|
|
|
|
ইন্ডোরের সভায় কংগ্রেসের তোপ, জবাব দিল তৃণমূলও |
নিজস্ব সংবাদদাতা • কলকাতা |
কেউ বললেন, “কংগ্রেস ভিক্ষাবৃত্তি করবে না।”
কেউ বললেন, “কংগ্রেস কর্মীদের উপর অত্যাচার হলে প্রতিবাদে নামবই।”
কেউ বললেন, “১৯ জন সাংসদের জন্য ইউপিএ-২ সরকারের পতন হবে না। হুমকি দেবেন না!”
কেউ বললেন, “রাজ্যে পরিবর্তন কি শুধু ঝান্ডারই পরিবর্তন?”
কেউ আরও এক বার বললেন, “এ রাজ্যে কংগ্রেস ভিআরএস নেয়নি। সন্ন্যাসও নেয়নি। আমরা এনজিও-ও নই!”
তার কিছু ক্ষণের মধ্যেই ‘পাল্টা’ এল।
কেউ বললেন, “গা-গরম করা কথা বলে লাভ নেই।”
কেউ বললেন, “এই সঙ্কীর্ণ রাজনীতিতে সিপিএম উৎসাহিত হবে।”
কেউ বললেন, “জেলায় কংগ্রেস যেমন আচরণ করছে, তেমনই পাল্টা আচরণ করবে তৃণমূলও।”
কেউ বললেন, “উনি সিপিএমের ফাঁদে পা-দিয়ে তৃণমূলের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসের অভিযোগ তুলছেন!”
রবিবারের রাজ্য-রাজনীতি দেখল জোট সরকারের দুই শরিক কংগ্রেস এবং তৃণমূলের মধ্যে এই অভিযোগ, পাল্টা-অভিযোগের ধারাবিবরণী। গত কিছু দিন দুই শরিকের পরস্পরের প্রতি মন্তব্যে শাসক শিবির উত্তপ্ত ছিল। এ দিন নেতাজি ইন্ডোরে কংগ্রেসের পঞ্চায়েতিরাজ সম্মেলনে দলীয় নেতাদের তৃণমূল সম্পর্কে খুল্লমখুল্লা মন্তব্যে পরিস্থিতি আরও ‘জটিল’ হলে বলেই ধারণা শাসক শিবিরের একাংশের। তবে অন্য অংশের ধারণা, জোট ভাঙার মতো চূড়ান্ত কিছু হবে না। জোট রাখাটা উভয়েরই ‘রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতা’। উভয়কেই দেখতে হবে, যাতে সিপিএম ‘ফায়দা’ না-পায়। যে কারণে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী জয়রাম রমেশ তৃণমূলের সমালোচনা করেও কেন্দ্র ও রাজ্যে ‘সুসম্পর্ক’ রেখে ভাল কাজ করার কথা বলেছেন। আবার পঞ্চায়েত ভোটে জোট হওয়া নিয়ে যে প্রশ্ন উঠেছে, তা নিয়ে এআইসিসি-র সাধারণ সম্পাদক ও পশ্চিমবঙ্গের ভারপ্রাপ্ত শাকিল আহমেদ বলেছেন, “পঞ্চায়েত ভোটে জোট হবে কি না, তা স্থির করবেন প্রদেশ কংগ্রেস ও স্থানীয় নেতৃত্ব। তবে খেয়াল রাখতে হবে সিপিএম ফায়দা তুলতে না পারে।” |
|
হাল্কা মেজাজে। রবিবার ইন্ডোরে প্রণব ও জয়রাম। ছবি: দেবাশিস রায় |
কংগ্রেস নেতাদের মধ্যে যাঁদের সঙ্গে তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সম্পর্ক ‘বন্ধুত্বপূর্ণ’ নয়, তাঁরাই কেউ মমতার নাম করে, কেউ না-করে তাঁকে কড়া আক্রমণ করেছেন। মমতা নিজে তার কোনও প্রতিক্রিয়া দেননি। সামনে এগিয়ে দিয়েছেন দলের মন্ত্রী শিশির অধিকারীকে (তৃণমূলের একাংশের ধারণা, শিশিরবাবু এবং তাঁর সাংসদ-পুত্র শুভেন্দু কংগ্রেসের প্রতি ঈষৎ ‘দুর্বল’। তাই দলনেত্রী তাঁদের দিয়েই কংগ্রেসকে দুরমুশ করার প্রাথমিক কাজটুকু এ দিন সেরেছেন বলে দলের একাংশ মনে করছেন)। শনিবার পশ্চিম মেদিনীপুর সফরে গিয়ে যাঁর সামনেই কেন্দ্রীয় মন্ত্রী জয়রাম রমেশ বলেছিলেন, “কংগ্রেস এ রাজ্য থেকে ভিআরএস নেয়নি!”
