প্রবন্ধ...
আমি আর স্যর আহমেদ
মি আর স্যর আহমেদ সম্ভবত এই এক বারই এক ব্র্যাকেটে আসব। একুশ শতকের প্রথম দশটা বছর অতিক্রান্ত হওয়ার আগে এটা হওয়া সম্ভবই ছিল না। পরেও... হয়তো এমন পরিস্থিতি আর তৈরিই হবে না।
আমার গল্পটাই আগে বলি। মাসকয়েক আগে এক অনলাইন বইয়ের দোকান থেকে একটা বই অর্ডার দিলাম। তিন দিনে সেই বই বাড়িতে পৌঁছে যাওয়ার কথা। প্রতি বারই যায়। এই বার এল না। সাত দিন কাটল। ফোন করলাম সেই দোকানের অফিসে। তাঁরা জানালেন, যিনি এই ব্যাপারগুলো দেখেন, তিনি আপাতত অফিসে নেই। কয়েক বারের চেষ্টায় তাঁকে পাওয়া গেল। তিনি বললেন, কোনও একটি জটিলতায় আটকে গিয়েছে অর্ডারটি, দিন দুয়েক সময় পেলে তিনি বই পাঠানোর ব্যবস্থা করবেন। চার দিন কাটল, বই এল না। আবারও ফোন। আরও অপেক্ষা।
তার পর, আর ফোন না করে আমার ফেসবুকের দেওয়ালে লিখে দিলাম ঘটনাটা। কী আশ্চর্য, আধ ঘণ্টার মধ্যে ফোন। সেই দোকানের এক কর্তা বিস্তর ক্ষমাপ্রার্থনা করলেন এই দেরির জন্য। জানালেন, পরের দিনই বই পৌঁছে যাবে আমার বাড়িতে। এ বার সত্যিই এল। আরও একটি ফোনে জানলাম, ক্ষতিপূরণস্বরূপ দোকানটি আমায় বইটা বিনামূল্যে পাঠিয়েছে। একটি অনুনয়সমেত যেন আমি ফেসবুকের দেওয়াল থেকে মুছে দিই ওই নিন্দাটুকু।
স্যর আহমেদের লড়াই আবার ওই ফেসবুকের সঙ্গেই। আজ্ঞে কী বলছেন, স্যর আহমেদকে ঠিক চিনতে পারছেন না? তাঁরও আপত্তি ঠিক এই কারণেই। কারণ গোটা দুনিয়া তাঁকে তাঁর মধ্যনামে চেনে সলমন। তিনি স্যর আহমেদ সলমন রুশদি। ফেসবুক দিনকয়েক আগে তাঁর অ্যাকাউন্টে ‘সলমন রুশদি’ নামটি পাল্টে ‘আহমেদ রুশদি’ করে দিয়েছিল। তাতে মর্মান্তিক চটেছিলেন চিরবিতর্কিত এই লেখক। টুইটারে তিনি সরাসরি আক্রমণ করেন ফেসবুকের জনক মার্ক জুকেরবার্গকে। টুইট আক্রমণ শুরু হওয়ার এক দিনের মধ্যেই ফেসবুক তাঁর নামটি ফের সলমন করে দেয়। অতঃপর শান্তিকল্যাণ।

মোল্লার এক বন্ধু এক বার তাঁকে একটা হাঁস উপহার দিয়েছিলেন। খুশি হয়ে মোল্লা সেই হাঁসেরই সুরুয়া বানিয়ে বন্ধুকে দাওয়াত দিলেন। তার পরই বিপর্যয়। প্রতি দিন এক জন করে নতুন লোক আসতে থাকেন সুরুয়া খাওয়ার লোভে। প্রথম দিন সেই বন্ধুর বন্ধু, দ্বিতীয় দিন বন্ধুর বন্ধুর বন্ধু। তৃতীয় দিনে আরও এক ধাপ দূরে ইত্যাদি। আধুনিক সমাজবিজ্ঞানের কোনও পণ্ডিত গল্পটা শুনলে বলতেন, ছ’দিনের পর দুনিয়ার সবাই মোল্লার বন্ধু হয়ে যাবেন।
