দক্ষিণ কলকাতা তাঁর থাকবে না, তিনি ভাবতেই পারছেন না!
দক্ষিণ কলকাতাও কি আর ভাবতে পারছে, তিনি নেই!
আর তিনি নেই, তা-ই বা কে বলল! শাসক বলুন বা বিরোধী যুযুধান দুই শিবিরের সামনেই তো তিনি। একজন তাঁর ভরসায়। অন্যজন তাঁরই বিরোধিতায়।
তিনি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী। আবার তিনি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। দক্ষিণ কলকাতা লোকসভা কেন্দ্রের টানা পাঁচবারের প্রাক্তন সাংসদ।
সাধে কি তৃণমূলের প্রার্থী সুব্রত বক্সী বলছেন, “গত ২০ বছরের বেশি এই কেন্দ্র তৃণমূল নেত্রীর সাজানো সংসার। প্রতিটি মানুষের সঙ্গে ওঁর পারিবারিক সম্পর্ক। এই কেন্দ্রকে সকলে মিলে সুরক্ষিত করতে হবে। যাতে দুর্বৃত্তরা ছোবল মারতে না পারে!”
আর বিরোধী সিপিএমের তরুণ প্রার্থী ঋতব্রত বন্দ্যোপাধ্যায় বলছেন, কেন্দ্রে কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন সরকারের শরিক হিসেবে পেট্রোলের দাম বিনিয়ন্ত্রণের সিদ্ধান্তে তৃণমূলের ‘সহমত’ পোষণ, কেন্দ্রের একের পর এক ‘জনবিরোধী’ নীতি সমর্থন, রাজ্যের মানুষকে ‘বিভ্রান্ত’ করার কথা। বলছেন, রাজ্যেও ‘পরিবর্তন’-এর সরকারের প্রথম ছ’মাসে একের পর এক ‘জনবিরোধী’ সিদ্ধান্তের কথা। আর তিনি? তিনি কী বলছেন?
দলীয় প্রার্থীর নাম ঘোষণা থেকে প্রচার-সভা, তিনি বলছেন, “বক্সী থাকা মানেই আমি থাকা। আমার কাজগুলোই বক্সীকে দিয়ে করাব।” দক্ষিণ কলকাতার লড়াই যে তাঁরই, তো বোঝাতেই মমতা ভোটারদের কাছে তাঁর ‘আবেদনে’ লিখেছেন ‘আপনাদের বিপুল সমর্থন দিয়ে তৃণমূল প্রার্থীকে দিল্লির দরবারে বাংলার মানুষের কন্ঠস্বরকে জোরালো ভাবে প্রকাশ করার সুযোগ দিন’। |
|
|
ঋতব্রত বন্দ্যোপাধ্যায় ও সুব্রত বক্সী। — নিজস্ব চিত্র |
|
১৯৯১ সালে প্রথম দক্ষিণ কলকাতা থেকে ভোট লড়েছিলেন মমতা। ব্যবধান ছিল ৯৩ হাজারের কিছু বেশি। তারপর দু’টি ভোটে লাফে লাফে ব্যবধান বেড়েছে তাঁর। ১৯৯৯ সালে হাজার দশেক কম হওয়ার পর ২০০৪-এ এক ধাক্কায় মমতার ব্যবধান কমে হয়েছিল সাড়ে ৯৮ হাজার। মনে রাখতে হবে, সেবার এ রাজ্য থেকে একমাত্র তৃণমূল সাংসদ ছিলেন মমতাই।
শেষবার, ২০০৯ সালে আবার ব্যবধান বেড়ে প্রায় ২ লক্ষ ২০ হাজারের কাছাকাছি। তার আগেই সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম আন্দোলন থেকে মমতার ‘রাজনৈতিক পুনরুত্থান’ শুরু। ২০০৯-এর লোকসভা ভোটের সিঁড়ি বেয়ে তাঁর ২০১১ সালে রাজ্যের ক্ষমতাদখল। সেই মঞ্চেই এবারের দক্ষিণ কলকাতার ভোট। যে ভোট আপাতদৃষ্টিতে মমতা-হীন।
কিন্তু তা-ই বা কেন?
