পাকিস্তান-আফগান সীমান্তে ন্যাটোর বিমানহানায় ২৪ জন পাক সেনার মৃত্যু পাক-মার্কিন দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে নূতন উত্তেজনা সৃষ্টি করিয়াছে। প্রকৃত ঘটনা কী, ন্যাটোর বাহিনী উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে ঘাঁটি গাড়িয়া থাকা আফগান তালিবানদের লক্ষ্যবস্তু করিয়াছিল কি না, তাহাদের রক্ষা করিতে পাক সেনারাই প্রথম আক্রমণাত্মক গুলিবর্ষণ করিয়াছিল কি না, আফগান তালিবান নাকি পাক তালিবান কাহাদের ধ্বংস করিতে ন্যাটোর এই হামলা ইত্যাদি প্রশ্নগুলির মীমাংসা সহসা হওয়ার নয়। কেননা এই মীমাংসা তদন্তসাপেক্ষ। ন্যাটো সেই তদন্ত ইতিমধ্যেই শুরু করিয়াছে। তবে এক বার তালিবান ও আল-কায়দার ঘাঁটি ধ্বংসে মার্কিন ড্রোন-হানার বিষয়টি অনুমোদন করার পর সার্বভৌমত্ব ক্ষুণ্ণ হওয়ার প্রশ্ন তোলার মধ্যে কোনও দৃঢ় নৈতিকতা থাকিতে পারে না।
পাকিস্তান সরকার তথাপি সেই প্রশ্নটিই বড় করিয়া তুলিতেছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, এমনকী পাক সেনাবাহিনীর জেনারেলরাও এ বার প্রশ্নটি উত্থাপন করিয়াছেন। কোনও কোনও সেনাপতি তো ন্যাটো তথা আমেরিকার বিরুদ্ধে প্রত্যাঘাতের হুমকিও দিয়াছেন। আফগানিস্তানে তালিবানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত ন্যাটো বাহিনীকে পাক ভূখণ্ড হইতে পাঠানো রসদের কনভয়ও বন্ধ করিয়া দেওয়া হইয়াছে। পাক সৈনিকদের উপর এই অনিচ্ছাকৃত মারণ-হামলার জন্য ন্যাটোর আনুষ্ঠানিক দুঃখপ্রকাশেও চিড়া ভিজে নাই। প্রধানমন্ত্রী ইউসুফ রাজা গিলানি হইতে সেনাপ্রধান আসফাক পারভেজ কায়ানি পর্যন্ত সকলেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে একটা জাতীয়তাবাদী অবস্থান গ্রহণ করিয়া ক্ষুব্ধ জনমতকে আরও উস্কাইয়া চলিয়াছেন, যাহার নেপথ্যে, পর্যবেক্ষকদের মতে, আগামী নির্বাচনে তেহরিক-ই-ইনসাফ-এর পালের হাওয়া কাড়িয়া লওয়ার সচেতন প্রয়াস রহিয়াছে। ঘটনা যাহাই হউক, ইহা যে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিকে আলোড়িত করিতেছে, তাহাতে সন্দেহ নাই। আবার একই সঙ্গে ঘটনাটি পাকিস্তানের সামগ্রিক পরিস্থিতি ও বিশেষ করিয়া পাক-আফগান সীমান্তে বহাল পরিস্থিতির একটা বাস্তব প্রতিফলনও বটে। দীর্ঘ কাল ধরিয়া অগণিত মাদ্রাসা হইতে নাগাড়ে তালিবান গণ-উৎপাদনের পর আজ পাকিস্তানের রাজনীতিক ও সেনানায়কদের পক্ষে তালিবান যোদ্ধাদের প্রতি হঠাৎ দমননীতি অবলম্বন করা সম্ভব নয়, বরং তাহাদের আড়াল করার, বিশেষত মার্কিন ড্রোন হানা ও ন্যাটোর বিমান-হামলা হইতে লুকাইয়া রাখার প্রবণতাই স্বাভাবিক।
পাক তালিবান ও আফগান তালিবান কিংবা ভাল তালিবান ও খারাপ তালিবানের মতো পার্থক্য রচনা কতটা বাস্তবসম্মত, তাহাও প্রশ্নাতীত নয়। আফগান তালিবানরা পাক উত্তর-পশ্চিম প্রদেশের ঘাঁটি হইতে আফগানিস্তানে গিয়া হামলা চালাইয়া আবার ঘাঁটিতে ফিরিতেছে আর পাক তালিবানরা ইসলামাবাদ, করাচি সহ নানা পাক শহরে ফিদাইন হামলা চালাইয়া পাক নাগরিকদের হত্যা করিতেছে, এমন সুস্পষ্ট ভেদরেখা বাস্তবসম্মত না-ও হইতে পারে। পাক সামরিক গোয়েন্দা চক্র আই-এস-আই সমর্থিত তালিবান কেন ন্যাটোর কনভয় ও ঘাঁটিতে হামলা চালাইতেছে, আই-এস-আই ও পাক সেনাবাহিনী কেন সন্ত্রাস দমনে আমেরিকার কাছে শত-শত কোটি ডলার হাত পাতিয়া লইয়াও তালিবানকে দুধকলা দিয়া পুষিতেছে, সেই প্রশ্নও অনিবার্য। এই সার্বিক মাৎস্যন্যায় ও অরাজকতার মধ্যে জাতীয়তাবাদ, সার্বভৌমত্ব ইত্যাদি গালভরা স্লোগান আওড়াইয়া লাভ কী? ইহা এমন এক রণাঙ্গন, যেখানে শত্রুমিত্রের সংজ্ঞা ইচ্ছাকৃত ভাবে গুলাইয়া দেওয়া হয়, সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক সংগ্রামের আড়ালে বিশ্বের দুর্ধর্ষতম সন্ত্রাসবাদীকে প্রায় সেনা-পাহারার নিরাপত্তায় লুকাইয়া রাখা হয়, তালিবানদের মতো জেহাদি জঙ্গিদের মধ্যে ‘বন্ধু’ অন্বেষণ করা হয়, দেশের বিমানঘাঁটি বিদেশি শক্তিকে ব্যবহার করিতে দিয়া সার্বভৌমত্বের বড়াই করা হয়। পাকিস্তান আজ এমনই বহু স্ববিরোধিতার নাম, সেখানে ন্যাটোর হানায় পাক সেনার মৃত্যু অস্বাভাবিক কিছু নয়। |