সমাজবিজ্ঞানে ‘সিক্স ডিগ্রিজ অব সেপারেশন’ নামে একটা ধারণা চালু আছে। বন্ধুর বন্ধুর বন্ধুর বন্ধু এই ভাবে হিসেব করে দেখলে গোটা দুনিয়ায় যে কোনও দু’জন মানুষের মধ্যে সবচেয়ে বেশি পাঁচ জন বন্ধু থাকতে পারেন। মানে, আপনার বন্ধুর বন্ধু বারাক ওবামার বন্ধুর বন্ধুর বন্ধুকে চেনেন। আমরা সবাই সবার থেকে বড় জোর পাঁচ বন্ধুর দূরত্বে আছি। গোটা দুনিয়ার সবাই।
আছি, নাকি ছিলাম? ইটকাঠের দুনিয়ায় যেখানে সিক্স ডিগ্রিজ অব সেপারেশন, সেখানে ফেসবুকে নাকি ৪.৭৪ ডিগ্রিজ। মানে, বাস্তব দুনিয়ার চেয়ে ফেসবুকে প্রায় দেড় জন কম প্রয়োজন যে কোনও মানুষের কাছে পৌঁছনোর জন্য। ফেসবুকের দুনিয়ায় আমরা সবাই আরও কাছাকাছি আছি। আমার কথা আরও দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে পারে গোটা দুনিয়ায়।
হ্যাঁ, আমার কথাও। এখানেই সাইবার দুনিয়ার মাহাত্ম্য। এখানে ‘কে বলছে’-র চেয়ে ‘কী বলা হচ্ছে’ সেটা অনেক বেশি জরুরি। কথাটা জরুরি হলে, কে বলছে তার পরোয়া না করেই সেই কথা ছড়িয়ে পড়ে সাইবার দুনিয়ায় এক ওয়াল থেকে অন্য ওয়ালে, এক জনের টুইট থেকে অন্যের রিটুইটে। না হলে, আরব বসন্তের হাওয়া বইতেই আরম্ভ করত না। না হলে, অণ্ণা হজারের বিক্ষোভ হয়তো গুটিয়ে যেত তিন দিনেই। সাইবার ওয়ার্ল্ড হল সাধারণ মানুষের হাতে অ-সাধারণ ক্ষমতা পৌঁছে যাওয়ার গল্প। যাকে বলে ‘পাওয়ার টু ইউ’।
এই ক্ষমতাটাকেই প্রতিষ্ঠান ভয় পায়। আমার সেই বইয়ের দোকান যেমন। একটা বড় ব্যবসার কী এসে যায় আমার মতো এক জন তুচ্ছ গ্রাহকের অসন্তোষে? সাইবার দুনিয়ার বাইরে তো আমরা কতই ঠকি। তার পর রাগারাগি করি, একে ওকে বলে বেড়াই। ক’জনের কাছে ক্ষমা চেয়ে ফোন আসে? ক’জন পরিষেবার পাওয়ার পরও পয়সা ফেরত পান? বাইরের দুনিয়াতে আমাদের অসন্তোষে কারও কিছু যায় আসে না। আমরা বলি, কানেকশন না থাকলে কিচ্ছু হয় না। সাইবার দুনিয়ায় আমাদের এই ‘কানেকশন’ আছে। আমাদের অসন্তোষ ছড়িয়ে যেতে পারে অনেকের মধ্যে। ব্যবসার বড় বদনাম হয়ে যেতে পারে তাতে। তাই তৎপর ব্যবসায়ীরা, ক্ষমা চাইতে বিন্দুমাত্র বিলম্ব হয় না।
কিন্তু, ফেসবুক কেন নতজানু হয় রুশদির সামনে? রুশদি তো তার খদ্দের নন। আর, রুশদি যদি রাগ করে ছেড়েও দেন তাঁর ফেসবুক অ্যাকাউন্ট, বাকি আশি কোটির মধ্যে কত জন তাঁর অনুগামী হবেন? সেই ক’জনের চলে যাওয়ায় কিছু কি হেরফের হবে ফেসবুকের? তবু নতজানু হয় কেন দুনিয়ার এক নম্বর স্যোশাল নেটওয়ার্কিং সাইট?
