|
|
|
|
প্রবন্ধ ২... |
বিশ্ব অর্থনীতির দুর্যোগ দায়ী ভুল রাজনীতি |
যাঁরা ঋণের পাহাড় গড়ে তুলেছেন, তাঁদের বেহিসেবি অভ্যাস ছাড়তে হবে। কিন্তু সেটা দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা।
খাতকদের ধমকধামকে তড়িঘড়ি সরকারি বাজেটে অত্যধিক কোপ বসালে অর্থনীতি অচল হয়ে পড়ে।
পরীক্ষিৎ ঘোষ |
চিন দেশের রসিকজন মিষ্টি কথায় অভিশাপ দেন: “আপনার জীবনে যেন উত্তেজনার অভাব না হয়।” চিনের সঙ্গে আমেরিকার সম্পর্কটা ইদানীং বড্ড গোলমেলে। সন্দেহ হয়, তাদের অভিশাপ এখন আমেরিকার কপালে জুটেছে। ২০০৮ সালে আমেরিকার শেয়ার বাজারে ভয়ংকর ধস নেমেছিল। খারাপ ঋণ আর আর্থিক অনাচারের চাপে গোটা ব্যাঙ্ক ব্যবস্থা রসাতলে যাওয়ার উপক্রম। সেই ধাক্কাটা মোটামুটি সামলে উঠলেও ডামাডোলে মার্কিন অর্থনীতিতে দেখা দিল প্রবল মন্দা। বেকারির অনুপাত দশ শতাংশ ছুঁই-ছুঁই, ঋণের দায়ে বহু লোক গৃহহীন, সাধারণ মানুষের ঘোর দুর্দশা। সেই আর্থিক মন্দা এখনও পুরোপুরি কাটেনি, ইতিমধ্যে আবার বিনা মেঘে বজ্রপাত।
রাজস্ব ঘাটতি মেটাতে মার্কিন সরকার বাজারে বন্ড ছাড়েন, অর্থাৎ টাকা ধার করেন। কত টাকা ধার করা যাবে কংগ্রেস তার একটা সীমা নির্ধারণ করে দেয়। গত পঞ্চাশ বছরে ৬৮ বার ঋণ-সীমা বাড়ানো হয়েছে। এ বার হঠাৎ রিপাবলিকান পার্টির সাংসদরা বলে দিলেন, নানা খাতে সরকারি খরচ বাঁচিয়ে রাজস্ব ঘাটতি কমানোর প্রতিশ্রুতি না দিলে ঋণ-সীমা বাড়ানোর সপক্ষে ভোট দেবেন না। অনেক বাগ্বিতণ্ডা আর দরাদরির পর একেবারে অন্তিম লগ্নে ঋণ-সীমা ৪০,০০০ কোটি ডলার বাড়ানো হয়েছে। তবে কাণ্ড দেখে স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড পুয়োরস রেটিং সংস্থা মার্কিন সরকারি বন্ডের রেটিং সর্বোচ্চ স্তর থেকে নামিয়ে দিয়েছে। অনিশ্চয়তার দৌলতে শেয়ার দর এমনিতেই নিম্নগামী ছিল। এই ঘটনার পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সমেত সারা পৃথিবীর শেয়ার বাজার আবার থরহরি কম্পমান।
গত তিন বছর ধরে মার্কিন অর্থনীতিতে এই টালমাটাল কেন? উত্তরে বলতে হয়, পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় উত্থানপতন আসবেই। যে কোনও বিপর্যয়েই কাউকে একটা ফাঁসি দিতে না পারলে আমাদের গায়ের ঝাল মেটে না। আসামি খুঁজতে গিয়ে লোকে নিজের মতাদর্শের চশমাটা পরে নিতে ভোলেন না। বামপন্থীরা গর্জে ওঠেন ধনতন্ত্র আর বিশ্বায়নের বিরুদ্ধে, দক্ষিণপন্থীরা বলতে থাকেন সরকারি নিয়মকানুনের বজ্র আঁটুনিতে ফসকা গেরো হয়েছে। এ ক্ষেত্রে অবশ্য যোগ্য আসামি মেলা ভার হবে না। |
|
দুঃসময়? ওয়াল স্ট্রিট, নিউ ইয়র্ক। অগস্ট ’১১। এ এফ পি |
