নতুন বাড়ি তৈরির জন্য নয়। পুরনো ফ্ল্যাটে দেওয়াল-আলমারি বানাবেন বলে দরদস্তুর করে দোকান থেকে সামান্য কিছু ইট-বালি-সিমেন্ট কিনে এনেছিলেন নিউটাউনের এক বাসিন্দা। ট্রাকে চাপিয়ে সেই মাল ফ্ল্যাটের সামনে আনতেই বিপত্তি।
তাঁকে ঘিরে ধরল কয়েক জন যুবক। যাদের মারমুখী প্রশ্ন, কার কথায় মাল কিনলেন? কোন সাহসে এখানে আনলেন?
শেষমেশ ফ্ল্যাট-মালিককে ট্রাক সমেত ‘সিন্ডিকেট’ অফিসে নিয়ে গিয়েছিল প্রশ্নকর্তারা। সেখানে তাঁকে এই মর্মে ফতোয়া দেওয়া হয় যে, কাজ করতে হলে ইমারতির সব মাল কিনতে হবে সিন্ডিকেট থেকে, সিন্ডিকেটেরই বেঁধে দেওয়া দামে। বাইরে থেকে আনা জিনিসপত্র পত্রপাঠ ফেরত যাবে।
বাধ্য হয়ে সেই ‘জুলুম’ মেনে নিতে হয়েছিল ফ্ল্যাট-মালিককে। শুধু তিনি নন, রাজারহাট-নিউটাউন ও আশপাশের এলাকার বহু মানুষেরই একই অভিজ্ঞতা। যাঁদের আক্ষেপ, এ হেন ‘তোলাবাজি’র বিরুদ্ধে থানা-পুলিশ করে যে লাভ নেই, সিন্ডিকেটই নির্দ্বিধায় তা জানিয়ে দেয়! এলাকার এক পুলিশকর্তার কথায়, “পুলিশকে বলে লাভ কী? প্রতি সিন্ডিকেট-সদস্য রাজনৈতিক কর্মী। এমনকী, রাজ্যের প্রভাবশালী মন্ত্রীও রয়েছেন তাঁদের পিছনে! ওদের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেওয়ার সাধ্য নেই পুলিশের।” |
রবিবার কেষ্টপুরের স্থানীয় তৃণমূল নেতা স্বপন মণ্ডলের হত্যাকাণ্ডকে কেন্দ্র করে ‘সিন্ডিকেট’-এর এই কোটি কোটি টাকার কারবারই সামনে এসে পড়েছে। ভরদুপুরে গুলি করে স্বপনবাবুকে খুনের ঘটনায় পুলিশ এ পর্যন্ত চার জনকে জেরা করেছে। কিন্তু খুনিদের ধরা যায়নি। আর এই ঘটনার জেরে সামনে এসেছে সিন্ডিকেটের নাম করে তোলা আদায় নিয়ে তৃণমূলের দুই গোষ্ঠীর চাপান-উতোরও।
যেমন, রাজারহাট টাউনের প্রাক্তন তৃণমূল সভাপতি জয়ন্ত দেবনাথ বলছেন, “আমরা এত দিন এখানে তৃণমূল করছি, অথচ বিধানসভায় জিতে আসার পরে আমরাই রিজার্ভ বেঞ্চে! স্থানীয় বিধায়ক তথা শ্রমমন্ত্রী পূর্ণেন্দু বসু কোনও ব্যাপারে আমাদের মতামত নেন না। উনি নিজের টিম বানিয়ে দল চালাচ্ছেন। তাই আমাদের মতো বহু কর্মীর ক্ষোভ বাড়ছে।” যার প্রতিক্রিয়ায় পূর্ণেন্দুবাবু বলছেন, “কোনও দলাদলি করতে আমি এখানে আসিনি। আর এখানে তৃণমূলের সব কমিটি ভেঙে দেওয়া হয়েছে।” পূর্ণেন্দুবাবুর এ-ও দাবি, “যে খুন হয়েছে, তার সর্ম্পকে খোঁজ নিলে অনেক তথ্য জানা যাবে।”
কিন্তু নিজেরই দলের এক স্থানীয় নেতার বিরুদ্ধে কী ‘তথ্যের’ কথা বলতে চাইছেন খোদ মন্ত্রী?
পুলিশ জানাচ্ছে, নিহত স্বপনবাবুর নামে খুন-ডাকাতি থেকে শুরু করে নানা অপরাধের অভিযোগ রয়েছে। পুলিশের দাবি: ১৯৯৭ থেকে ২০০৩ পর্যন্ত একাধিক অপরাধ করার পরে তিনি এলাকা ছেড়ে
পালিয়ে যান। বিধানসভা নির্বাচনের পরে তিনি ফিরে এসে তৃণমূলের এক গোষ্ঠীর হয়ে তোলাবাজি শুরু করেছিলেন বলে পুলিশের দাবি। অভিযোগ: কেষ্টপুর থেকে চণ্ডীবেড়িয়া পর্যন্ত ইমারতি মালপত্রের ‘সাপ্লাই’ হোক বা প্রোমোটারি সবেতে তাঁর ভাগ থাকত, জমি কেনা-বেচায় ২০ হাজার টাকা থেকে ২ লাখ টাকা পর্যন্ত তাঁকে দিতে হতো। |
‘জুলুমে’ জেরবার কেষ্টপুরের এক প্রৌঢ়ের অভিযোগ, “একতলা বাড়ি বানাতে গিয়ে সব মিলিয়ে স্বপনের সিন্ডিকেটকে আড়াই লাখ টাকা গুনে দিতে হয়েছে!”
