|
|
|
|
মাঠের উত্তেজনা ভুলে সচিনকে ‘ফুল’ এডওয়ার্ডসদের |
সুমিত ঘোষ • মুম্বই |
ক্রিকেটের ইতিহাসে তৃতীয় টাই টেস্টের ক্ষেত্র হিসেবে ওয়াংখেড়ের নাম লেখা থাকবে কি না, তার উপর সবেমাত্র তখন যবনিকা পড়েছে। এমন একটা পরিস্থিতি যেখানে দু’দলের রান সমান। রবিচন্দ্রন অশ্বিন জেতাতে পারলেন না। শেষ বলে জেতার জন্য দরকার ছিল ২ রান। তিনি পেলেন ১। আবার ভারত অলআউটও হল না। টেস্ট ক্রিকেটের নিয়ম অনুযায়ী তাই ম্যাচ ড্র।
অথচ কী দুর্দান্ত আবেগের বলয় তৈরি হতে পারত শেষ বলে ভারত জিতলে। ২৬/১১-র তৃতীয় বার্ষিকী ছিল আজ। সচিন আর ধোনি সকালে মাঠে আসার আগে শহিদ-বেদিতে ফুল দিয়ে এলেন। মৃতদের উদ্দেশে নীরবতা পালন করলেন। তাঁদের আত্মার শান্তি কামনা করলেন। এই তাজমহল হোটেলেই ভয়াবহ তাণ্ডব চালিয়েছিলেন কাসভ-রা। আশেপাশের রাস্তা, লাগোয়া রেস্তোরাঁ বা পাবে গেলে এখনও দেখা যাবে বুলেটের চিহ্ন। আজ ভয়াবহ জঙ্গি হানার আরও একটি বর্ষপূর্তির দিনে ওয়াংখেড়েতে টেস্ট জেতার তাৎপর্যটাই হতে পারত অন্য রকম।
সেটা না হয়েও অবশ্য স্মরণীয় কিছু ছবি উঠল। পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান শেষ হতে না হতে যেমন নতুন ‘ম্যাচ’ শুরু হয়ে গেল। ওয়াংখেড়ে টেস্টের শেষ দিনের মতোই যা নাটকীয় এবং আগ্রহ আমদানি করা। মাঠেরটা ছিল যুদ্ধ। কেউ সূচাগ্র মেদিনী ছাড়তে রাজি নয়। এটা সম্ভ্রমের ক্রিকেট-বেদিতে সারি দিয়ে ফুল দিতে যাওয়া। আর ‘ম্যাচ’-টা একান্তই ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেটারদের নিজেদের মধ্যে। কেউ সচিন তেন্ডুলকরের সঙ্গে এক সিরিজে খেলার মুহূর্তকে বিনা সিলমোহরে ছেড়ে দিতে রাজি নয়। সকলের চাই সচিনের সই। তাঁর সঙ্গে ছবি। কেউ নিয়ে আসছেন জার্সি। কেউ বাড়িয়ে দিচ্ছেন ব্যাট। কারও হাতে টুপি। |
|
সচিনময় ওয়াংখেড়ে। উত্তেজক ড্রয়ের পরেও চন্দ্রপলদের ভিড় লিটল মাস্টারের সই নিতে। ছবি: উৎপল সরকার |
