|
|
|
|
চারটি চাবি ‘রহস্য’ |
আরও চার দিন সুশান্ত সিআইডি-র হেফাজতে |
নিজস্ব সংবাদদাতা • কলকাতা ও মেদিনীপুর |
সুশান্ত ঘোষকে আরও চার দিন সিআইডি-হেফাজতে রাখার নির্দেশ দিল আদালত। সিআইডি অবশ্য এই সিপিএম নেতাকে সাত দিনের জন্য হেফাজতে চেয়েছিল।
প্রথম দফায় সাত দিনের সিআইডি হেফাজতের শেষে বুধবার মেদিনীপুর সিজেএম আদালতে হাজির করা হয়েছিল গড়বেতার বিধায়ককে। বিচারক মনোজ রাই জানিয়ে দেন, অসুস্থ হয়ে পড়ায় সুশান্তবাবুকে হাসপাতালে ভর্তি করাতে হয়। তাঁকে জেরা করার পুরো সুযোগ সিআইডি পায়নি। মেডিক্যাল রিপোর্ট অনুযায়ী, সুশান্তবাবু এখন সুস্থ। তাই এখন সিআইডি তাঁকে চার দিনের জন্য নিজেদের হেফাজতে রাখতে পারে। আগামী ২০ অগস্ট ফের এই প্রাক্তন মন্ত্রীকে মেদিনীপুর আদালতে হাজির করাতে হবে। |
|
সুশান্ত ঘোষের সঙ্গেই আদালতে হাজির সিপিএম কর্মী কালিদাস চৌধুরী। |
এ দিকে, বর্তমান রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে ‘রাজনৈতিক প্রতিহিংসা’-র অভিযোগ এনে এ দিন সকাল থেকে তিনি অনশন শুরু করেছেন বলে দাবি সুশান্তবাবুর। এই ব্যাপারে দল থেকেই তাঁকে ‘পরামর্শ’ দেওয়া হচ্ছে বলে সিপিএম সূত্রের খবর। রক্তচাপজনিত সমস্যার জন্য নিয়মিত যে ওষুধ খাওয়ার কথা, তা-ও খাবেন না বলেও জানিয়ে দেন সুশান্তবাবু। এই ‘পরিস্থিতি’তে তিনি ফের অসুস্থ হয়ে পড়লে তাঁকে আবার হাসপাতালে ভর্তি করাতে হতে পারে। সে ক্ষেত্রে যে কারণে প্রাক্তন মন্ত্রীকে নিজেদের হেফাজতে চাওয়া হল, সেই তদন্তে বিশেষ সুবিধা হবে না বলেও আশঙ্কা করছেন সিআইডি অফিসারদের একাংশ।
সরকার পক্ষের দুই আইনজীবী দেবাশিস রায় এবং রাজদীপ মজুমদার এ দিন আদালতে যে তথ্য ও নথি পেশ করেন, তার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল বড় আকারের চারটি চাবি। আইনজীবীদের দাবি, সুশান্তবাবুর বাড়ি থেকে পাওয়া ওই চাবিগুলি ঠিক কোথাকার, তা এখনও জানা যায়নি। আদালতে তাঁরা জানান, চাবিগুলি কোনও ‘অস্ত্রাগার’ বা ‘কোষাগার’-এর হতে পারে। এ সব কথা জানার জন্যও সুশান্তবাবুকে আরও জেরা করার প্রয়োজন।
একটি হলুদ রঙের খাতা বিচারকের সামনে পেশ করে সরকারি কৌঁসুলিরা জানান, গণহত্যার দিন, অর্থাৎ ২০০২ সালের ২২ সেপ্টেম্বর সুশান্তবাবু যে পশ্চিম মেদিনীপুরেই ছিলেন, তার ‘প্রমাণ’ হিসাবেই ওই লগ-বুক হাজির করা হয়েছে। আইনজীবীরা জানান, লগ-বুক অনুযায়ী, ২১ এবং ২৩ সেপ্টেম্বরও সুশান্তবাবুকে নিয়ে তাঁর সরকারি গাড়ি পশ্চিম মেদিনীপুরেই ঘোরাফেরা করেছে। বিচারক সেই লগ-বুক খুঁটিয়ে পরীক্ষা করেন। |
|
বুধবার মেদিনীপুর আদালতে সিপিএম নেতা সুশান্ত ঘোষকে হাজির করানোর সময়ে চলে বিক্ষোভ। |
সুশান্তবাবুর বাড়ি থেকে ‘উদ্ধার’ গুলি রাখার ‘পাউচ’, ‘স্পাই-ক্যামেরা’ লাগানো পেন, ‘ওয়াকিটকি’ও আদালতে পেশ করা হয়। দেবাশিসবাবু আদালতকে জানান, বিদেশ থেকে ওই ‘ওয়াকিটকি’ আনতে গেলে যে বিশেষ সরকারি লাইসেন্সের প্রয়োজন, তা সুশান্তবাবুর ছিল না। তাঁর বক্তব্য, “কেন তিনি ওই ‘ওয়াকিটকি’ ব্যবহার করতেন? পুলিশের সিগন্যাল ‘ট্যাপ’ করতে, না অন্য কারণে?” আইনজীবীদের বক্তব্য, দু’দিন জেরার পরে অসুস্থ হয়ে পড়ায় সুশান্তবাবুকে আর জেরা করা সম্ভব হয়নি। তাই তাঁর কাছ থেকে এই মামলা সংক্রান্ত আরও তথ্য পেতে সিআইডি নিজেদের হেফাজতে রাখতে চায়। এই মামলার তদন্তকারী অফিসার পূর্ণশিব মুখোপাধ্যায়ও এ দিন আদালতে উপস্থিত ছিলেন।
