠ’ পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা সিপিএম সম্পাদক দীপক সরকার বরাবরই যৌথ বাহিনীর অভিযান ও তার সঙ্গে ধারাবাহিক রাজনৈতিক কর্মসূচির দ্বিমুখী কৌশলে মাওবাদী মোকাবিলার কথা বলে এসেছেন। সে দিক দিয়ে সুশান্তবাবুর এ দিনের বক্তব্য ‘অভাবিত’ নয় বলেই মত জেলায় তাঁর দলীয় সহকর্মীদের।
প্রসঙ্গত, কিষেণজি নিহত হওয়ার প্রতিবাদে আজ, মঙ্গলবার ঝাড়খণ্ড বন্ধের ডাক দিয়েছে মাওবাদীরা। আগামী ৪ এবং ৫ ডিসেম্বর ভারত বন্ধেরও ডাক দিয়েছে তারা। রাজ্য পুলিশের পদস্থ আধিকারিকেরা বন্ধের প্রেক্ষিতে সমস্ত ‘সতর্কতামূলক’ ব্যবস্থা নিয়েছেন। |