গোলযোগের সূত্রপাত ২০০৮ সালে, যখন বোঝা গেল আমেরিকার অনেক ব্যাঙ্ক বেপরোয়া ধার দিয়েছে আর বিভিন্ন জটিল সিকিয়োরিটির মোড়কে পুরে ঋণ আদায়ের ভার পাচার করেছে অন্যান্য আর্থিক সংস্থার ঘাড়ে। ঋণের বেনোজল ঢুকে বাড়িঘরের দাম ফুলে-ফেঁপে উঠেছিল। সেই ফানুসটা যখন ফাটতে শুরু করল আর ঋণ গ্রহীতারা দেউলিয়া হতে আরম্ভ করলেন, আমেরিকার যাবতীয় ব্যাঙ্ক আর আর্থিক সংস্থার নাভিশ্বাস উঠল। ব্যবসায় টাকাপয়সার লেনদেন নিতান্তই জরুরি। ভয়ে ভাবনায় সেটাই গেল প্রায় বন্ধ হয়ে। এ থেকেই মন্দার সূত্রপাত। নব্বইয়ের দশকে বিল ক্লিন্টন এবং রিপাবলিকান কংগ্রেসের জমানায় ব্যাঙ্কিংয়ের নিয়মকানুন অনেক শিথিল করা হয়েছিল। এই বিপর্যয়ের পিছনে তার খানিক অবদান আছে, সে সন্দেহ অমূলক নয়।
তবে, দুর্নীতি আর লোভের ঘাড়ে সমস্ত দোষ চাপিয়ে বসে থাকলে ভুল করা হবে। পুঁজিবাদী ব্যবস্থা স্থির জলাশয়ের মতো নয়, সেখানে ঢেউয়ের ওঠাপড়া চলবেই। পুঁজির নিয়মই হল, মুনাফার লোভে নতুন বিনিয়োগ, নতুন কর্মকাণ্ডের পিছনে ধাওয়া করে বেড়ানো। কোথায় উৎপাদনশীল কাজ পুঁজির অপেক্ষায় আটকে রয়েছে, আর কোথায় মিথ্যা আশার হাতছানি দেখা যাচ্ছে, এটা অনেক সময়েই আগে থেকে স্পষ্ট বোঝা মুশকিল। যাঁরা আজ ব্যাঙ্কদের বিরুদ্ধে তোপ দাগছেন, তাঁরা কিন্তু প্রায় কেউই ঘটনার আগে টের পাননি যে ঘরবাড়ির দাম বুদ্বুদের মতো ফুলে উঠেছে ফাটকাবাজির খেলায়। চোর পালানোর পর অনেকেরই বুদ্ধি বেড়েছে। যাবতীয় আর্থিক দুরাচার যদি বন্ধ করাও যায়, তা হলেও কিন্তু কখনও সখনও পুঁজির বাজারে সংকট আর অর্থনৈতিক মন্দার আবির্ভাব ঠেকানো যাবে না। তবে কিছু কিছু ব্যবস্থা নিলে ঝাপ্টাটা কম লাগতে পারে, মন্দার খপ্পর থেকে বেরনো যায় তাড়াতাড়ি। মুশকিল হল, রোগীকে ঠিকঠাক দাওয়াইটা দেওয়া হচ্ছে না, বরং মাঝে মধ্যে ভুল ওষুধ খেয়ে হিতে বিপরীত হচ্ছে। এর পিছনে সাধারণ মানুষ আর রাজনীতিকদের অর্থনৈতিক বোধের অভাব কিছুটা কাজ করছে। বাকিটা রাজনীতির খেলা।
আর্থিক সংকট যখন মাথা চাড়া দিল, প্রথমেই দরকার ছিল বড় বড় ব্যাঙ্ক আর আর্থিক সংস্থাগুলোর যাতে ঘট না ওল্টায় তার বন্দোবস্ত করা, দরকার হলে সরকার থেকে মোটা ঋণ দিয়ে বা লগ্নি করে তাদের জিইয়ে রাখা। এ ব্যাপারটা অনেকের চোখেই অদ্ভুত ঠেকল। বিত্তের কারবারি ওয়াল স্ট্রিটের হোমরাচোমরারা টাকার নয়ছয় করেছেন, বেমক্কা ঝুঁকি নিয়ে বেসামাল হয়েছেন। এখন সাধারণ করদাতাদের টাকায় তাঁদের উদ্ধার করা কি সাজে? এই ভাবনা খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু মুশকিল হল, আধুনিক অর্থব্যবস্থায় সকলের সঙ্গেই সকলের টিকি বাঁধা রয়েছে। কয়েকটা বড় ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থাই ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়, ঋণের লেনদেন গুটিয়ে আসে, কলকারখানা বন্ধ হতে শুরু করে, সংক্রামক রোগের মতো অর্থনৈতিক ব্যাধি চারি দিকে ছড়িয়ে পড়ে।