হাসপাতাল থেকে সুশান্তবাবুকে ছাড়ার সময়ে যে ‘ডিসচার্জ সার্টিফিকেট’ দেওয়া হয়েছে, তা-ও এ দিন আদালতে পেশ করা হয়। ওই সার্টিফিকেট এবং প্রাক্তন মন্ত্রীর অ্যাঞ্জিওগ্রাম রিপোর্ট অনুযায়ী, তিনি এখন সুস্থ। তাঁর বুকে ব্যথা রয়েছে ঠিকই। তবে তা হৃদ্যন্ত্রের সমস্যাজনিত নয় (নন-কার্ডিয়াক চেস্ট পেন)। আইনজীবীদের দাবি, তাই, সুশান্তবাবুকে জেরা করতে অসুবিধা নেই। এসএসকেএমে তাঁর জন্য মেডিক্যাল বোর্ড বসাতে কেন তিন দিন সময় লেগে গেল, তা নিয়েই বরং প্রশ্ন তুলেছেন সরকারি আইনজীবীরাই।
সুশান্তবাবুর পক্ষের আইনজীবী বিশ্বনাথ ঘোষ, দাশরথি নন্দ এবং বিদ্যুৎ সিংহের দাবি, সিআইডি সাত-আটটি দল বানিয়ে গভীর রাত পর্যন্ত জেরা করে তাঁর উপরে কার্যত ‘মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন’ করা হয়েছে। ‘সেই কারণে’ তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। সিআইডি অফিসারদের দেওয়া ওষুধ খাওয়ার পরে সুশান্তবাবুর মস্তিষ্কের উপরেও ‘চাপ’ পড়ে বলে দাবি করেছেন ওই আইনজীবীরা। তাঁদের বক্তব্য ছিল, ‘অসুস্থ’ সুশান্তবাবুকে এই অবস্থায় পুলিশ বা জেল হেফাজতে রাখা ঠিক হবে না। এমনকী, তাঁর জীবনহানির মতো গুরুতর সমস্যা দেখা দিলে তার দায়িত্ব কে নেবেসে প্রশ্নও তোলেন আইনজীবীরা। বিশ্বনাথবাবু আদালতে বলেন, “কলকাতা, গড়বেতা, বেনাচাপড়া--প্রাক্তন মন্ত্রীর সব বাড়িতে তল্লাশি চালিয়েছে সিআইডি। সুশান্তবাবুর যা বলার, তিনি বলেও দিয়েছেন। এর পরেও কোন উদ্দেশ্যে তাঁকে সিআইডি হেফাজতে চাইছে?” তাঁরা আরও বলেন, যে ‘স্পাই-ক্যামেরা’-সহ পেন দেখিয়ে প্রাক্তন মন্ত্রীকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে চাইছে সিআইডি, তা কলকাতার ফুটপাথে তিন হাজার টাকায় কিনতে পাওয়া যায়। বুধবার সকাল থেকে যে সুশান্তবাবু কিছু খাচ্ছেন না, সে কথাও আদালতে জানান।
বুধবার সকাল থেকেই মেদিনীপুর আদালত চত্বরের দখল নিয়ে নেয় পুলিশ। সুশান্তবাবুর বিরুদ্ধে বিক্ষোভ দেখাতে এ দিন আদালত চত্বরে বেশ কিছু তৃণমূল সমর্থক জড়ো হয়েছিলেন। তাঁদের কাউকেই সুশান্তবাবুর ধারেকাছে ঘেঁষতে দেয়নি পুলিশ। আদালত থেকে তাঁকে নিয়ে আসা ও যাওয়ার সময়ে অবশ্য ‘টিপ্পনী’ উড়ে আসে জনতার মধ্যে থেকে। আদালতকক্ষেও তিলধারণের জায়গা ছিল না।
এ দিন আদালতে হাজির করানো হয় হাড়গোড়-কাণ্ডে ধৃত আর এক সিপিএম নেতা কালিদাস চৌধুরীকেও। তাঁকে মঙ্গলবার কেশপুরের খেতুয়া থেকে ধরা হয়। কালিদাসবাবুর আইনজীবী জানান, ২০০২ সালে ওই ‘হামলা’র সময়ে তাঁর মক্কেল চিকিৎসার কারণে রাজ্যের বাইরে ছিলেন। তাঁর ‘ব্রেন টিউমার’ হয়েছিল। এই ‘কাণ্ডের’ সঙ্গে তাঁর কোনও যোগ নেই। বিচারক অবশ্য কালীদাসবাবুকেও ৩ দিনের জন্য সিআইডি-হেফাজতে রাখার নির্দেশ দেন।
এ দিন মামলাটি নিয়ে বুধবার সন্ধ্যায় সিপিএমের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর বৈঠকে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। সেখানে ঠিক হয়েছে, রাজ্য সরকার যে সুশান্তবাবুকে ‘মিথ্যে মামলায় ফাঁসিয়েছে’, তার বিরুদ্ধে কয়েক দিনের মধ্যে জেলায় জেলায় প্রতিবাদ মিছিল ও সভা করবে দল। চিকিৎসকের আপত্তিকেও সরকার আমল দিতে চাইছে না, এটাও প্রচারে আনতে চাইছে তারা। সিপিএম নেতৃত্বের ধারণা, কঙ্কাল-কাণ্ডে সুশান্তবাবুকে দোষী সাব্যস্ত করা কঠিন বুঝেই অন্যান্য মামলায় তাঁকে জড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। প্রয়োজনে হাইকোর্ট-সহ উচ্চতর আদালতে পর্যালোচনা আবেদন দাখিল করার জন্য আইনজীবীদের পরামর্শ নেওয়া হচ্ছে।
|
ছবি তুলেছেন সৌমেশ্বর মণ্ডল। |
|
|
|
|
|