শুরু করলেন কার্ক এডওয়ার্ডস। এই টেস্টে যিনি তিন নম্বরে নেমে প্রথম ইনিংসে ৮৬ রান করেছেন। তাঁকে সচিনের কাছে নিয়ে গেলেন অধিনায়ক ডারেন স্যামি। খোঁড়াতে খোঁড়াতে যিনি এ দিন মাঠে থাকলেন শুধু ০-৩ হোয়াইটওয়াশ ঠেকাবেন বলে। “একটু ব্যাটিং নিয়ে জানতে চায় তোমার কাছে। ইফ ইউ ক্যান প্লিজ হেল্প।” সচিন সঙ্গে সঙ্গে রাজি। এডওয়ার্ডস এই সুযোগ ছাড়েন কখনও? একেবারে স্টান্স থেকে শুরু করলেন। তার পর স্ট্রোক, ব্যাটের ফলো-থ্রু, ঘাড়, মাথা, কাঁধ কিছু বাদ দিলেন না। পুরস্কার-বিতরণী অনুষ্ঠান শেষ হয়ে গিয়েছে। সচিন ড্রেসিংরুমে ফিরে যাচ্ছেন এ বার। এডওয়ার্ডসও পিছন পিছন চললেন। সচিন তাঁকে তখন বুঝিয়ে যাচ্ছেন, “জিনিসগুলো খুব সিম্পল রাখার চেষ্টা করো। জটিল করে তোলার কোনও দরকার নেই।”
এ বার ভারতীয় ড্রেসিংরুমের সামনে। মানে সেই ২ এপ্রিলের বিশ্বকাপ জয়ের ঐতিহাসিক ড্রেসিংরুম। এডওয়ার্ডস তখনও ছাড়বেন না সচিনকে। আবার স্টান্স নিয়ে জানতে শুরু করে দিলেন। ও দিকে ততক্ষণে তাঁর সতীর্থরা লাইন দিয়ে ফেলেছেন। ফিডেল এডওয়ার্ডস। নাটকীয় টেস্টের শেষ ওভারটা দারুণ বল করে যিনি ভারতের জয় আটকে দিলেন। তার চেয়েও বেশি করে যেটা করলেন, ফিরিয়ে আনলেন সেই বিখ্যাত ক্যারিবিয়ান স্পিরিট। সাতাশি বিশ্বকাপে নন-স্ট্রাইকার এগিয়ে গিয়েছে দেখেও রান আউট করেননি কোর্টনি ওয়ালশ। তখন রান আউটটা করে দিলে তাঁর টিম জিতে যায়। এ দিন ফিডেল এডওয়ার্ডসও যদি ওই সময় পূর্বসূরি ওয়ালশের মতো ক্রিকেটের স্পিরিট না দেখিয়ে ক্রিজ ছেড়ে অনেকটা বেরিয়ে যাওয়া অশ্বিনকে রান আউট করে দিতেন, সিরিজ ২-১ হত না জোর দিয়ে বলা যাচ্ছে না।
শেষ ওভারে মাত্র ৩ রান করতে হত অশ্বিন আর বরুণ অ্যারনকে। হাতে দুই উইকেট। প্রথম তিনটে বলে অ্যারনকে একটা রানও করতে দিলেন না। চতুর্থ বলে কোনও রকমে মিড-অফে ঠেলে পড়িমড়ি করে দৌড়ে একটা রান নিলেন অ্যারন। পরের বলে অশ্বিনকে আবার আটকে দিলেন। রান হল না। শেষ বলে ২ রান করলে ভারত জিতবে। ১ রান করলে ড্র। পুরো ফিল্ডিং ছড়িয়ে দিলেন স্যামি। অশ্বিন লং-অনে ড্রাইভ মারলেন। ২ রানের জন্য দৌড়ালেনও। ১-এর বেশি পেলেন না। অশ্বিন আর তাঁর সঙ্গী স্পিনার প্রজ্ঞান ওঝা তার আগে ম্যাচের এই উত্তেজক মঞ্চটা গড়েছেন। সকালে ওঝা নিলেন ছয় উইকেট। অশ্বিন বাকি চার। জোড়া স্পিনের ফাঁসে ওয়েস্ট ইন্ডিজ দ্বিতীয় ইনিংসে শেষ মাত্র ১৩৪ রানে।
