|
|
|
|
তিনি অনশনে, দাবি প্রাক্তন মন্ত্রীর |
১৩ নয় ৩০ ঘণ্টা জেরা, আঙুল উঁচিয়ে কৌঁসুলিকে অধৈর্য সুশান্ত |
সুনন্দ ঘোষ • মেদিনীপুর |
১৩ নয়, ‘৩০ ঘণ্টা’ টানা জেরা করেছে সিআইডি। এমনটাই দাবি প্রাক্তন মন্ত্রীর। কিন্তু তাঁর পক্ষের কৌঁসুলি তো আদালতে ‘অন্য কথা’ বলছেন। ‘অগত্যা’ গারদের ভিতর থেকে তর্জনী উঁচিয়ে ‘ডাকাবুকো’ নেতা ‘স্বভাবসুলভ ভঙ্গি’তে আইনজীবীর উদ্দেশে বলে উঠলেন, “এত বার বললাম, আমায় একটানা ৩০ ঘণ্টা জেরা করেছে, সে কথা এক বারও তো বললেন না!”
সেই লহমায় মনে হতে পারে জায়গাটা মেদিনীপুরের আদালত-কক্ষ নয়, গড়বেতার কোনও সিপিএম কার্যালয়। কঙ্কাল-কাণ্ডে ধৃত প্রাক্তন মন্ত্রী নন, তিনি দোর্দণ্ডপ্রতাপ, গড়বেতার ‘একচ্ছত্র’ নেতা সুশান্ত ঘোষ। কিন্তু ততক্ষণে বিচারক তাঁর সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিয়েছেন। চার দিনের জন্য আবার তাঁকে থাকতে হবে সিআইডি-র হেফাজতে। একটানা জেরা আবার আসন্ন। আবার উঠে আসবে ‘অস্বস্তিকর’ কিছু প্রশ্ন। এক লহমায় যেন সম্বিত ফিরে পান প্রাক্তন মন্ত্রী। তর্জনী নামিয়ে মাথা নিচু করে দু’হাতে আঁকড়ে ধরেন গারদের খাঁচা। |
|
মেদিনীপুর সিজেএম আদালত থেকে বেরোনোর পরে গাড়িতে সুশান্ত ঘোষ।
বুধবারই হাসপাতাল থেকে ছাড়া পান তিনি। ছবি: সৌমেশ্বর মণ্ডল। |
সকাল থেকে খাওয়াও বন্ধ করে দিয়েছেন বলে দাবি প্রাক্তন মন্ত্রীর। মুখ-চোখ বেশ শুকনো। গারদের ভিতর থেকে তাঁর অভিযোগ, “রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার জন্যই আমার দল এবং আমাকে হয়রান ও অপদস্থ করা হচ্ছে। ব্যক্তিগত কুৎসা করা হচ্ছে। পরিবারকে হেনস্থা করা হচ্ছে।” জানালেন, এই ‘পরিস্থিতি’র প্রতিবাদে তিনি এ দিন সকাল থেকে অনশন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এমনকী, স্বাস্থ্যের কারণে নিয়মিত যে ওষুধ খেতে হয়, তা-ও খাবেন না। আদালত থেকে বেরিয়ে সুশান্তবাবু বলেন, “আজ সকালে আমাকে ডিম-কলা-পাউরুটি খেতে দেওয়া হয়েছিল। আমি বলে দিয়েছি, ‘খাব না’। চিকিৎসক অনুরোধ করেছিলেন ওষুধ খাওয়ার জন্য একটা বিস্কুট খেতে। তাই সকালে ওই একটা বিস্কুট খেয়ে ওষুধ খেয়েছি। তার পর থেকে আর কিছুই খাইনি। খাবও না।”