২০০৮ সালের শেষের দিকে লেম্যান ব্রাদার্স ভেঙে পড়ল, জর্জ বুশের সরকার হাত গুটিয়ে বসে রইলেন। তার পর বিপদ দেখে বাকিদের বাঁচাতে তড়িঘড়ি ৭০,০০০ কোটি ডলারের ত্রাণ প্যাকেজ তৈরি হল বটে, তবে কংগ্রেসে সেই আইন পাশ করাতে সরকার হিমশিম খেল। বুশের নিজের দল, রিপাবলিকানরা জনরোষে গলা মিলিয়ে বিরুদ্ধে ভোট দিলেন। অধিকাংশ সময়ে রিপাবলিকানরা বড়লোকদের নানা রকম ছাড় দিতে উঠেপড়ে লাগেন, কিন্তু কাজের সময় অপ্রিয় ব্যবস্থা নিতে সমর্থন লাগল ডেমোক্র্যাটদের।
ওয়াল স্ট্রিট বাঁচলেও মন্দা মাথা চাড়া দিয়ে উঠল অনিবার্য নিয়মে। ২০০৮ সালের মাঝামাঝি বেকারি ছিল ৬ শতাংশের কম। ২০০৯-এর গোড়ায় সেটা লাফিয়ে ৯ শতাংশ ছাড়িয়ে গেল। বারাক ওবামা এবং ডেমোক্র্যাটরা তখন সদ্য ক্ষমতায় এসেছেন। তাঁরা মজা গাঙে জোয়ার আনতে প্রায় ৮০,০০০ কোটি ডলার ‘স্টিমুলাস প্যাকেজ’ পাশ করালেন। মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তদের ওপর আয়কর কমানো হল। শিক্ষা, চিকিৎসা, বেকার ভাতা, রাস্তাঘাট সারাই ইত্যাদি খাতে টাকা বরাদ্দ হল। রিপাবলিকানরা এক সুরে বিরোধিতা করলেন, তবে কংগ্রেসে আসনসংখ্যা কম থাকায় আটকাতে পারলেন না।
মন্দার বাজারে সরকারের দু’হাতে খরচ করাটা অনেকের মনে খটকা লাগিয়েছে। গেরস্থালির হিসেব মেলাতে গিয়ে আমরা যে রীতিনীতি মেনে চলি, দেশ চালাতে হলে সরকারের সেই পথেই হাঁটা উচিত, এমনটা অনেকেই মনে করেন। এই ভাবনাটা ভুল। ব্যক্তির আর্থিক অনটন ঘটলে মেপেজুপে চলতে হয়। কিন্তু দেশে মন্দা এলে সরকার যদি খরচাপাতি কমিয়ে দেয়, তা হলে হিতে বিপরীত হয়। লোকে কেনাকাটা করছে না, বাজারে চাহিদা নেই, কলকারখানা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, এটাই মন্দার কারণ। সরকারকে খরচ বাড়িয়ে চাহিদা সৃষ্টি করতে হবে, নইলে মন্দা আরও বাড়বে।
স্টিমুলাসের দৌলতে পতন মোটামুটি আটকানো গিয়েছে। ২০০৯-এ মাথাপিছু জাতীয় আয় ৩ শতাংশের বেশি কমে গিয়েছিল, এখন আবার বাড়তির দিকে। বেকারির হার ১০ শতাংশ ছুঁয়ে এসে ৯-এর আশেপাশে ঘোরাফেরা করছে। সরকার খরচ না বাড়ালে অবস্থার আরও অবনতি হত, তবে পুরোপুরি হাল ফেরাতে আরও স্টিমুলাসের প্রয়োজন আছে, সেটা এখন বোঝা যাচ্ছে। অবশ্য ঘোলা জলে মাছ ধরার লোকের অভাব হয় না। মন্দার বাজারে সাধারণ মানুষের মেজাজ চড়ছে, সরকারের রাজস্ব ঘাটতি বাড়ছে, আর রিপাবলিকান দল এই দুঃসময় ভাঙিয়ে রাজনৈতিক মুনাফা লোটার চমৎকার মওকা পেয়ে গেছে।
