|
|
|
|
প্রবন্ধ ১... |
মা, মাটি, মাফিয়া: জমি, বাজার ও রাষ্ট্র |
সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের গরম হাওয়ায় তৃণমূলের নেতারা মসনদ দখল করে থাকতে পারেন, কিন্তু সময়
এসেছে তাঁদের জমি অধিগ্রহণ নিয়ে ঠান্ডা মাথায় একটু নতুন ভাবে চিন্তা করার।
প্রণব বর্ধন |
পশ্চিমবঙ্গে বাম রাজত্বের পতনের নানাবিধ কারণের মধ্যে দুটিকে প্রধান বলে মনে হয়, যা বাম দলে দিল্লির শীর্ষনেতাদের নির্বোধ গোঁড়ামির চেয়েও অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এক, দলতন্ত্রের প্রতাপ আর তোলাবাজির দৌরাত্ম্যে সাধারণ মানুষ তিতিবিরক্ত হয়ে পড়েছিলেন। দুই, জমি অধিগ্রহণের ব্যাপারে বাম শাসকদের প্রতি জনরোষ। এই শেষোক্ত জনরোষ নিয়ে ভেবে দেখলে চারটি বিভিন্ন জিনিসের কথা প্রথমেই মনে আসে। ক) অধিগৃহীত জমির জন্য বামফ্রন্ট সরকার যে ক্ষতিপূরণ দিচ্ছিল তা অধিগ্রহণ সংক্রান্ত ঔপনিবেশিক আইনের তুলনায় কিছু বেশি হলেও আজকের দিনে অনেক চাষির পক্ষে একদমই যথেষ্ট নয়।
খ) সাধারণ মানুষের সঙ্গে ধৈর্য ধরে আলাপ-আলোচনার পরিবর্তে শাসক দলের চেলাদের ও তাদের তাঁবেদার পুলিশের অত্যধিক ও এলোমেলো বলপ্রয়োগ। গ) যদিও বিশ্বময় রটে গেছে যে, নন্দীগ্রাম জমি অধিগ্রহণের সংগ্রামের এক রক্তাক্ত মাইলফলক, আসলে কিন্তু সরকার ওখানে অনেক আগেই ঘোষণা করে দিয়েছিল যে কোনও জমি অধিগ্রহণ করা যাবে না। গ্রাম বাংলায় দুই দলের গুন্ডাদের এলাকা দখলের যে রক্তাক্ত লড়াই চলছে কিছু দিন ধরে, নন্দীগ্রাম বরং তার ইতিহাসে একটি মাইলফলক। রাজ্যব্যাপী এই গুন্ডাবাজি বন্ধ করার ব্যাপারে বামফ্রন্ট সরকারের চূড়ান্ত অক্ষমতা জনরোষের একটি বড় কারণ। ঘ) নন্দীগ্রামের মতো নানা অঞ্চলে, যেখানে শিক্ষার অনগ্রসরতায় সরকারের অবহেলা প্রকট, সেখানে চাষি পরিবার সঙ্গত কারণেই ভাবতে পারে যে, নতুন কারখানা হলেও তাতে কাজ পাওয়ার মতো ন্যূনতম যোগ্যতা তাদের ছেলেমেয়েদের নেই। তাই জমি হারাবার ভয় তাদের খুব বেশি।
জনরোষের এই বিশ্লেষণে যদি কিছুমাত্র যথার্থতা থাকে তবে আমি বলব যে, বাম দলের কিছু গোষ্ঠী এবং বিশেষ করে শাসক তৃণমূল জমি অধিগ্রহণের ব্যাপারে নির্বাচনের ফলাফল থেকে ভুল শিক্ষা নিচ্ছে, এবং তার ফলে এখন পশ্চিমবঙ্গের অর্থনৈতিক জগতে বড় রকমের ক্ষতির সম্ভাবনা। ঠিক ভাবে জমি অধিগ্রহণ করলে মানুষের আপত্তি অনেক কম হবে। |