স্বপনের পরিবার ও ঘনিষ্ঠেরা এই সব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। জেলার তৃণমূল নেতা তথা খাদ্যমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক সোমবার বলেন, “পুলিশ এখন স্বপনবাবুকে অপবাদ দিচ্ছে। আমাদের দলেরও যাঁরা পরস্পরের বিরুদ্ধে মুখ খুলছেন, তাঁরাও ঠিক করছেন না।” বরং জ্যোতিপ্রিয়বাবুর বক্তব্য, “স্বপন ছিলেন আমাদের দলের একনিষ্ঠ ও পুরনো কর্মী। সিপিএম থেকে আসা কিছু লোক আমাদের দলে ঢুকে প্রোমোটারি, সিন্ডিকেট ব্যবসা চালাচ্ছে। এরা আমাদের দলের সদস্য নয়। এই খুন তাদেরই কাজ। পুলিশকে ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে।”
কেমন এই ‘সিন্ডিকেট’ ব্যবসা? পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রের মতে, যখন যে দল ক্ষমতায় থেকেছে, তাদের ছত্রচ্ছায়ায় থাকা স্থানীয় কিছু ‘দাপুটে’ যুবকের দলই হল ‘সিন্ডিকেট।’ যার সদস্যদের অনেকের নাম আছে পুলিশের খাতায়।
এবং রাজারহাট-নিউ টাউন রোডের দু’পাশ বরাবর এমন বিস্তর ‘সিন্ডিকেট’ চোখে পড়বে। কারও সাইনবোর্ডে আবার ঘুরিয়ে লেখা, ‘জমিহারাদের সমবায়।’ প্রতি সিন্ডিকেটের কাজের ‘এলাকা’ ভাগ করা। এলাকায় জমি কেনাবেচা, প্রোমাটারি, ইমারতি দ্রব্য সরবরাহ থেকে শুরু করে নির্মাণ সংক্রান্ত যাবতীয় কাজই করতে হয় সংশ্লিষ্ট সিন্ডিকেট মারফত। এটাই অলিখিত নিয়ম। নিউ টাউনের কাজ করছে, এমন এক নামী আবাসন সংস্থার এক কর্তার কথায়, “দাম বেশি দিয়েও নিম্ন মানের মাল কিনতে বাধ্য হই। আগে যারা এই কাজ করত, তারা ছিল তৎকালীন শাসকদলের সঙ্গে। এখন তারাই রং পাল্টে ফেলেছে!”
বেদিক ভিলেজ-কাণ্ডে জমি নিয়ে তোলাবাজির অভিযোগে জড়িয়ে গিয়েছিল একাধিক রাজনৈতিক নেতার নাম। তাঁদের কারও কারও মদতেই যে দাগি অপরাধীরা ‘সিন্ডিকেট’ গড়ে সাধারণ চাষির উপরে জুলুম চালাত, তদন্তে তা-ও বেরিয়ে এসেছিল। ওই সময়ে এলাকার প্রাক্তন তৃণমূল বিধায়ক তন্ময় মণ্ডল-সহ বেশ ক’জন নেতাকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দল থেকে বার করে দেন। নেত্রীর ভূমিকা বাসিন্দাদের মনে আশা জাগিয়েছিল। তবে এ দিন স্থানীয় এক বাসিন্দা বলেন, “ভেবেছিলাম, মুখ্যমন্ত্রী এদের বিরুদ্ধেও কড়া ব্যবস্থা নেবেন। কিন্তু দিন দিন পরিস্থিতি খারাপ হচ্ছে। এখন তো দলের মধ্যেই খেয়োখেয়ি!”
পুলিশ-সূত্রের খবর, স্বপন-হত্যার তদন্তে সেই ‘খেয়োখেয়ি’রই নানা ইঙ্গিত মিলছে। উত্তর ২৪ পরগনার পুলিশ সুপার চম্পক ভট্টাচার্য এ দিন বলেন, “বেশ কিছু সূত্র মিলেছে। তদন্ত চলছে।” প্রত্যক্ষদর্শীদের সঙ্গে কথা বলে দু’জন আততায়ীর ছবিও আঁকিয়েছে পুলিশ। স্বপন-খুনের প্রতিবাদে এ দিন কেষ্টপুরে বন্ধ ডেকেছিল তৃণমূল। তৃণমূল-সমর্থকেরা গাছের গুঁড়ি ফেলে রাস্তা অবরোধও করেন। ময়না-তদন্তের পরে বিকেলে স্বপনবাবুর দেহ এলাকায় আসে। রাতে বাগুইআটির জর্দাবাগান এলাকার এক যুব তৃণমূল নেতার উপরে দুষ্কৃতীরা হামলা করে বলে অভিযোগ। পুলিশ জানায়, ওই যুব নেতার নাম রাজু দে। রাজারহাট-গোপালপুর পুরসভার ২১ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা রাজুবাবু রাতে মোটরবাইকে বাড়ি ফিরছিলেন। তখনই দু’টি মোটরবাইকে চড়ে এসে ছ’জন দুষ্কৃতী তাঁকে মারধর করে বলে অভিযোগ। এর প্রতিবাদে রাতেই বাগুইআটি থানায় বিক্ষোভ দেখান তৃণমূলকর্মীরা। |
-নিজস্ব চিত্র
তথ্য সহায়তা: কাজল গুপ্ত |