|
টাই টেস্ট |
অস্ট্রেলিয়া বনাম ওয়েস্ট ইন্ডিজ
ব্রিসবেন, ৯-১৪ ডিসেম্বর ১৯৬০ |
ভারত বনাম অস্ট্রেলিয়া
চেন্নাই, ১৮-২২ সেপ্টেম্বর ১৯৮৬ |
ওয়েস্ট ইন্ডিজ
৪৫৩ এবং ২৮৪ |
ইংল্যান্ড
৪০৬ এবং ২০৪/৭ |
অস্ট্রেলিয়া
৫৭৪/৭ এবং ১৭০-৫ |
ভারত
৪৮২ এবং ২৪২/৯ |
(দুটি ইনিংসেই অস্ট্রেলিয়া ডিক্লেয়ার করে) |
|
কিন্তু সে সব তো ছিল মাঠের যুদ্ধ। সচিন যেখানে প্রবল প্রতিপক্ষ। প্রধান প্রতিপক্ষ। আর মাঠের বাইরে সচিন মানে যে, ক্রিকেট-দূতের সাক্ষাৎ পাওয়া। তাঁর ক্লাস করে নাও। মুহূর্তটাকে সাজিয়ে রাখো। ফিডেল এডওয়ার্ডস সেই সুযোগ ছাড়বেন কেন? তাঁর পিছনে কে? না, শিবনারায়াণ চন্দ্রপল। ওয়েস্ট ইন্ডিজের এত অভিজ্ঞ ব্যাটসম্যান। তাঁকে বলা হয় ক্যারিবিয়ান ওয়াল। তিনিও জার্সি নিয়ে এগিয়ে এলেন সচিনকে দিয়ে সই করাবেন বলে।
দেখে সত্যিই অদ্ভুত লাগছিল যে, এই টিমটাই কিনা কী রকম দলবদ্ধ ভাবে এককাট্টা ছিল সচিনকে সেঞ্চুরি পেতে দেবে না। ম্যাচের শেষ বল নয়। মাঁকড়, উমরিগড়ের কীর্তি ছোঁয়া অশ্বিনের দুর্দান্ত অলরাউন্ড পারফরম্যান্স নয়। এমনকী ৯৪ রানের মাথায় হৃদয় ভেঙে দেওয়া ইন্দ্রপতনও নয়। পাঁচ দিন ধরে ওয়াংখেড়ের গভীরতম দৃশ্য এটাই। মাঠের মধ্যে শততম সেঞ্চুরির মণ্ডপ যাঁরা লণ্ডভণ্ড করে দিয়ে গেলেন, মাঠের বাইরে তাঁরাই হাজির পুজোর ডালি নিয়ে। আর এডওয়ার্ডসরা তাঁদের দেশে সচিনকে পাওয়া থেকে বরাবর বঞ্চিত। ২০০৭ বিশ্বকাপ বাদ দিলে বহুকাল হয়ে গিয়েছে তিনি যানই না ভিভ, লারাদের দেশে। অতএব মহাপ্রসাদ যা পারো এখানেই সংগ্রহ করে নাও!
হোটেলে এ দিন যখন ডারেন স্যামিরা ফিরছেন, লবিতে তখন দাঁড়িয়ে তাঁদের স্ত্রী, বান্ধবীরা। ওয়েস্ট ইন্ডিজ টিম ঢুকতেই তাঁরা হাততালি দিয়ে স্বাগত জানালেন। তা দেখেই বোঝা গেল, হোয়াইটওয়াশ ঠেকানোটা কত গভীর ভাবে তাঁরা চাইছিলেন। স্যামি একটু আগে মাঠে বলেও এসেছেন, “আমরা যে করে হোক ০-৩ আটকাতে চেয়েছিলাম। আমি খুব খুশি যে, ছেলেরা শেষ পর্যন্ত এক বিন্দুও জমি ছাড়েনি। বিশু কী ভাবে কার্যত এক পা নিয়ে বোলিং করে গেল, সবাই দেখেছেন।”