আমেরিকার আর্থিক অবস্থা এখন যেখানে দাঁড়িয়ে, তাতে রাজস্ব ঘাটতি আর ক্রমবর্ধমান জাতীয় ঋণ নিয়ে দুশ্চিন্তা খানিকটা স্বাভাবিক। আয়কর বাড়াতে গেলেই রিপাবলিকানরা তুমুল হইচই জোড়েন, লোকেও তাঁদের সমর্থন করে। ও দিকে ব্যয়সংকোচ মানেই সুযোগসুবিধার কাটছাঁট, সরকারি পেনশন বা চিকিৎসা বিমায় হস্তক্ষেপ। ডেমোক্র্যাটরা এ-সবে চট করে রাজি হন না, জনগণও ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। তার ওপরে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী জনসংখ্যার হারবৃদ্ধির সময়ে যাঁদের জন্ম হয়েছিল, সেই বিরাট জনগোষ্ঠী শীঘ্রই অবসর নিতে চলেছে। এতে সরকারের রাজস্ব আরও কমবে, পেনশন আর চিকিৎসার খরচ বেড়ে যাবে। আগামী কয়েক দশকে ঘাটতি কী ভাবে সামাল দেওয়া যায়, সে বিষয়ে চিন্তাভাবনার প্রয়োজন।
তবে ভুললে চলবে না যে, এই পরিস্থিতির পিছনে জর্জ বুশের আট বছরের জমানার অবদান বড় কম নয়। বুশের যুদ্ধবিগ্রহে, বিশেষ করে ইরাকে যুদ্ধের খরচ মেটাতে গিয়ে সরকারি কোষাগারের ওপর অনেক চাপ পড়েছে। তার ওপর তিনি বড়লোকদের ওপর আয়কর কমিয়ে দিয়েছিলেন। বুশ যখন ক্ষমতায় এলেন, রাজস্ব ঘাটতির বদলে প্রাচুর্য ছিল। যখন তিনি মসনদ থেকে বিদায় নিয়ে টেক্সাসে অবসর জীবন কাটাতে রওনা দিলেন, রাজস্ব ঘাটতি জাতীয় আয়ের ৪ শতাংশ ছাড়িয়ে ঊর্ধ্বমুখী। আর সেই ঘাটতিকেই তাঁর দল এখন তুরুপের তাস করেছে।
১৯২৯ সালে শেয়ার বাজারের ধস আর মহামন্দার পরে রাষ্ট্রপতি রুজভেল্ট আমেরিকার অর্থনৈতিক মানচিত্রে আমূল পরিবর্তন আনেন। অবসরপ্রাপ্ত মানুষের জন্য সরকারি পেনশন, ব্যাঙ্কে গচ্ছিত সঞ্চয়ের জন্য গ্যারান্টি ইত্যাদি নানা দীর্ঘমেয়াদি ব্যবস্থার পত্তন হয়, যাকে সামগ্রিক ভাবে নিউ ডিল বলা হয়ে থাকে। ষাটের দশকে রাষ্ট্রপতি জনসন এর সম্প্রসারণ ঘটান, বিশেষ করে অবসরপ্রাপ্ত আর নিম্নবিত্তদের চিকিৎসার জন্য সরকারি সাহায্যের বন্দোবস্ত করে। বলা যেতে পারে, ত্রিশের দশকে দুঃসময়ের পরে মার্কিন ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থায় খানিকটা সমাজতন্ত্রের লাগাম পরানো হয়, অর্থের কিছুটা সমবণ্টন যে কাম্য সে কথা স্বীকৃতি পায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী কালে সমস্ত উন্নত দেশই এ পথে হেঁটেছে, আমেরিকা বরং তুলনায় কম।