দক্ষিণ কলকাতা তো আবার মমতা-হীন হতে পারে না! তিনি সেখানে ছিলেন-আছেন-থাকবেন। কয়েকমাস আগে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর উপ নির্বাচনে জিতে বিধায়ক হতে মমতা বেছেছিলেন দক্ষিণ কলকাতার লোকসভারই অন্তর্গত ভবানীপুর বিধানসভা কেন্দ্রকে। রেকর্ডসংখ্যক কম ভোট পড়েছিল। তা-ও রেকর্ড ভোটে জিতেছিলেন মমতা। ভবানীপুরের পর দক্ষিণ কলকাতাতেই কিন্তু সামনে মমতাই। সুব্রতবাবু স্রেফ ‘কাগজে-কলমে’। যা বিলক্ষণ জানেন একদা রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের চাকুরে এবং মমতার কথাতেই সেই ‘নিশ্চিন্ততা’ ছেড়ে রাজনীতিতে-নামা তৃণমূলের রাজ্য সভাপতি সুব্রতবাবুও। যিনি এতদিন বিধায়ক থেকে এই প্রথম লোকসভায় লড়তে নেমেছেন।
লড়তে নেমেইছেন শুধু। আসলে দরজা আগলাতে নেমেছেন মমতা-দুর্গের।
এই দুর্গে দাঁত ফোটানো যে কঠিন, সম্যক জানেন বাম যুবনেতা ঋতব্রতও। তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী রাজ্যের মন্ত্রী সুব্রতবাবুর বিরুদ্ধে একটি কথাও বলছেন না সাউথ পয়েন্ট স্কুলের প্রাক্তনী। তাঁর নিশানায় এক এবং একমাত্র মমতা। কিন্তু সোস্যাল নেটওয়ার্কিং সাইট, টুইটারেও প্রচার চালানোর পাশাপাশি (বস্তুত, তৃণমূল বলছে, ঋতব্রতর মিছিল-মিটিংয়ে যা লোক হচ্ছে, তার চেয়ে ফেসবুকে তাঁর বন্ধুর সংখ্যা বেশি) এসএফআইয়ের সাধারণ সম্পাদক ঋতব্রতের ছাপানো প্রার্থী পরিচয় বেরিয়েছে ভোট-বাজারে। যেখানে তাঁর প্রতিপক্ষ সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘ছ’মাসে এমন কোনও কাজ করেননি, যাতে লোকে বুঝবেন তিনি (সুব্রতবাবু) কোন দফতর চালান! তবে নীরবে একটিই কাজ করেছেন পরিবহণ নিগমের ৬ হাজার অবসরপ্রাপ্ত কর্মীদের পেনশনটুকু আটকে দিয়েছেন। অসহায় বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের শেষ সম্বলটুকু কেড়ে, তাঁদের সুইসাইড নোট আর চোখের জল মাড়িয়ে কোটি টাকায় সুসজ্জিত মন্ত্রীদের চেম্বারে যান উনি’।
স্বাধীনতা সংগ্রামী পরিবারের সদস্য, বাংলা-হিন্দি-ইংরেজিতে বলতে অভ্যস্ত (নইলে কি আর তাঁকে টেলিভিশনের টক-শোয়ে নাগাড়ে হাজির করে সিপিএম), আশুতোষ কলেজের প্রাক্তন ছাত্র বছর বত্রিশের ঋতব্রত অবশ্য প্রথম ভোটে দাঁড়িয়ে বুঝতে পারছেন, লড়াইটা কত ‘কঠিন’। মিছিল, রোড-শো বা প্রচারসভা করার সমর্থক কুড়িয়ে-বাড়িয়ে