এক দিকে চাষের খরচ কম। অন্য দিকে ফলন কম তো নয়ই, অনেক ক্ষেত্রে সমান, এমনকী বেশি-ও!
স্বভাবতই উচ্চ ফলনশীল ধান ছেড়ে ক্রমশ চিরাচরিত দেশি ধানের দিকে ঝুঁকছেন রাজ্যের চাষিরা। কারণ তাঁরা দেখছেন, দেশি ধান ফলাতে রাসায়নিক সার, কীটনাশক বা জল অনেক কম লাগে বলে চাষের খরচ তুলনায় কম। অথচ ফলনে তা অনেক ক্ষেত্রেই ‘উচ্চফলনশীল’কে টেক্কা দিচ্ছে।
এমনই বেশ কিছু দেশি প্রজাতির ধানের বীজ চাষিদের তুলে দিয়েছে চুঁচুড়ার ধান গবেষণাকেন্দ্র। তার চাষেও সাফল্য মিলেছে বলে গবেষকদের দাবি। কেন্দ্র-সূত্রের খবর: চাষিদের মধ্যে জনপ্রিয়তায় সবচেয়ে উপরে আছে সুগন্ধী জাতের দেশি ধান। রাঁধুনিপাগল, তুলসীমুকুল, বাদশাভোগ, কনকচূড়, গন্ধেশ্বরী, রামতুলসী, দাদশাল বাঁশপাতা, চিনি আতপ, কাঁঠালিচাঁপা বা গুজুরিভোগের মতো প্রায় পঞ্চান্নটি দেশি প্রজাতির সুগন্ধী ধানের চাষ হচ্ছে রাজ্যের বিভিন্ন জেলায়।
শুধু গন্ধের জোর নয়। পুষ্টিগুণের সুবাদে জয়াসিলেট, চাঁপাখুশি, সীতাভোগ ইত্যাদি অধিক লোহাযুক্ত দেশি ধানও ঠাঁই করে নিয়েছে বহু কৃষকের খেতে। আবার মাতলা, হ্যামিলটন, নোনাবোখরার মতো লবণ-সহনশীল ধানের চাষ চলছে সুন্দরবনের নোনামাটিতে। স্থানবিচারে ঘেঁটু-মেটে-কলাখেসরা জাতীয় খরা-সহনশীল কিংবা ভূতমুড়ি-জুমুরকাঁদি-দুলারের মতো বন্যা-সহনশীল দেশি জাতের ধানের চাষও বেড়েছে পশ্চিমবঙ্গে। সুস্বাদু ভাতের জন্য দুধেরসর, মধুমালতী, ঝিঙেশাল জাতের দেশি ধানের চাষ তো প্রচুর পরিমাণে হচ্ছে বলে গবেষণাকেন্দ্র-সূত্রে জানানো হয়েছে।
বস্তুত বাংলার খেতে-খেতে দেশি ধানের বৈচিত্রকে স্বমহিমায় ফিরিয়ে আনার কাজে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে চুঁচুড়ার এই ধান গবেষণাকেন্দ্রটি। এখানে প্রায় ১২০০ প্রজাতির ধানের জৈব-চরিত্র সংরক্ষিত আছে। ফি বছর সেই ধান চাষ করে তার বৈশিষ্ট নির্ণয় করা হয়। পাশাপাশি জেলায় জেলায় বিভিন্ন জাতের ধান ফলানো হচ্ছে চাষিদের দিয়ে। এবং এই যৌথ প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই বাংলার মাঠে ধানের বৈচিত্র ধীরে ধীরে ফিরে আসছে বলে গবেষণাকেন্দ্র-সূত্রের দাবি।
বিশেষজ্ঞেরা জানাচ্ছেন, এক কালে শুধু বাংলার মাটিতেই প্রায় ৪৮০০ জাতের দেশি ধান ফলত। সবুজ বিপ্লবের জেরে গত চল্লিশ বছর ধরে মিশ্র সংকর প্রজাতির ধানের বাড়বাড়ন্তের আড়ালে পড়ে বাংলার সেই নিজস্ব ধান-সম্ভার গিয়েছে হারিয়ে। একই সঙ্গে লুপ্ত হয়ে যাচ্ছে বাংলার জীব-বৈচিত্রের বিপুল বিস্তারও। কী ভাবে?
বিজ্ঞানীদের বক্তব্য, উচ্চ ফলনশীল ধান চাষে প্রচুর রাসায়নিক সার ও কীটনাশক প্রয়োজন হয়। এগুলো অত্যধিক পরিমাণে প্রয়োগের ফলে জমির উর্বরতা যেমন কমছে, তেমন নিত্য জন্ম নিচ্ছে নতুন নতুন প্রতিরোধী কীট। বিভিন্ন রাসায়নিক বিষের অবশেষ জল-মাটিতে মিশে প্রকৃতিকেই দূষিত করছে। মানুষের শরীরেও তা ঢুকছে ফসলের মাধ্যমে। এই যুগপৎ দূষণ-চক্র থেকে বেরিয়ে আসার লক্ষ্যেই জৈব চাষের একটা সমান্তরাল প্রয়াস শুরু হয়েছে বিশ্ব জুড়ে।
চাষিকে ফের দেশি ধানের দিকে আকৃষ্ট করে তোলার উদ্যোগটিকে তারই অঙ্গ বলা যায়। চুঁচুড়ার গবেষণাকেন্দ্র বেশ কিছু জাতের দেশি ধান চিহ্নিত করেছে, যেগুলো ফলনের হারে উচ্চ ফলনশীল ধানকে টেক্কা দিতে পারে। এবং তার চাষে রাসায়নিক সার বা কীটনাশকের ব্যবহারও ন্যূনতম। যেমন, ‘জামাইনাড়ু।’ এই দেশি প্রজাতির ধানটির ফলন উচ্চ ফলনশীল ‘স্বর্ণমাধুরী’র চেয়ে বেশি। চুঁচুড়া কেন্দ্রের প্রধান, তথা রাজ্য কৃষি দফতরের যুগ্ম অধিকর্তা চিন্ময় কুণ্ডু বলেন, “লোহাসমৃদ্ধ বিভিন্ন দেশি ধানের বীজও আমরা চাষিদের হাতে তুলে দিচ্ছি। খারিফ মরসুমে দিয়েছি। বোরো মরসুমেও দেওয়া হবে।” চাষিরা কী বলছেন?
গবেষণাকেন্দ্র থেকে পাওয়া বাসমতী জাতীয় ধান চাষ করে রীতিমতো ভাল ফসল ঘরে তুলেছেন বলে জানালেন হাওড়ার মুন্সিরহাটের শেখ নুর আলম। পূর্ব মেদিনীপুরের গোপালপুরের দেবাশিস ঘরোই জানাচ্ছেন, সুগন্ধী দেশি ধান চাষ করে ভাল ফলন পেয়েছেন। ধান গবেষণাকেন্দ্রের কৃষি-বিজ্ঞানী বিজন অধিকারীর কথায়, “বাঁকুড়া থেকে নদিয়া পর্যন্ত অনেক জেলায় চাষিরা বাসমতী জাতীয় সুগন্ধী ধানে ভাল ফলন পাচ্ছেন। অল্প খরচে চাষ করে দাম মিলছে বেশি।”
এবং দেশি ধানের ‘পুনরুত্থানে’ সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি চাষিদের আগ্রহও যে প্রভূত গুরুত্বপূর্ণ, সব মহলই তা মানছেন। |