|
বড় প্রশ্ন। ১৮৯৪ সালের জমি অধিগ্রহণ নীতি রদ করার দাবিতে। দিল্লি, ২০১১ |
ঘটনা এই যে, জনসংখ্যার চাপে পশ্চিমবাংলার কৃষিতে মাথাপিছু আয় যে ভাবে কমছে তাতে অনেক জায়গাতেই চাষ করে ন্যূনতম জীবিকা নির্বাহ করা আর সম্ভব হচ্ছে না। তথাকথিত উর্বর জমিতেও নয়। সমীক্ষার তথ্যে দেখা যাচ্ছে যে, চাষি পরিবারের ছেলেমেয়েদের শতকরা চুরাশি জন আর চাষের কাজে থাকতে চাইছে না। মা-মাটি-মানুষের আবেগ দিয়ে কত দিন এদের আটকে রাখা যাবে? উৎপাদন শক্তি যেখানে বেশি, সে সব জায়গায় যথেষ্ট কাজের ব্যবস্থা না-করতে পারলে যুব সম্প্রদায় বিপথে চলে যেতে বাধ্য। গুন্ডাবাজি আর তোলাবাজি বাড়বেই। বাম বা তৃণমূল, যে-ই সিংহাসনে থাকুক।
আমাদের এই ঘনবসতির রাজ্যে শিল্প বা পরিষেবার ক্ষেত্রে কাজের সুযোগ বাড়াতে হলে কৃষি থেকে কিছু জমি নিতেই হবে। যে স্বল্প জমি পড়ে আছে তার অধিকাংশ হয় মামলা-মকদ্দমায় জর্জরিত অথবা সেখানে পরিকাঠামো ব্যবস্থা এত খারাপ যে ব্যবসায়ীরা সহজে যেতে চাইবে না। কৃষিজমি নেওয়ার ব্যাপারে তৃণমূল সরকার গোঁ ধরেছে যে ব্যবসায়ীকে জমি সরাসরি বাজারের মারফত কিনতে হবে, সরকার অধিগ্রহণ করবে না। জমির বাজার অন্য পাঁচটা বাজারের মতো নয়। এখানে ফাটকাবাজরা জমির দাম যখন বাড়বে তখন দাঁও মারার আশায় অনেক আগে থেকেই অল্প দামে কৃষকদের কাছ থেকে জমি কিনে রাখে। আর মাফিয়ার লোক ভয় দেখিয়ে জবরদস্তি করে জমি হস্তগত করে। কৃষককে এর থেকে রক্ষা করতে এবং জমিকে শিল্পযোগ্য করার ন্যূনতম ব্যবস্থা (যেমন বিদ্যুৎ পরিবহণে) তৈরি করতে সরকারকে মাঠে নামতেই হবে। শুধু বাজারের উপর ছেড়ে দিলেই চলবে না। কাগজে পড়লাম, মুখ্যমন্ত্রীর জমি বিষয়ক উপদেষ্টা দেবব্রত বন্দ্যোপাধ্যায় নাকি বলেছেন যে, বিক্রীত জমির একটা ন্যূনতম মূল্য বেঁধে দিতে চেষ্টা করবেন। কিন্তু তা করে কি জমির বাজারের ফাটকাবাজ আর মাফিয়াদের চাষিকে ঠকানো বা জুলুমবাজি বন্ধ করতে পারবেন? ওরা তো অনেক আগে জমি কিনে রাখবে, ওঁরা কি আগে থেকেই রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চলের জন্য বিভিন্ন রকমের ন্যূনতম মূল্য বেঁধে রাখবেন? তার পর মাফিয়ার লোকেরা ওই দাম নিশ্চিত দিয়েছিল কি না, তার খোঁজে পুলিশ পাঠাবেন? আর সেই পুলিশ সৎ ভাবে যাচাই করে দেখবে দলিলে লিখিত দাম কৃষক সত্যিই পেয়েছিল কি না?