এ দিন নেতাজি ইন্ডোরে আরও এক ধাপ এগিয়ে জয়রাম বলেন, “আমরা এনজিও (স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন) নই। আবার সন্ন্যাসও নিইনি। কংগ্রেস একটি রাজনৈতিক দল। কংগ্রেস কারও উপদেশ শুনবে না। আমরা জানি, কংগ্রেস কী ভাবে চলবে! আমাদের এক্তিয়ার কতটা, তা-ও জানি। আমরা জানি, লক্ষ্মণরেখা পার করা কখনও উচিত নয়।”
শনিবার শিশিরবাবু দাবি করেছিলেন, কোনও ‘অভিপ্রায়’ নিয়ে জয়রাম ওই মন্তব্য করেননি। কিন্তু ‘তাৎপর্যপূর্ণ’ ভাবে এ দিন সেই শিশিরবাবুই বলেছেন, ‘‘গা গরম-করা কথা বলে কোনও লাভ নেই। কংগ্রেস এ রাজ্যে অনেক দিনই ভিআরএস নিয়ে বসে আছে! তামিলনাড়ুতে অনেকদিন আগেই নিয়েছে। এখনও ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। এখানেও পারবে না। কারণ, জনগণই কংগ্রেসকে ভিআরএস দিয়ে দিয়েছে। এনজিও খুলবেন কী ভাবে? এনজিও খুলতে গেলে আগে রেজিস্ট্রেশন করাতে হয়। তা কি হয়েছে!”
এ দিনের সম্মেলনে গোড়া থেকেই কংগ্রেসের অধিকাংশ নেতা তৃণমূলের বিরুদ্ধে সরব ছিলেন। ‘স্বাগত ভাষণে’ জলপাইগুড়ির বিধায়ক দেবপ্রসাদ (মিঠু) রায় তৃণমূলের নাম না-করে বলেন, রাজ্যে শুধু ঝান্ডারই ‘পরিবর্তন’ হয়েছে। তাঁর পরেই প্রধান বক্তা দলের প্রবীণ নেতা তথা কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায় মমতার পঞ্চায়েত-মডেলের বিরোধিতা করেন। কিন্তু সমালোচনা তুঙ্গে নিয়ে যান অধীর চৌধুরী এবপং দীপা দাশমুন্সি। মুর্শিদাবাদ জেলা কংগ্রেস সভাপতি তথা বহরমপুরের সাংসদ অধীর বলেন, “যাঁরা ভাবছেন কংগ্রেস ভিক্ষাবৃত্তি করে বেঁচে থাকবে, তাঁরা ভুল ভাবছেন!” কংগ্রেসকে ‘ফিনিক্স পাখি’র সঙ্গে তুলনা করে, তৃণমূলের সঙ্গে জোট করতে গিয়ে আসন রফার প্রশ্নে কংগ্রেসের ‘মহানুভবতা’র কথা উল্লেখ করে অধীর বলেন, “কংগ্রেসের মহানুভবতাকে কেউ যেন দুর্বলতা না ভাবে।” তাঁর কথায়, “সাধারণ মানুষের অধিকার বিঘ্নিত হলে কংগ্রেস তার প্রতিবাদ করবেই। কেন্দ্র টাকা দিচ্ছে। অথচ রাজ্য কাজ করছে না! সে বিষয়ে বলতে গেলে যদি কেউ আমাদের সিপিএমের দালাল বলে, তা হলে সিপিএমের দালাল হয়েই প্রতিবাদ করব!”
মালদহের সাংসদ ও রাজ্য যুব কংগ্রেস সভানেত্রী মৌসম নূরও বলেন, “কংগ্রেস
কর্মীদের উপর কেউ অত্যাচার করলে আমরা প্রতিবাদে নামবই।”
তবে মমতাকে কঠোরতম আক্রমণ করেছেন দীপা। তৃণমূল নেত্রীকে চ্যালেঞ্জ করে দীপা বলেন, “ইমোশনাল ব্ল্যাকমেল আমরা করি না।” পেট্রোলের দামবৃদ্ধি নিয়ে তৃণমূলের ইউপিএ-২ ছাড়ার হুমকির সমালোচনা করে রায়গঞ্জের সাংসদ বলেন, “১৯ জন সাংসদের (তৃণমূলের) হুমকিতে ইউপিএ-২ সরকারের পতন হবে না! হুমকি দেবেন না।” কংগ্রেস না-চাইলে রাজ্যের জোট সরকার থেকে আলাদা হয়ে যাক, মমতার সেই হুমকির জবাবে প্রিয়রঞ্জন-পত্নী বলেন, “কংগ্রেস জোট ছাড়বে না। ছাড়ার প্রয়োজন হলে আপনিই (মমতা) ছাড়বেন। ঠিক যে ভাবে আপনি এনডিএ ছেড়েছিলেন। আপনি প্রয়োজন ফুরোলে কংগ্রেসের দিকে তাকাবেন না।” |
|
প্রণব মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে আলোচনায় ব্যস্ত অধীর-মানস।- নিজস্ব চিত্র |
রায়গঞ্জে এইমসের ধাঁচে হাসপাতাল গড়া নিয়ে কংগ্রেস-তৃণমূলে ‘বিতর্ক’ চলছিলই। এ দিন তা আরও বড় মাত্রা পেয়ে যায়, যখন দীপা উপস্থিত কংগ্রেস কর্মীদের বলেন, “আপনারা ভিক্ষা দিন। আপনাদের ভিক্ষার টাকায় রাজ্য সরকারের কাছ থেকে জমি কিনব। সেই জমিতেই হাসপাতাল হবে। তার পরেও মুখ্যমন্ত্রী যদি না দেন, আমরা উত্তরবঙ্গকে স্তব্ধ করে দেব! ও সব হুমকি-টুমকি দেখাবেন না!”