হলুদ রঙের পাঞ্জাবি, ছোট ঘেরের সাদা পাজামা, পায়ে কালো রঙের চপ্পল। বুধবার ঠিক দুপুর সওয়া ২টোয় সুশান্ত ঘোষকে যখন মেদিনীপুরের সিজেএম-এর কক্ষ লাগোয়া ঘরে ঠেলে ঢুকিয়ে দেওয়া হল তখন তাঁর চোখে বিষণ্ণতা। ধস্ত চেহারা। মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। দাঁড়িয়েছিলেন চুপচাপ। তবে তাঁর পক্ষের আইনজীবীদের সঙ্গে দু’-এক বার স্বর নামিয়ে যখন ‘কথা’ বলছিলেন, সেটা শোনাচ্ছিল ‘নির্দেশ’-এর মতো। আইনজীবী বিশ্বনাথ ঘোষের কাছে সুশান্তবাবু বার বার দাবি করছিলেন, “১২ তারিখ (অগস্ট) দুপুর ১২টা থেকে ১৩ তারিখ সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত আমাকে একটানা জেরা করেছে সিআইডি। তার পরেই আমি অসুস্থ হয়ে পড়ি। সেটা আদালতে উল্লেখ করবেন।” কিছু পরে ইশারায় ডেকে নেন আর এক আইনজীবীকে। বলেন, “আমার বাড়ি থেকে যে ম্যান-প্যাক পাওয়া গিয়েছে, তার জন্য আলাদা মামলা করছে ওরা। ওই ম্যান-প্যাক ধর্মতলার ফুটপাথে ৩০০ টাকায় কিনতে পাওয়া যায়।”
বিশ্বনাথবাবু যখন সওয়াল করার সময়ে বলেন, “ওঁকে (সুশান্তবাবুকে) একটানা ১২-১৩ ঘণ্টা করে জেরা করা হয়েছে। তাই উনি অসুস্থ হয়ে পড়েন”, দৃশ্যত ‘ধৈর্যচ্যুতি’ ঘটে সুশান্তবাবুর। গারদের ভিতর থেকে বলে ওঠেন, “বারবার বলতে বললাম যে, ৩০ ঘণ্টা জেরা করা হয়েছে। তার তো রেকর্ডও রয়েছে। তা-ও ১২-১৩ ঘণ্টা কেন বলছেন?” তবে এক বার নয়, এর পরেও আইনজীবীরা ‘১২-১৩ ঘণ্টা জেরা’র উল্লেখ করেছেন। আর একই ভাবে ‘বিরক্ত’ নেতা বিড়বিড় করতে করতে পায়চারি করেছেন গারদের ভিতরে। পরে বিশ্বনাথবাবু বলেন, “আমি বোঝাতে চাইছিলাম, প্রতিদিন ১২-১৩ ঘণ্টা করে জেরা করা হয়েছে সুশান্তবাবুকে।” তাতেও তো সুশান্তবাবুর ‘হিসেব’ থেকে ঘণ্টা চারেকের ফারাক হচ্ছে? স্পষ্ট ব্যাখ্যা মেলেনি ওই আইনজীবীর কাছ থেকে।
সুশান্তবাবুকে আদালত কক্ষের গারদে নিয়ে আসার মিনিট দশেক পরে সেখানে আনা হয় ওই মামলারই আর এক অভিযুক্ত কালিদাস চৌধুরীকে। গারদের ভিতরে ঢুকে কালীদাসবাবু যেন কিছুটা সম্ভ্রম দেখিয়ে সুশান্তবাবুর পাশে গিয়ে দাঁড়ান। সুশান্তবাবু তাঁকে জিজ্ঞাসা করেন, “তোমাকে কবে ধরল?” কালীদাসবাবু বলেন, “গত কাল।” সুশান্তবাবুর প্রশ্ন, “কোথা থেকে?” কালিদাসের জবাব, “বাড়ি থেকে।” এর পরে গলা খাদে নামিয়ে কিছু কথা হয় দু’জনের। বাইরে থেকে মাঝেমধ্যেই ভেসে আসছিল স্লোগান। বোঝা যাচ্ছিল, ধৃত প্রাক্তন মন্ত্রীর নামে ‘বিষোদ্গার’ হচ্ছে। এক বার উদাসীন দৃষ্টিতে বাইরের দিকে তাকিয়ে আবার চোখ সরিয়ে নেন প্রাক্তন মন্ত্রী। প্রথম দিকে অনেক ক্ষণ তাকিয়েছিলেন বিচারকের আসনের দিকে। তখনও বিচারক মনোজ রাই আদালত কক্ষে ঢোকেননি। সুশান্তবাবু ঢোকার প্রায় ১৫ মিনিট পরে বিচারক আসেন। অন্য দু’-একটি মামলার শুনানি চলছিল। এই সময় কালিদাসবাবুকে নিয়ে সুশান্তবাবু খানিকটা পিছিয়ে জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়ান। হাত দু’টো পিছনে করে সেখানে দাঁড়িয়েছিলেন অনেক ক্ষণ। পৌনে ৩টে নাগাদ কঙ্কাল-কাণ্ডের শুনানি শুরু হয়। পিছনে দাঁড়িয়ে মন দিয়ে আইনজীবীদের বক্তব্য শুনছিলেন সুশান্তবাবু। তবে তাঁর পক্ষের আইনজীবীদের সওয়ালের সময়ে গারদের সামনে এসে সেখানে দাঁড়ানো এক আইনজীবীকে কিছু বলে পিছিয়ে যান।
