অর্থ সঙ্কটের জন্য বকেয়া মহার্ঘ ভাতা (ডিএ) দিতে না পারার ‘ক্ষতে’, সামান্য ‘প্রলেপ’ লাগালেন রাজ্যের অর্থমন্ত্রী।
‘অ্যাড হক’ বোনাস ও এককালীন অনুদানের পরিমাণ দ্বিগুণ বাড়িয়ে এবং পুজোর আগেই বেতন কমিশনের সুপারিশ মতো বৃদ্ধির তৃতীয় কিস্তির বকেয়া টাকার অর্ধেক দেওয়ার কথা বুধবার বিধানসভায় ঘোষণা করলেন রাজ্যের অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্র। বকেয়া ‘ডিএ’ না পাওয়ায় ‘হতাশ’ প্রায় সাড়ে ৯ লক্ষ সরকারি কর্মী ও ৪ লক্ষ পেনশনভোগীকে আপাতত এই প্রাপ্তিটুকুই নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হচ্ছে।
রাজ্য সরকারের এই ‘অ্যাড হক’ বোনাস-অনুদান বৃদ্ধির কথা এ দিন বিধানসভায় ঘোষণা করে অর্থমন্ত্রী জানান, রাজ্য সরকারের যে সব কর্মী সব মিলিয়ে মাসে ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত বেতন পান, তাঁদের ‘অ্যাড হক’ বোনাস ১ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে ২,১০০ টাকা করা হল। পেনশনভোগীরা এত দিন উৎসবের সময়ে ৪০০ টাকা করে যে এককালীন অনুদান পেতেন, তা বাড়িয়ে ৮০০ টাকা করা হচ্ছে। রাজ্য সরকারের যে সব কর্মীর মাসিক মোট বেতন ২০ থেকে ২৮ হাজার টাকার মধ্যে, তাঁরা উৎসবের সময়ে বিনা সুদে ২ হাজার টাকা অগ্রিম নিতে পারবেন। আগে এই অগ্রিমের পরিমাণ ছিল ১,০০০ টাকা। অর্থমন্ত্রীর বক্তব্য, বোনাস, অনুদান এবং অগ্রিম মিলিয়ে রাজ্য সরকারের খরচ হবে অতিরিক্ত মোট ৩৫০ কোটি টাকা।
সরকারি এই সিদ্ধান্তে আর্থিক ভাবে কত লাভ হবে রাজ্য সরকারি কর্মীদের?
অমিতবাবু জানান, বোনাস, অনুদান ও বকেয়া মিলিয়ে এক জন ‘গ্রুপ ডি’ কর্মী পাবেন অতিরিক্ত ১০ হাজার টাকা। আর পনেরো বছরের অভিজ্ঞ এক জন ‘ডব্লিউবিসিএস’ অফিসার পাবেন অতিরিক্ত ১৫ হাজার টাকা। তিনি মন্তব্য করেন, “উৎসবের মরসুমে সকলেই আশা করেন, সরকার তাঁর পাশে
দাঁড়াক। মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে আমি সেটাই করেছি। এটা না করলে তাঁদের প্রতি চূড়ান্ত অমানবিকতা দেখানো হত। তাই সরকারের চূড়ান্ত আর্থিক সঙ্কট থাকলেও, যেন তেন প্রকারে কর্মীদের প্রতি মানবিকতা দেখাতে হল।”
কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে, বোনাস বৃদ্ধির ফলে লাভ হল কত জন সরকারি কর্মীর? অর্থ দফতরের এক পদস্থ অফিসারের হিসাবে, যাঁরা ২০ হাজার টাকার কম বেতন পান তাঁদের সংখ্যা মোট কর্মীর ৭ শতাংশের মতো। অর্থাৎ, রাজ্যের প্রায় সাড়ে ৯ লক্ষ সরকারি বেতনভুক কর্মীর মধ্যে বোনাসের আওতায় আসবেন বড় জোর ৬০-৭০ হাজার কর্মী। অর্থাৎ, কর্মীদের সিংহ ভাগই বাড়তি বোনাসের সুবিধা হাতে পাবেন না। এ বাবদ রাজ্য সরকারের খরচও হবে অনেকটা কম।
