প্রথমে ছিল কংগ্রেস-বিজেপি, দু’পক্ষের থেকেই সমদূরত্বের নীতি। ‘সাম্প্রদায়িক’ বিজেপিকে ঠেকানোর যুক্তি তুলে পরে কেন্দ্রে কংগ্রেসের সঙ্গে জোট বাঁধে সিপিএম। আবার এখন কংগ্রেসের ‘দুর্নীতির’ বিরুদ্ধে সংসদে বিজেপির সঙ্গে কক্ষ সমন্বয় করে চলেছে তারা। কিন্তু তার পরেও বিজেপির সঙ্গে একই বন্ধনীতে আসতে চান না সিপিএমের সংসদীয় নেতা সীতারাম ইয়েচুরি। এক কথায় সংসদে দলের লাইন বাছতে গিয়ে বারে বারে দ্বন্দ্ব ও দোলাচলে পড়তে হচ্ছে সিপিএমকে। দলের নেতারা মনে করছেন, এপ্রিলের পার্টি কংগ্রেসে দলের রাজনৈতিক লাইন ঠিক করতে গিয়েও সেই দোলাচলেই তাঁদের পড়তে হবে।
২০০৮-এর কোয়ম্বত্তূর পার্টি কংগ্রেসে দল সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, ‘সাম্প্রদায়িক শক্তি’ বিজেপিকে কেন্দ্রের ক্ষমতা থেকে দূরে রাখতে দল কংগ্রেসকে কেন্দ্রে সমর্থন করবে। কিন্তু মনমোহন-সরকার পরমাণু চুক্তি নিয়ে অনড় মনোভাব নেওয়ায় সমর্থন প্রত্যাহার করতে হয় দলকে। কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব মনে করছে, এখন মনমোহন-সরকার যে আর্থিক উদার নীতির পথে চলছে, তাতে কোনও ভাবেই আর কংগ্রেসের সঙ্গে হাত মেলানো সম্ভব নয়। বরং কংগ্রেসের এই আর্থিক নীতির বিরোধিতাকেই আরও জোরদার করতে চান দলের সাধারণ সম্পাদক প্রকাশ কারাট। সংসদের চলতি শীতকালীন অধিবেশনে মূল্যবৃদ্ধির প্রশ্নেও কারাটের সেই ‘কঠোর’ মনোভাবেরই প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে। মূল্যবৃদ্ধিতে লাগাম পরাতে সরকার ব্যর্থ হয়েছে কি না, সেই প্রশ্নে ভোটাভুটির দাবিতে অনড় থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সিপিএম-নেতৃত্ব। গত কাল কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায় বাম নেতাদের মধ্যাহ্নভোজনে ডেকে আলোচনা করে অচলাবস্থা দূর করার চেষ্টা করেছিলেন। সিপিআইয়ের গুরুদাস দাশগুপ্ত ভোটাভুটি ছাড়া আলোচনায় মত দিলেও, কারাট-ইয়েচুরি রাজি হননি। সিপিএম নেতাদের বক্তব্য, মূল্যবৃদ্ধি প্রসঙ্গে বিজেপি শেষ পর্যন্ত সরকারের বিরুদ্ধে ভোট দিক বা না দিক, নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের দাম নিয়ে আমজনতার উদ্বেগ তাঁরা সংসদে তুলে ধরতে বদ্ধপরিকর।
সমস্যা হল, বিজেপিকে বাদ দিয়ে কংগ্রেস বিরোধিতার ইচ্ছে থাকলেও বামেদের এখন সেই ক্ষমতা নেই। আবার মূল্যবৃদ্ধির মতো বিষয়ে বিজেপি এখন বামেদের সমর্থন করলেও, আর্থিক উদারনীতির ক্ষেত্রে কংগ্রেসের সঙ্গে বিজেপির যে বিশেষ ফারাক নেই, সে বিষয়েও সিপিএম নেতৃত্ব ওয়াকিবহাল। কিন্তু সংসদে মূল্যবৃদ্ধি প্রসঙ্গে বিজেপির সমর্থনের পরিবর্তে কালো টাকার প্রসঙ্গে বিজেপিকে সমর্থন করতে রাজি হয়েছে সিপিএম। কংগ্রেস বিরোধিতার রাশ নিজেদের হাতে রাখতে বিজেপিও এই ঐক্য অটুট রাখতে চায়। বিজেপি চায় না, দুর্নীতি প্রসঙ্গ উঠলে বামেরা তাঁদের বিরুদ্ধে সে ভাবে সরব হোন। কারণ কেন্দ্রীয় সরকারের স্পেকট্রাম বা কমনওয়েল্থ গেমসের দুর্নীতির কথা বলতে গেলে কর্নাটকে ইয়েদুরাপ্পা সরকারের দুর্নীতি নিয়েও বামেরা যে চুপ থাকবেন না, সে কথাও জানে বিজেপি। ইশরাত জহানের মামলা নিয়েও বিজেপির কড়া বিরোধিতায় নেমেছে সিপিএম। বিশেষ তদন্তকারী দল গুজরাত পুলিশের বিরুদ্ধে রিপোর্ট দেওয়ার পর সিপিএমের পলিটব্যুরো নরেন্দ্র মোদীর পদত্যাগ দাবি করেছে। পলিটব্যুরোর দাবি, বিষয়টিকে ধামাচাপা দেওয়ার ক্ষেত্রে গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রীর ভূমিকারও তদন্ত হোক। তিনি গদিতে থাকলে তা সম্ভব নয়। অর্থাৎ মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে বিজেপির সমর্থন চাইলেও দুর্নীতি ও সাম্প্রদায়িকতা প্রসঙ্গে তাদের তুলোধোনা করে দূরত্ব বজায় রাখতে চাইছে সিপিএম।
তা হলে কি বিজেপি ও কংগ্রেসের থেকে ‘সমদূরত্ব’ রেখে চলার নীতিতেই ফিরতে চাইছে সিপিএম? দলের নেতারা এখনই এ বিষয়ে মন্তব্যে নারাজ। পার্টি কংগ্রেসে সিপিএম কোন ‘রাজনৈতিক লাইন’ গ্রহণ করবে, তা নিয়ে ইতিমধ্যেই দলে বিতর্ক শুরু হয়েছে। আনুষ্ঠানিক ভাবে এ নিয়ে প্রথম আলোচনা হবে ১৩ ও ১৪ ডিসেম্বর দিল্লির পলিটব্যুরোর বৈঠকে। তার পরে জানুয়ারিতে কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠক। এর পরে সর্বোচ্চ স্তরে আরও কয়েক দফা আলোচনার পরে পার্টি কংগ্রেসে সেই রাজনৈতিক প্রস্তাব পেশ ও গ্রহণ করা হবে। তবে রাজনৈতিক লাইনই যে এই মুহূর্তে বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠছে, সিপিএম নেতারা তা বিলক্ষণ মানছেন। |