কিন্তু রিপাবলিকানরা অনেকেই একেবারে নিয়ন্ত্রণহীন বাজারি অর্থনীতির মন্ত্রে দীক্ষা নিয়েছেন। তাঁরা মনে করেন দারিদ্রের কারণ মানুষের দুর্ভাগ্য নয়, তার আলস্য আর নির্বুদ্ধিতা। আমেরিকার কর্পোরেট জগতের সঙ্গে তাঁদের দহরম-মহরম তো আছেই। ত্রিশের দশকের নিউ ডিল রিপাবলিকান মানসে ওয়াটারলুর যুদ্ধে পরাজয়ের মতো। রুজভেল্ট অর্থনৈতিক সংকটের সুযোগ নিয়ে মার্কিন সমাজব্যবস্থার ভোল বদলে দিয়েছিলেন, পুঁজিবাদের সঙ্গে মানবতাবাদকে মেলানোর চেষ্টা করেছিলেন। আর এক সংকট মুহূর্তে রিপাবলিকান পার্টি বদলা নেওয়ার সুবর্ণসুযোগ দেখতে পেয়েছে। দুশ্চিন্তাগ্রস্ত, বিক্ষুব্ধ মানুষকে যদি বোঝানো যায় যে, সব দুর্দশার মূলে সরকারের রাজস্ব ঘাটতি, তবে ব্যয়সংকোচের নাম করে নিউ ডিলের ব্যবস্থাপনা তুলে দেওয়া যাবে। এটাই তাদের কিস্তির চাল।
সারা বিশ্বের পুঁজিবাদী ব্যবস্থা এখন একটা দুর্যোগের মধ্য দিয়ে চলেছে। অনেকেই আকণ্ঠ ঋণে ডুবে আছেন, অনিশ্চয়তার ফলে ঋণদাতারা নতুন ঋণ দিতে রাজি নন। ফলে ইউরোপে ইতালি, স্পেন, আয়ার্ল্যান্ড আর গ্রিসের মতো দেশও ধার শোধ দিতে হিমশিম খাচ্ছে। এ সব দেশের সরকার দেউলিয়া হয়ে যেতে পারে, এই ভয়ে সবাই তটস্থ। এ কথা ঠিক যে, যাঁরা ঋণের পাহাড় গড়ে তুলেছেন, তাঁদের বেহিসেবি অভ্যাস ছাড়তে হবে। কিন্তু সেটা দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা হওয়া উচিত। খাতক আর সমালোচকদের ধমকধামকে তড়িঘড়ি সরকারি বাজেটে অত্যধিক কোপ বসালে অর্থনীতি অচল হয়ে পড়ে। মানুষের দুর্দশা তো হয়ই, ঘাটতিও যে খুব কমে তা নয়। এই কথাগুলো আমেরিকার ক্ষেত্রে দ্বিগুণ সত্য। আমেরিকার ঋণভার গ্রিস বা আয়ার্ল্যান্ডের চেয়ে এখনও কম, সক্ষমতা অনেক বেশি, ঋণের বড় অংশ স্বদেশেই সীমাবদ্ধ।
সবচেয়ে বড় কথা হল, মার্কিন ডলার আর সরকারি বন্ড বিশ্ব অর্থনীতির মেরুদণ্ড। যাবতীয় লেনদেন আর চুক্তিপত্র এর মাধ্যমেই হয়ে থাকে। এর ওপরে লোকের ভরসা টলে গেলে মহা সংকট দেখা দিতে পারে। অদূর ভবিষ্যতে সরকারের ঋণ মেটানোর ক্ষমতা নিয়ে সংশয় নেই। সে বিষয়ে যে সন্দেহ দানা বেঁধে উঠেছে, তার কারণটা অর্থনৈতিক নয়, রাজনৈতিক। রিপাবলিকানরা তাঁদের দেশে মুক্ত অর্থনীতি আর প্রবল অর্থনৈতিক বৈষম্য ফিরিয়ে আনতে বদ্ধপরিকর, তাই তাঁরা বিশ্বের গোটা আর্থিক পরিকাঠামোটা নিয়ে ছিনিমিনি খেলতেও রাজি। ‘টি পার্টি’ নামে পরিচিত তাঁদের অতি দক্ষিণপন্থী অংশ একটা চটকদার জনপ্রিয়তার খেলায় ওস্তাদ হয়ে উঠেছে। আবেগসর্বস্ব প্রতিবাদের রাজনীতিই তাদের হাতিয়ার।
আমরা যারা লাল ঝান্ডা আর মা মাটি মানুষের ছত্রচ্ছায়ায় বহু দিন কাটিয়েছি, তাদের কাছে এটা অপরিচিত ঠেকার কথা নয়।
|
লেখক দিল্লি স্কুল অব ইকনমিক্স-এ অর্থনীতির শিক্ষক |
|
|
|
|
|