পঞ্চাশ-ষাটের উপরে উঠছে না। কিন্তু ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র না-দমে গিয়ে বলছেন, “গত এক বছরে ১১ বার পেট্রোপণ্যের দাম বেড়েছে। প্রথম ১০ বার তৃণমূল বলেছিল, ওদের অন্ধকারে রেখেই কেন্দ্র দাম বাড়িয়েছে। ১১ তম বারে সমর্থন তোলার হুঁশিয়ারি দিলেন মমতা। তা-ও এই উপ নির্বাচনের দিন ঘোষণা হয়ে গিয়েছিল বলেই!” কলেজে পড়তে পড়তেই সক্রিয় ছাত্র রাজনীতিতে হাতেখড়ি ঋতব্রতের। ভবানীপুরে সিপিএমের আঞ্চলিক কমিটিতে যোগদান। ক্রমশ এসএফআইয়ের কলকাতা জেলা কমিটির সভাপতি থেকে রাজ্যের সহ-সভাপতি পদে উত্তরণ। সেখান থেকে আলিমুদ্দিনের সিদ্ধান্তে সংগঠনের সর্বভারতীয় সম্পাদক হয়ে দিল্লি গমন।
কাকতালীয়। কিন্তু বিপ্লবী পরিবারে বেড়ে ওঠা সুব্রতবাবুও আশুতোষ কলেজে বিজ্ঞান শাখায় পড়ার সময়ই জড়িয়ে পড়েছিলেন ছাত্র রাজনীতিতে। হাজরা আইন কলেজের পাঠ শেষ করার পর টানা চার বছর রাজ্য যুব কংগ্রেসের সম্পাদক। তখনই যুবনেত্রী মমতার সান্নিধ্যে এবং তাঁর ‘বিশ্বস্ত সহকর্মী’। যিনি প্রচারমঞ্চে বলছেন, “এই কেন্দ্রের মানুষদের নিয়েই মুখ্যমন্ত্রীর উন্নয়নমুখী বাংলা গড়ার কাজে সামিল হতে চাই।”
সুব্রতবাবুর জয় নিয়ে সন্দেহ নেই তৃণমূল শিবিরে। মমতা নিজে তো বটেই, মুকুল রায়, শুভেন্দু অধিকারী, ফিরহাদ হাকিমের মতো তাবড় নেতারা প্রচারে নেমেছেন তাঁর হয়ে। এতদিন মমতার বিরুদ্ধে সিপিএম প্রার্থী করত প্রশান্ত শূর বা রবীন দেবের মতো ‘প্রবীণ’ রাজনীতিকদের। সে দিক দিয়ে ঋতব্রত ভোট-রাজনীতিতে ‘অনভিজ্ঞ’ তো বটেই। যার সূত্রে শাসক শিবির ইতিমধ্যেই প্রশ্ন তুলেছে, গত পাঁচ-ছ’বছর ধরে দিল্লিবাসী যুবনেতাকে প্রার্থী করা কি লড়াইয়ের আগেই হার স্বীকার সিপিএমের? আলিমুদ্দিনের অবশ্য ব্যাখ্যা, যুবনেতাদের সংসদীয় রাজনীতিতে নিয়ে আসার জন্য ভেবেচিন্তেই ঋতব্রতকে ভোট-ময়দানে নামানোর সিদ্ধান্ত। ঠিক যে ভাবে এসএফআইয়ের সর্বভারতীয় সভাপতি পি কে বিজু-কে কেরলে লোকসভার প্রার্থী করেছিল সিপিএম পলিটব্যুরো। আলাথুর কেন্দ্র থেকে জয়ী হয়ে তিনি অবশ্য এখন সাংসদ।
আগামী বুধবারের ভোটে তা হলে সুব্রতবাবু নিশ্চিন্ত তো?
অবশ্যই! দাবি তৃণমূল শিবিরের। যে শিবিরের একাংশ অবশ্য হাল্কাচালে বলছে, “বক্সী’দার চিন্তা একটাই দিদির চেয়ে মার্জিন আবার বেশি না-হয়ে যায়!” কে বলে দক্ষিণ কলকাতা মমতা-হীন! |