রবীন্দ্রনাথের সার্ধশতবর্ষে ঘুণপোকা যে কোথায় লুকিয়েছিল, এক লহমায় ধরিয়ে দিয়েছিলেন উনি। গত মার্চ মাসে ‘টেলিগ্রাফ’ পত্রিকার তরফে পাঠানো ই-মেলে ছবিগুলো দেখেই সটান বলে দিয়েছিলেন, ওগুলো আদৌ রবীন্দ্রনাথের আঁকা নয়। জাল ছবি।
কিন্তু ই-মেলে পাঠানো ছবি দেখে সেগুলো নকল না আসল, বোঝা যায়? অক্সফোর্ডের বাসিন্দা হাসলেন, “বোঝা যায়। কোনও কোনও ছবিতে, মেয়ের মুখ বা গাছ এত নিখুঁত ভাবে আঁকা ছিল যে, সামনে কেউ রবীন্দ্রনাথের ছবি খুলে কপি করেছে বলে বোঝা যাচ্ছিল। তার পর
সেই কপিতে রবীন্দ্রনাথের রেখার আদলে আঁচড়।”
শনিবার বিকেলে চক্ষুবিশেষজ্ঞদের এক সম্মেলনের ফাঁকে ব্যক্তিগত আড্ডায় এ রকমই বলছিলেন কেতকী কুশারী ডাইসন। রবীন্দ্রনাথের সার্ধশতবর্ষে দিল্লি, কলকাতা, ঢাকায় বিভিন্ন আলোচনাচক্রে যোগ দিতে এসেছেন তিনি। এবং ঘটনাচক্রে শুক্রবারই ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণ কলকাতা হাইকোর্টে তাদের রিপোর্ট জমা দিয়ে জানিয়েছে, কেতকীর সন্দেহ মিথ্যা নয়। গত মার্চ মাসে সরকারি আর্ট কলেজের প্রদর্শনীতে রবীন্দ্রনাথের যে কুড়িটি ছবি ছিল, তার সবগুলিই জাল। আগামী ৯ ডিসেম্বর এ নিয়ে আদালতে শুনানি। যে রবীন্দ্রনাথ সরকারি আর্ট কলেজে তাঁর স্নেহধন্য মুকুল দে-র ঘরে বসে ছবি আঁকতেন, সার্ধশতবর্ষে তাদের প্রদর্শনীতেই ধরা পড়ল ‘নকল রবীন্দ্রনাথ’। |
|
|
নকল ছবিগুলির একটি |
কেতকী কুশারী ডাইসন |
|
শুধু কেতকী নন। ই-মেলে ছবি দেখে ‘কলাভবন’-এর কিউরেটর সুশোভন অধিকারীর বক্তব্যও ছিল সে রকম, “রবীন্দ্রনাথের রঙে, রেখায় যে তীব্রতা থাকে, সেগুলি এখানে নেই। অপটু নকলনবিশি।” কেতকী আর সুশোভনের যুগ্ম প্রয়াসেই তো দুই দশক আগে বেরিয়েছিল সাড়াজাগানো সেই বই, ‘রঙের রবীন্দ্রনাথ’। সেই জুটি এ দিন চক্ষুবিশেষজ্ঞদের সম্মেলনে জানালেন তাঁদের তত্ত্ব! চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় ‘প্রোটানোপিয়া’-য় আক্রান্ত ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। বংশগত রোগ। পাশাপাশি থাকলে লাল আর সবুজের তফাত অনেক সময় ধরতে পারতেন না তিনি। সাধে ‘ছিন্নপত্রাবলী’তে ভাইঝি ইন্দিরাকে লিখেছিলেন, ‘আমার মতো সুবিখ্যাত রঙকানা লোক...।”