মাফিয়ার কথা যদি ছেড়েও দিই, যে বাজারে এক দিকে শক্তিশালী ধনপতি কর্পোরেট ক্রেতা আর অন্য দিকে, বিক্রেতা হাজার হাজার ক্ষুদ্র চাষি সেই বাজারে দর কষাকষিতে পাল্লা কোন দিকে ঝুঁকবে তা সহজেই অনুমেয়।
ধনপতি ক্রেতার দিক থেকেও এই বাজারের প্রক্রিয়ায় একটা বড় অসুবিধা আছে, হাজার হাজার বিক্রেতার সঙ্গে আলাদা করে দর কষাকষি করা আর চুক্তি-কাগজপত্রের বন্দোবস্ত করা প্রচুর ঝামেলা ও সময়সাপেক্ষ।
তাই সেই ধনপতি অন্য প্রদেশে, যেখানে কম ঘনবসতি বা অন্য কারণে ক্ষুদ্র চাষির ভিড় কম বা সেখানকার রাজ্য সরকার সাগ্রহে জমি অধিগ্রহণ করে দেবে (যেমন গুজরাতে), সেখানে চলে যাবেন। মনে রাখতে হবে যে, অন্য অনেক প্রদেশের তুলনায় নানা কারণে পশ্চিমবঙ্গে নতুন শিল্পায়নে এমনিতেই অনেক দেরি হয়ে গেছে। তার উপর আছে আমাদের দুর্বল পরিকাঠামো ও প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা এবং ঘনবসতি। এই অবস্থায় শিল্পপতিদের আকর্ষণ করার উপকরণ এখানে অপেক্ষাকৃত কম। জমির ব্যাপারে তৃণমূল সরকার বাজারের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকলে উল্লিখিত কারণে ওই আকর্ষণ আরও কমে যাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা।
এই প্রাদেশিক প্রতিযোগিতার পরিপ্রেক্ষিতে রাজ্য সরকারকে আর একটা জিনিসও মাথায় রাখতে হবে। একাধিক বার এই সরকারকে বলতে শুনেছি যে, কেন্দ্রে নতুন জমি অধিগ্রহণের আইন যাই হোক না কেন, আমরা রাজ্যে আমাদের স্বায়ত্তশাসনের সঙ্গত অধিকার খাটিয়ে রাজ্যের জন্য আরও কৃষক-বান্ধব আইন করব। কিন্তু এ ব্যাপারে স্বায়ত্তশাসনের অধিকার নিয়ে বাড়াবাড়ি করলে ওই প্রাদেশিক প্রতিযোগিতায় আমাদের হেরে যাওয়ার সম্ভাবনা বাড়বে। সম্প্রতি কেন্দ্রীয় সরকার জমি অধিগ্রহণ ও পুনর্বাসনের একটি নতুন আইনের খসড়া তৈরি করে রাজ্য সরকারকে দেখিয়েছে। এই খসড়াটি যথেষ্ট কৃষক-বান্ধব। জমি অধিগ্রহণ করলে কৃষককে জমির বাজার দরের অন্তত ছয় গুণ ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। তার উপর পুনর্বাসনের জন্য দু’হাজার টাকা করে মাসিক ভাতা দেওয়া হবে কুড়ি বছর ধরে। এই মাসিক ভাতা জমির উপর নির্ভরশীল অন্যদেরও (অর্থাৎ বর্গাদার, খেতমজুর ইত্যাদি সবাইকে) দেওয়া হবে। এই সবাইকে ধরে তার শতকরা অন্তত আশি ভাগ লোকের লিখিত সম্মতি ছাড়া জমি অধিগ্রহণ করা যাবে না, ইত্যাদি। এই কেন্দ্রীয় নিয়ম চালু হওয়ার পর যদি আবার আমাদের সরকার বায়না ধরে বসে যে, এই নিয়ম থেকে বিচ্যুতির অধিকার সরকারের থাকবে (কেননা সংবিধানে জমির ব্যাপার প্রধানত রাজ্যের হাতে দেওয়া হয়েছে), তা হলে আবার রাজ্যগুলির মধ্যে বিচ্যুতির মাত্রা নিয়ে প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যেতে পারে। তাতে অপেক্ষাকৃত সমৃদ্ধ রাজ্যগুলির সঙ্গে আমাদের পাল্লা দেওয়া কঠিন হবে। সে দিক দিয়ে ভাবলে কেন্দ্রীয় নিয়মের সমযোজ্যতাই আমাদের পক্ষে সুবিধাজনক। প্রস্তাবিত কেন্দ্রীয় আইনটি সম্পর্কে আমার কিছু সমালোচনা আছে, তা নিয়ে অন্যত্র লিখেছি।