ধোনি আবার মনে করছেন, খুব গুরুত্বপূর্ণ সময়ে তাঁদের উইকেটগুলো পড়েছে। কখনও সহবাগ। কখনও তেন্ডুলকর। কখনও সেট হয়ে যাওয়া দ্রাবিড়। কখনও তিনি নিজে। বিরাট কোহলির প্রশংসা করলেন। কিন্তু ওয়াংখেড়ের যেন এ বারে দেওয়াল-লিখনই ছিল অ্যান্টিক্লাইমেক্স। শততম সেঞ্চুরির রোশনাই তৈরি হতে হতেও হবে না। ছ’রান দূরে আটকে যাবে। টাই বা রুদ্ধশ্বাস ফয়সালার বারুদ তৈরি হয়েও শেষ মুহূর্তে নিভে যাবে। ফাটবেই না! |
শেষ বলে স্কোর সমান হয়ে ড্র |
জিম্বাবোয়ে বনাম ইংল্যান্ড
বুলাওয়া, ১৮-২২ ডিসেম্বর ১৯৯৬ |
ভারত বনাম ওয়েস্ট ইন্ডিজ
মুম্বই, ২২-২৬ নভেম্বর ২০১১ |
জিম্বাবোয়ে
৩৭৬ এবং ২৩৪ |
অস্ট্রেলিয়া
৫০৫ এবং ২৩২ |
ওয়েস্ট ইন্ডিজ
৫৯০ এবং ১৩৪ |
ভারত
৩৯৭ এবং ৩৪৭ |
(ম্যাচের চতুর্থ ইনিংসে ভারত অল আউট না হওয়ায় টেস্ট টাইয়ের বদলে ড্র) |
|
ওয়াংখেড়ের স্কোরবোর্ড |
ওয়েস্ট ইন্ডিজ
প্রথম ইনিংস: ৫৯০
(চতুর্থ দিনের শেষে দ্বিতীয় ইনিংসে ৮১-২) |
ব্রাথওয়েট ক তেন্ডুলকর বো প্রজ্ঞান ৩৫
ব্র্যাভো ক ও বো প্রজ্ঞান ৪৮
পাওয়েল এলবিডব্লিউ অশ্বিন ১১
স্যামুয়েলস স্টা ধোনি বো প্রজ্ঞান ০
বাও বো অশ্বিন ১
স্যামি ক ধোনি বো অশ্বিন ১০
রামপল ক তেন্ডুলকর বো প্রজ্ঞান ০
এডওয়ার্ডস ন.আ. ২
বিশু এলবিডব্লিউ ০
অতিরিক্ত ৭
মোট ১৩৪ অল আউট।
পতন: ৬, ৩০, ৯১, ১১২, ১১২, ১১৭, ১২০, ১২৯, ১৩৪।
বোলিং: প্রজ্ঞান ২৭-৫-৪৭-৬, ইশান্ত ৮-২-১৫-০, বরুণ ৪-০-২৩-০
অশ্বিন ১৫.২-০-৩৪-৪, সহবাগ ২-০-৩-০, সচিন ১-০-৫-০। |
ভারত
দ্বিতীয় ইনিংস |
গম্ভীর ক স্যামি বো এডওয়ার্ডস ১২
সহবাগ ক স্যামি বো বিশু ৬০
দ্রাবিড় ক রামদিন বো স্যামুয়েলস ৩৩
সচিন ক এডওয়ার্ডস বো স্যামুয়েলস ৩
লক্ষ্মণ ক বারাথ বো রামপল ৩১
কোহলি ক স্যামি বো বিশু ৬৩
ধোনি ক এডওয়ার্ডস বো রামপল ১৩
অশ্বিন রান আউট ১৪
ইশান্ত বো রামপল ১০
বরুণ ন.আ. ২
অতিরিক্ত ১
মোট ২৪২-৯।
পতন: ১৯, ১০১, ১০৬, ১১৩, ১৬৫, ১৮৯, ২২৪, ২৩৯, ২৪২।
বোলিং: এডওয়ার্ডস ৭-০-২৮-১, রামপল ১৬-১-৫৬-৩,
স্যামুয়েলস ২৫-০-৯৩-২, বিশু ১৬-০-৬৫-২। |
|
|
|
|
|
|
|