কলকাতার এসএসকেএম হাসপাতাল থেকে এ দিন সকাল ৯টা ২০ মিনিট নাগাদ ছাড়া হয় সুশান্তবাবুকে। মঙ্গলবার স্ট্রেচার বা হেঁটে নামা নিয়ে ‘বিভ্রান্তি’র জেরে ছাড়া হয়নি তাঁকে। এ দিন সব জল্পনার অবসান ঘটিয়ে একটি হুইলচেয়ারে তাঁকে কার্ডিওলজি বিভাগের তিন তলা থেকে নামানো হয়। হুইলচেয়ার থেকে হেঁটেই গাড়িতে ওঠেন প্রাক্তন মন্ত্রী। মঙ্গলবারের ‘বিভ্রান্তি’র একটা ব্যাখ্যা দিয়েছেন সুশান্তবাবুর চিকিৎসার জন্য গড়া মেডিক্যাল বোর্ডের প্রধান চিকিৎসক অরূপ দাস বিশ্বাস। তিনি বলেন, “সাধারণ রোগীদের ক্ষেত্রে অ্যাঞ্জিওগ্রাফির ৬ ঘণ্টা পরেই আমরা হাঁটাহাঁটির অনুমতি দিই। কিন্তু এ ক্ষেত্রে সিআইডি, পুলিশ, রাজনৈতিক দল মিলিয়ে পরিস্থিতি জটিল হয়ে যাওয়ায়, সে ঝুঁকি নেওয়া হয়নি।” তিনি জানিয়েছেন, সুশান্তবাবুকে পরবর্তী কালে ফের এক বার ‘চেক-আপ’-এর জন্য হাসপাতালে আনার কথা বলা হয়েছে। তাঁর একটি এমআরআই এবং আল্ট্রাসনোগ্রাফি করার পরামর্শও দেওয়া হয়েছে।
এসএসকেএম থেকে সুশান্তবাবুকে সোজা নিয়ে যাওয়া হয় খড়্গপুরে। সেখানে সিআইডি অফিস ঘুরে প্রায় এক ঘণ্টা তাঁকে বসিয়ে রাখা হয় খড়্গপুর লোকাল থানায়। থানার ওসি-র ঘরে একটি চেয়ারে চুপ করে বসেছিলেন তিনি। সেখানে জল খেতে দেওয়া হয় তাঁকে। তিনি খাননি। সিআইডি অফিসারদের উদ্দেশে বলেন, “জল খাওয়াও তো খাওয়া। আমাকে আপনারা অনুরোধ করবেন না। প্রয়োজন হলে আমি চেয়ে খেয়ে নেব।”
খড়্গপুর থেকে তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় মেদিনীপুর আদালতে। আদালত রায় শোনায় দুপুর ৩টে ২৫ মিনিটে। তারও মিনিট দশেক পরে তাঁকে আদালত থেকে বার করে গাড়িতে চাপিয়ে প্রথমে নিয়ে যাওয়া হয় মেদিনীপুর পুলিশ লাইনে এবং পরে খড়্গপুর লোকাল থানায়। থানা চত্বরে ঘণ্টাখানেক গাড়িতেই বসিয়ে রাখা হয় তাঁকে। তার পরে সুশান্তবাবুকে নিয়ে কলকাতার দিকে রওনা হয় সিআইডি-র দল। মেদিনীপুর আদালত চত্বর ছেড়ে বেরনোর সময় প্রাক্তন মন্ত্রীকে ঘিরে ধরেছিলেন সাংবাদিকেরা। ‘বিধ্বস্ত’ সুশান্ত বলে যান, “আমার রক্তচাপ ওঠানামা করছে। তবুও আমাকে সিআইডি হেফাজতে পাঠানো হল!”
|
অতিরিক্ত প্রতিবেদন: পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায়। |
|
|
|
|
|