জমি হস্তান্তরের ব্যাপারে আমাদের ত্রি-সঙ্কট। এক দিকে গরিব চাষিদের কথা ভেবে আমাদের কৃষক-বান্ধব হতে হবে, এ দিকে আবার শিল্পে যথেষ্ট কর্মসংস্থানের জন্য শিল্প-বান্ধব হতে হবে অন্য প্রদেশের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে। এত সব বান্ধবতার মাসুল হিসাবে প্রচুর অর্থসংস্থানের প্রয়োজন। অথচ আমাদের সরকারের অর্থ দফতরের ভাঁড়ে মা ভবানী। সরকারি চাকুরেদের মাইনে দিতেই হিমশিম অবস্থা। কেন্দ্রের কাছ থেকে ভিক্ষে করে কত দিন আর চলবে? এই অবস্থায় অর্থ সঙ্কুলানের ব্যাপারে নানা দিকের কথা চিন্তা করতে হবে। জমির প্রসঙ্গে তার একটা দিকের কথা বলি। কেন্দ্রীয় আইনে যে মাসিক ভাতার কথা বলা হচ্ছে, সেটার জন্য আমরা একটা পেনশন ফান্ডের কথা ভাবতে পারি। জমির দরের ব্যাপারেও অনুরূপ ভাবা যেতে পারে। কৃষক কৃষির কাজ থেকে অবসর নিচ্ছেন। তাঁর জন্য একটা মাসিক ভাতা আসবে ওই ফান্ড থেকে। আর যে কোম্পানি জমি কিনছে তার মূল্যের অংশ হিসাবে তার কাছ থেকে বেশ কিছু শেয়ার নিয়ে সেই ফান্ডে রাখতে হবে। অনেক শিল্পপতি নগদের তুলনায় শেয়ার দিতেই বেশি আগ্রহী। শেয়ারের দাম বাজারে ওঠানামা করবে, সেই ঝুঁকি কমাবার জন্য যেখানে যত কোম্পানি জমি কিনছে, তাদের সবার শেয়ার একত্রিত করে একটি বৃহৎ ফান্ডে জমা হবে। এই ফান্ডটি সরকারি তদারকিতে কিন্তু প্রধানত পেশাদারি অধ্যক্ষের পরিচালনায় থাকবে। তার থেকে নিয়মিত এবং সমপরিমাণ মাসিক ভাতা দেওয়া হবে কৃষককে। কৃষকের হাতে নগদ টাকা এলে তাড়াতাড়ি খরচ হয়ে যাওয়ার যে ভয় থাকে, সেটাও কমবে। বিদেশে অনেক পেনশন ফান্ডই এই ভাবে পেশাদারি পরিচালনায় চলে। আর নতুন শিল্প বা রাস্তা ইত্যাদি হলে আশেপাশের জমি যা হস্তান্তরিত হচ্ছে না, সেগুলিরও দাম অনেক বাড়বে। তাদের মালিকদের ওই মওকায় পাওয়া বাড়তি মূল্যের উপর সরকার কর বসাতে পারে। এবং সেই টাকাও ওই ফান্ডে জমা পড়বে।
তৃণমূল সরকারের আর একটা গোঁ হচ্ছে যে, যাদের জমি নেওয়া হবে সেই পরিবারের অন্তত এক জনকে নতুন শিল্প প্রতিষ্ঠানে চাকরি দিতে হবে। শিল্প প্রতিষ্ঠানের চাকরি হরির লুঠ নয়। চাকরির জন্য যোগ্যতা না থাকলেও নিতে বাধ্য করাটা অন্যায় আবদার। এই ভাবে আমরা কর্মস্থলে অকর্মণ্যতা আর অযোগ্যতাকে প্রশ্রয় দিই। বরং সরকারের উচিত ওই পরিবারের ছেলেমেয়েদের বিভিন্ন বৃত্তি ও পেশায় দক্ষতা অর্জনের জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা।
সবশেষে বলি, পশ্চিমবঙ্গে জমি অধিগ্রহণের ব্যাপারে রাজনীতির জল এত ঘোলা হয়েছে যে সরকারের উচিত, সমস্ত বিষয়টাতে দৈনন্দিন সিদ্ধান্ত থেকে শুরু করে ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসনের সমস্ত পরিচালনা করার ভার একটা নিরপেক্ষ দলপ্রভাবমুক্ত কমিশনের হাতে তুলে দেওয়া। এই কমিশন বছরের শেষে একবার বিধানসভার কাছে জবাবদিহি করবে। মাঝে মাঝে বিভিন্ন অঞ্চলে গিয়ে জনশুনানির ব্যবস্থা করবে। সাধারণ মানুষের কাছে অভিযোগ-অবিচারের কথা শুনবে। কিন্তু তাদের প্রাত্যহিক কাজের উপর রাজনৈতিক খবরদারি চলবে না।
সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের গরম হাওয়ায় তৃণমূলের নেতারা রাজ্যের মসনদ দখল করে থাকতে পারেন, কিন্তু এখন সময় এসেছে তাঁদের জমি অধিগ্রহণ নিয়ে ঠান্ডা মাথায় আর একটু নতুন ভাবে চিন্তা করার। সাময়িক জনমনোরঞ্জন ছেড়ে আখেরে পশ্চিমবঙ্গের কীসে মঙ্গল হবে তাতে মনোনিবেশ করার।
|
লেখক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফর্নিয়া, বার্কলে’তে অর্থনীতির শিক্ষক |
|
|
|
|
|