|
|
|
|
বিচারপতি সেনের ‘বিচার’ শুরু রাজ্যসভায় |
নিজস্ব সংবাদদাতা • নয়াদিল্লি |
ঘড়ির কাঁটায় তখন ঠিক তিনটে।
ইতিহাসের সাক্ষী হতে চলেছে সংসদ। গোটা দেশ।
মার্শালকে নির্দেশ দিলেন রাজ্যসভার চেয়ারম্যান হামিদ আনসারি, “বিচারপতি সেন কি উপস্থিত রয়েছেন? তাঁকে সভার কাঠগড়ায় নিয়ে আসা হোক।”
আনসারির ঠিক মুখোমুখি রাজ্যসভার ঢোকার মুখে আগে থেকেই কাঠগড়া বানানো ছিল। তলব আসা মাত্রই কৌসুঁলিদের সঙ্গে নিয়ে হাজির হলেন কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি সৌমিত্র সেন। তিনি আসা মাত্রই সংসদের বিচারবিভাগীয় দায়িত্ব পালনের প্রথম নজির স্থাপন হল। বিচারপতি সৌমিত্র সেনকে ইমপিচ করার প্রস্তাব পেশ করলেন সিপিএম সাংসদ সীতারাম ইয়েচুরি।
তার পর প্রায় দু’ঘণ্টা। আত্মপক্ষ সমর্থনে এক টানা বলে গেলেন বিচারপতি সেন। তাঁর জন্য দেড় ঘণ্টা সময় নির্ধারিত ছিল। সময় শেষে সে কথা স্মরণও করিয়ে দেন চেয়ারম্যান। কিন্তু তত ক্ষণে নিজেকে ‘নির্দোষ’ প্রমাণে এমন সুললিত বক্তব্য রেখেছেন, যে সাংসদরাই তাঁর হয়ে বাড়তি সময়ের আবেদন জানান। বিচারপতি সেনের এই দু’ঘণ্টার বক্তৃতার মূল সুর ছিল একটাই। টাকার অনিয়ম তিনি করেননি। সে’টি অন্য ভাবে ব্যবহার করা যেতে পারত ঠিকই। কিন্তু টাকার অনিয়ম ও ভুল তথ্য দেওয়ার অভিযোগে যদি তাঁকে ইমপিচ করা হয়, তা হলে তা চরম অবিচার হবে। বিচারপতি সেনের অভিযোগ, তাঁকে বলির পাঁঠা করা হচ্ছে। কিন্তু তাঁকে বরখাস্ত করলেই বিচারবিভাগ দুর্নীতিমুক্ত হয়ে যাবে না। কখনও তিনি আক্রমণ করেন সুপ্রিম কোর্টের প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি কে জি বালকৃষ্ণনকে। কখনও বলেন,
পদত্যাগের জন্য রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থায় চাকরি দেওয়ার
টোপও দেওয়া হয়েছিল তাঁকে। নাম না করে আক্রমণ করেন আরও অনেক বিচারপতিকেও।
টান টান উত্তেজনায় ভরা ‘আদালতে’র গ্যালারিতে তখন উপচে পড়া ভিড়। সরকারি হুইপ মেনে প্রায় সব দলের সাংসদই উপস্থিত। রাজ্যসভার সাংসদ হিসাবে রয়েছেন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহও। লোকসভার সাংসদরাও তখন নিজেদের সভা ছেড়ে ভিড় করেছেন রাজ্যসভার গ্যালারিতে। লালকৃষ্ণ আডবাণী, লোকসভার বিরোধী দলনেত্রী সুষমা স্বরাজ থেকে দীপা দাশমুন্সিও। নব্বইয়ের দশকে এক সময়ে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি ভি রামস্বামীর ইমপিচের প্রক্রিয়াও শুরু হয়েছিল। বাম ও বিজেপি মিলে সে বারেও ইমপিচের নোটিস দিয়েছিল। কিন্তু কংগ্রেস ও শরিক দলের সমর্থনের অভাবে প্রয়োজনীয় দুই-তৃতীয়াংশ সদস্য পাওয়া যায়নি।