রাজ্যের অর্থমন্ত্রী অবশ্য বিষয়টিকে এ ভাবে দেখতে নারাজ। তাঁর কথায়, “কর্মীদের একেবারে নিচুতলার অংশটি (গ্রুপ ডি কর্মী এবং গ্রুপ সি-র একটি অংশ) বোনাস ও অনুদান পাবেন। পরের ধাপের (২০ থেকে ২৮ হাজার টাকা বেতন) কর্মীরা বিনা সুদে অগ্রিম নেওয়ার সুযোগ পাবেন। কিন্তু যাঁরা এর কোনওটাই পাবেন না, মূলত তাঁদের কথা ভেবেই বকেয়ার অর্ধেক দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী চেয়েছেন, এই উৎসবের মরসুমে সকলেই অন্তত কিছু টাকা হাতে পান। সেই মতো সবাই কিছু পাবেন। সবাই কিছুটা আত্মত্যাগও করলেন।”
সরকারি কর্মীদের একাংশের বক্তব্য, বকেয়া ‘ডিএ’ দেওয়া হলে তাঁদের মাসে গড়ে ৩ হাজার টাকা করে বেতন বাড়ত। সেটা না পাওয়ায় তাঁরা ‘হতাশ’। একই ভাবে তৃতীয় কিস্তির বকেয়া টাকার অর্ধেক দেওয়াকে ভাল চোখে দেখছেন না সরকারি কর্মীদের একটি বড় অংশই। কারণ, আগের দু’টি কিস্তির টাকা এক লপ্তেই পেয়েছেন তাঁরা। এ বারেও তাঁরা আশা করেছিলেন, সেই টাকার
পুরোটাই দেওয়া হবে। এই বকেয়া টাকার পুরোটা দিতে পারলে ভাল হত, বলে মনে করেন খোদ অর্থমন্ত্রীও। কিন্তু আর্থিক সঙ্কটের কারণেই যে তা সম্ভব হল না, সে কথা জানিয়েছেন অমিতবাবু।
তবে বকেয়া মেটানোর সঙ্গে ডিএ-কে এক করে দেখতে চান না অর্থমন্ত্রী। কারণ, ডিএ দিতে হলে যে আর্থিক বোঝা রাজ্যের ঘাড়ে চাপবে, এখনই তা দেওয়ার মতো অবস্থা নেই বলে সাফ জানিয়েছেন তিনি। অর্থমন্ত্রী জানান, গত বছরের জুলাইয়ে ১০% এবং এ বছরের জানুয়ারিতে ৬% ডিএ ঘোষণা করেছে কেন্দ্র। সব মিলিয়ে ১৬% ডিএ বাকি রয়েছে রাজ্য সরকারি কর্মীদের। কিন্তু ১% ডিএ দিতে হলে মাসে খরচ হবে আরও ২৫ কোটি টাকা। সেই হিসাবে ১০% দিতে হলে রাজ্যের এক মাসে খরচ হবে ২৫০ কোটি টাকা। তা হলে সেপ্টেম্বর মাস থেকে আগামী মার্চ পর্যন্ত সাত মাসে এ বাবদ রাজ্যের অতিরিক্ত খরচ হবে ১৭৫০ কোটি টাকা। একই ভাবে ৬% ডিএ দিতে হলে সাত মাসে অতিরিক্ত খরচ হবে ১০৫০ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে ১৬% ডিএ দিতে রাজ্যের মোট খরচ হবে ২৮০০ কোটি টাকা। অর্থমন্ত্রী মন্তব্য করেন, “বোনাস-অনুদান-বকেয়ার ৮৫০ কোটি খরচের সঙ্গে ডিএ বাবদ এই বিপুল পরিমাণ অর্থ খরচ করা এখন রাজ্যের পক্ষে সম্ভব নয়। তা ছাড়া, বোনাস বা বকেয়া মেটানোর জন্য খরচ হবে এক বারই। কিন্তু ডিএ তো তা নয়। সেটা দিতে গেলে খরচ বাড়বে প্রতি মাসেই।”
সরকারের এই ব্যাখ্যা সম্পর্কে কী ভাবছে কর্মী সংগঠনগুলি?
বাম-প্রভাবিত রাজ্য কো-আর্ডিনেশন কমিটি সম্পাদক অনন্ত রায় সরকারের এই বোনাস-অনুদান বৃদ্ধির সিদ্ধান্তকে ‘নাকের বদলে নরুন’ পাওয়ার সঙ্গে তুলনা করেছেন। এ দিন তিনি বলেন, “রাজ্য সরকারের অর্থ সঙ্কট তো নতুন নয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও আমরা প্রতি বছরই কখনও তিন কিস্তি, কখনও দু’কিস্তি বকেয়া ডিএ পেয়েছি। এ বার হঠাৎ এমন কী হল যে রাজ্য সরকারকে ডিএ বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে হল?” অন্য দিকে, তৃণমূলপন্থী সংগঠন ইউনাইটেড স্টেট গভর্নমেন্ট এমপ্লয়িজ ফেডারেশনের নেতা পার্থ চট্টোপাধ্যায় বলেন, “বকেয়া ডিএ না পাওয়ায় আমরা হতাশ হয়েছি ঠিকই, কিন্তু বোনাস বৃদ্ধির এই সিদ্ধান্তে কিছুটা হলেও উপকার হল।” |