দুই দশক আগে এই আবিষ্কার অভূতপূর্ব সাড়া ফেলেছিল সারস্বত সমাজে। কেতকী এবং সুশোভনের বই তখন ‘আনন্দ পুরস্কার’-এ সম্মানিতও হয়েছিল। কিন্তু সেই আবিষ্কার আজও এতটাই অম্লান যে, রবীন্দ্রনাথের সার্ধশতবর্ষে ‘অপথালমোলজিকাল সোসাইটি অব ওয়েস্ট বেঙ্গল’-এর বার্ষিক সম্মেলনে চিকিৎসকেরা মুগ্ধ ভঙ্গিতে শুনলেন কেতকী ও সুশোভনের বক্তৃতা। রবীন্দ্রবিশেষজ্ঞ বা চিত্ররসিকেরা নন, চিকিৎসকেরা এ দিন হাততালিতে অভিনন্দন জানালেন তাঁদের।
কিন্তু আর্ট কলেজের ওই নকল ছবিগুলিতেও কিন্তু রং-কানার আদল! প্রশ্ন তুলতেই হাসছেন কেতকী, “হ্যাঁ, যে নকল করেছিল, আমাদের বইটা খুব ভাল ভাবে পড়েছিল।” চিত্রশিল্পী ক্লদ মোনে-র চোখে ছানি পড়ার পর তাঁর ছবির ব্যাকরণ কী ভাবে বদলে গেল এবং সেটাই হয়ে উঠল ‘এক্সপ্রেশনিস্ট’ রীতি, তা নিয়ে বিদেশে লেখালেখি হয়েছে অনেক। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের ছবিকে কেতকী এবং সুশোভনই সেই পরিণত বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিতে প্রথম দেখেছিলেন। এ দিনও সুশোভন বিভিন্ন স্লাইড-প্রোজেকশনে দেখালেন, পেরু বা আফ্রিকার আদিবাসী শিল্প কী ভাবে রবীন্দ্রনাথের আঁকায় প্রভাব ফেলেছিল। কী ভাবে বিভিন্ন ‘উডকাট’-এর গড়নকে তিনি আত্মস্থ করে নিয়েছেন নিজের সৃষ্টিতে। নিজের ‘রং-কানা’ দুর্বলতা সম্পর্কে সচেতন ছিলেন বলেই তো ভাইপো অবনীন্দ্রনাথ এবং গগনেন্দ্রনাথকে উৎসাহ দিলেও প্রথাগত অঙ্কনশিক্ষায় কোনও দিন ঢোকেননি রবীন্দ্রনাথ। শুধুই ছবি? তাঁর বিভিন্ন লেখা কাটাছেঁড়া করে কেতকী এ দিনও দেখালেন, রবীন্দ্রনাথ লালের বদলে বেশির ভাগ সময় ‘রাঙা’ আর সবুজের বদলে ‘শ্যামল’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন। লাল ক্রমশ তাঁর কাছে ধূসর যন্ত্রণা হয়ে আসে, ‘মোর বিরহবেদনা রাঙানো কিংশুক রক্তিমরাগে।’
কিন্তু এ সবই তো বিশুদ্ধ অ্যাকাডেমিক চর্চা! কেতকী তো কোদালকে কোদাল বলতে ছাড়েন না! কয়েক বছর আগে ‘তিসিডোর’ উপন্যাসে সাফ দেখিয়েছিলেন, বুদ্ধদেব বসুর সাফল্যে জীবনানন্দ বেশ ঈর্ষান্বিত ছিলেন। এমনকী জীবনানন্দের ব্যর্থ এবং রিক্ত ক্লান্তির কারণেই তাঁর স্ত্রী অসুস্থ হয়ে পড়েন। ফলে কেতকীকে প্রশ্নটা করে ফেলাই গেল।
শঙ্খ ঘোষ, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়রা না-হয় ছবি আঁকার লোক নন। কিন্তু ই-মেলে ছবি দেখে আপনাদের যে কথাটা মনে হল, আর্ট কলেজের অধ্যক্ষ দীপালি ভট্টাচার্য এবং চিত্রশিল্পী যোগেন চৌধুরীর এক বারও মনে হল না! কেন? “ওটাই সমস্যা। এখানে অন্য সব কিছু বেশি হয়। শুধু জ্ঞানের চর্চাটাই কমে গিয়েছে,” ফের হাসলেন অক্সফোর্ডবাসিনী বাঙালি সাহিত্যিক। |