তিনি সলমন রুশদি বলেই? খানিকটা বটে। কিন্তু, তিনি লেখক ‘সলমন রুশদি’ বলে নয়, তাঁর টুইটারে অনেক ফলোয়ার আছে বলে। তাঁর টুইট আরও অনেকে রিটুইট করবে বলে। তাঁর কথা আমার-আপনার চেয়ে অনেক বেশি দ্রুত ছড়িয়ে পড়বে বলে তিনি খানিক বেশি গুরুত্ব পেয়েছেন। কিন্তু, পুরোটা নয়। আপনি যদি ফেসবুকের ওপর রেগে গিয়ে এমন ভাবে প্রতিবাদ করতে আরম্ভ করেন, আপনার কথাও আজ না হোক কাল শুনবেই ফেসবুক।
কেন? নিশ্চিত করে জানি না, তবু মনে হচ্ছে, সেই আদি লোকলজ্জার ভয় বুঝি তাড়া করছে। যদি লোকে জেনে যায় ফেসবুক এখন যথেচ্ছাচার করছে? যদি লোকে জেনে যায়, ফেসবুক ব্যক্তিস্বাধীনতাতেও হস্তক্ষেপ করতে পারে? জেনে যদি যায়ই, তাতে ক্ষতি কী? প্রশ্নটা নিজেকে করলেই উত্তর পাওয়া যাবে। যদি লোকে জেনে যায়, আমি এই বার পরীক্ষায় ডাহা ফেল করেছি, তাতে ক্ষতি কী? যদি লোকে জেনে যায়, আমার মেয়ে ড্রাইভারের সঙ্গে পালিয়ে গিয়েছে, তাতেই বা ক্ষতি কী? সরাসরি ক্ষতি নেই কিছু শুধু পরের দিন রাস্তায় বেরোলে লোকের নজরে অস্বস্তি হওয়া ছাড়া। ফেসবুক মালিকেরও কি অস্বস্তি হবে কোথাও?
তবে, শুধু লোকলজ্জা নয়, সেটা নিশ্চিত। ব্যবসা বড় বালাই। ফেসবুকে আপনি খদ্দের নন। আপনি আসলে পণ্য। আপনার সম্বন্ধে যাবতীয় তথ্য, আপনার পছন্দ-অপছন্দ, ঠিকানা, ই মেল অ্যাড্রেস, বন্ধুর তালিকা, ফোন নম্বর সবই পণ্য। এই পণ্যের ক্রেতা দুনিয়া জুড়ে ছড়িয়ে থাকা মার্কেটিং সংস্থাগুলি। আর, ফেসবুক হল এই পণ্যের সেরা বিপণি। আজ যদি ফেসবুকের ওপর রেগে গিয়ে, বিরক্ত হয়ে আপনি ছেড়ে দেন এই স্যোশাল নেটওয়ার্কিং সাইট, যোগ দেন অন্য কোনওটায়, ব্যবসার বিপুল ক্ষতি। ক্রেতা দোকান ছেড়ে চলে গেলে ব্যবসায়ী তবু মানতে পারেন। কিন্তু পণ্য যদি দোকান ছেড়ে রওনা দেয়?
লেখার একেবারে গোড়ায় বলেছিলাম, আমার আর সলমন রুশদির এক ব্র্যাকেটে আসা ভবিষ্যতেও হয়তো আর সম্ভব হবে না। হবে না, কারণ ফেসবুকের মতো ওয়েবসাইটগুলো ক্রমে সতর্ক হয়ে যাবে। আমরা অসন্তুষ্ট হতে পারি, হয়ে অন্যত্র চলে যেতে পারি এমন কোনও ঘটনা যাতে না ঘটে, তা নিশ্চিত করতে আরও সাবধান হবে। আমরা তখন স্বেচ্ছাবন্দি হয়ে থাকব ওই বিপণির পণ্য হয়ে। তুষ্ট হারেমবন্দি।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.