মুখ্যমন্ত্রী মমতা শরিক কংগ্রেসের জনপ্রতিনিধিদের সময় দেন না বলে অভিযোগ করে দীপা বলেন, “তিন মাস আগে চিঠি পাঠিয়েছি। কংগ্রেসের সাংসদ-বিধায়ক এমনকী প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতিও চিঠি দিয়েছেন। তার উত্তর দেননি। কংগ্রেসের জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে দেখা করার সময় দেন না। অথচ সিপিএমের রেজ্জাক মোল্লার সঙ্গে দেখা করার সময় পান!” তাঁর সতীর্থ নদিয়া জেলা কংগ্রেস সভাপতি শঙ্কর সিংহ মুখ্যমন্ত্রী মমতার সঙ্গে প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেবের তুলনা টেনে বলেন, বুদ্ধবাবুর আমলে বর্ধমানের কাটোয়ায় এক কংগ্রেস কর্মীকে পুলিশ গুলি করে ‘খুন’ করেছিল। সেই অভিযুক্ত অফিসারকে প্রথমে সাসপেন্ড করে তার পর ‘প্রাইজ পোস্টিং’ দেওয়া হয়। শঙ্করের বক্তব্য, “বাংলার প্রথম মহিলা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ক্ষমতায় আসার পরেই নদিয়ার বগুলায় মহিলা কংগ্রেসকর্মী পুলিশের গুলিতে খুন হন। মুখ্যমন্ত্রী অভিযুক্ত দুই অফিসারকে প্রথমে সাসপেন্ড করে পরে কালীগঞ্জ ও তেহট্ট থানার দায়িত্বে বসিয়ে দেন! এ তো বুদ্ধবাবুর মতোই আচরণ!”
এই বিষয়েও পাল্টা প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন শিশিরবাবু। বলেছেন “শীত পড়ছে। অনেক দুর্বল লোক গা-গরম করার জন্য হাত-পা ছুড়ছে। এ সব করে কোনও লাভ নেই!” আর দক্ষিণ কলকাতা লোকসভা কেন্দ্রে তৃণমূল প্রার্থী সুব্রত বক্সীর প্রচারে এসে শিশির-পুত্র শুভেন্দু বলেন, “কংগ্রেস যে সঙ্কীর্ণ রাজনীতি করছে, তাতে সিপিএম উৎসাহিত হবে।” মুর্শিদাবাদের তৃণমূল নেতা তথা রাজ্যের মন্ত্রী সুব্রত সাহা হুমকি দেন, “আমাদের জেলায় কংগ্রেস যেমন আচরণ করবে, তার পাল্টা করবে তৃণমূল।”
মৌসমের সমালোচনা করে জেলার নেত্রী কথা রাজ্যের মন্ত্রী সাবিত্রী মিত্র বলেন, “বামেদের সন্ত্রাস দেখেননি মৌসম। তাই তিনি সিপিএমের ফাঁদে পা দিয়ে তৃণমূলের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসের অভিযোগ তুলছেন।”
ঘটনাচক্রে, এ দিনই মাওবাদী-মার্ক্সবাদী ‘আঁতাত’, বিচ্ছিন্নতাকামী শক্তির সক্রিয়তা এবং নারীদের উপর হিংসার প্রতিবাদে সুবোধ মল্লিক স্কোয়ার থেকে গাঁধীমূর্তির পাদদেশ পর্যন্ত মোমবাতি জ্বালিয়ে মিছিল করে তৃণমূল মহিলা কংগ্রেস। মিছিলে অংশ নেন মুকুলবাবু, তৃণমূল মহিলা কংগ্রেসের রাজ্য সভানেত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য, বিধায়ক মালা সাহা প্রমুখ। তাঁরা কেউই অবশ্য কংগ্রেসের আক্রমণ নিয়ে কোনও কথা বলেননি। যেমন দলীয় সতীর্থদের মতো মমতার সমালোচনার রাস্তায় হাঁটেননি রাজ্যের সেচমন্ত্রী মানস ভুঁইয়া। তিনি বরং বলেন, “কংগ্রেসকে কে গাল দিচ্ছে, আঙুল তুলে কী বলছে, তাতে বয়ে গেল আমাদের! কংগ্রেসকে কংগ্রেসের কাজ করতে হবে।” |
|
|
|
|
|