আজ বিচারপতি সেনের আত্মপক্ষ সমর্থনের
পরেই অবশ্য তাঁকে চলে যাওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়।
তার পর প্রস্তাবের সমর্থনে রাজ্যসভার বিরোধী দলনেতা অরুণ জেটলি বলতে উঠলেও তা এখনও শেষ হয়নি। ফলে কাল সব পক্ষের বক্তব্যের পর ভোটাভুটি হবে।
প্রস্তাবের পক্ষে দুই-তৃতীয়াংশ ভোট এলেই সেটি পাঠানো হবে লোকসভায়। সেখানেও আলোচনার পর ভোটাভুটি হলে ইমপিচের প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ হবে। কিন্তু বিচারপতি সেন আজ নিজেকে বাঁচানোর এক শেষ চেষ্টা করেন। বার বার সাংসদদের আবেদন জানান, তাঁকে পদ থেকে হটানোর নকশা অনেক আগে থেকেই নির্ধারিত ছিল। বিচারব্যবস্থায় আর কোনও সুরাহা তিনি আশাও করেন না। তাই সাংসদরা সব দিক খতিয়ে দেখে সিদ্ধান্ত নিন। বিচারপতি হিসাবে কখনও তাঁর বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগ ওঠেনি। তবুও কেন
পুরনো মামলা টেনে এনে তাঁকে ‘ক্ষমতার অপব্যবহারের শিকার’ হতে হচ্ছে?
বিচারপতি সেন চ্যালেঞ্জ করেন, “অসমের এক ছোট শহর থেকে আমি উঠে এসেছি। চাইলে আমার লকার, সব সম্পত্তি খতিয়ে দেখা হোক। রিসিভার হিসাবে আমি একটি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। সেটি ঠিক কিংবা ভুল হতে পারে। কিন্তু অনিয়ম করিনি। এই সংসদ আমার ভাগ্য নিয়ে যা-ই সিদ্ধান্ত নিক না কেন, তবুও আমি চেঁচিয়ে বলব আমি কোনও অনিয়ম করিনি। এক নয়া পয়সাও নিজের জন্য খরচ করিনি। সব টাকা ফেরত দিয়েছি।”
কিন্তু বিচারপতি সেন বলার পরে রাজ্যসভার বিরোধী দলনেতা অরুণ জেটলি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেন, একটি সামান্য বিষয়কে ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে অহেতুক জটিল করার কোনও অর্থ হয় না। কলকাতা হাইকোর্টের নির্দেশে সেলের টাকা রিসিভার হিসাবে তিনি দুটি ব্যাঙ্কে জমা রাখেন। সেই অ্যাকাউন্ট থেকে তিনি ব্যক্তিগত খরচও করেছেন। পরে ক্যালকাটা ফ্যানসের জন্য যে অতিরিক্ত সত্তর লক্ষ টাকা আসে, তার থেকে কিছু টাকা লিঙ্কস ইন্ডিয়া কোম্পানি নামে এক সংস্থায় খাটান তিনি। পরে সেই সংস্থা রুগ্ণ হওয়ায় সেলের টাকা দিয়ে পোষান।
সব থেকে বড় কথা, ২০০৩ সালে বিচারপতি হওয়ার পরেও তিন বছর তিনি চুপচাপ বসেছিলেন। পরে নিজের মা-কে দিয়ে আদালতে আবেদন করান। ফলে প্রায় দু’ঘণ্টা যে সাফাই তিনি দিলেন, তাতে অনেক ক্ষেত্রেই তিনি সংসদকে বিভ্রান্ত করেছেন। বিচারপতি হওয়ার পরেও অনিয়ম চালিয়ে গিয়েছেন। ফলে দুঃখজনক হলেও তাঁকে ইমপিচ করাই বাঞ্ছনীয়। |
|
|
|
|
|