|
|
|
|
রাজনৈতিক সাহসের অভাবেই ভুগছে কেন্দ্র |
জয়ন্ত ঘোষাল • নয়াদিল্লি |
রোগীর নাম: ইউএপি-২।
বয়স: আড়াই বছর।
অসুখ: দিশাহীনতা।
অসুখের লক্ষণ: অণ্ণা হজারের অনশনের ব্যর্থ মোকাবিলা।
চিকিৎসকের পরামর্শ: শক্তি সঞ্চয় করুন। প্রয়োজন স্ট্যামিনা। যাকে বলে রাজনৈতিক হিম্মৎ।
পরিণতি: রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে গিয়েছে প্রচণ্ড। তাই যখন তখন কাবু।
সনিয়া গাঁধী অসুস্থতার কারণে বিদেশে। এখনই যে তিনি দেশে ফিরতে পারছেন না, তা স্পষ্ট। কিন্তু তাঁর অনুপস্থিতিতে কে নিচ্ছেন চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত? সনিয়া বিদেশ যাওয়ার আগে একটি ছোট গোষ্ঠী তৈরি করে গিয়েছিলেন। আহমেদ পটেল, জনার্দন দ্বিবেদী, এ কে অ্যান্টনি ও রাহুল গাঁধী তার সদস্য। কিন্তু এখনও পর্যন্ত তাঁরা কোনও বৈঠকে বসেননি। প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে সাবেক কোর গ্রুপই এখনও মুশকিল আসান সংস্থা। এই গোষ্ঠীর সদস্যরা হলেন প্রণব মুখোপাধ্যায়, এ কে অ্যান্টনি, পি চিদম্বরম ও আহমেদ পটেল। কিন্তু দল ও সরকার কে কোন মত পোষণ করছে, তা নিয়ে স্বচ্ছতার অভাব রয়েই গিয়েছে।
সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসেবে অণ্ণাকে গ্রেফতার করার সিদ্ধান্ত সঠিকই ছিল বলে প্রধানমন্ত্রী দাবি করলেও বাস্তবে কংগ্রেস নেতারা বুঝতে পারছেন, গোটা সমাজে এই ঘটনার তীব্র নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া হয়েছে। অণ্ণা যে তিহার জেলে গিয়ে সেখানেই অনশন শুরু করে দেবেন এবং জেল ছেড়ে বেরোতে চাইবেন না, এটা চিদম্বরম-কপিল সিব্বলরা বুঝতেই পারেননি। অবস্থা এমন দাঁড়ায় যে, গোটা সরকারের মধ্যে এক ধরনের ভীতি সঞ্চারিত হয় গত কাল গভীর রাত থেকেই। গত কাল অণ্ণা নিয়ে সংসদে কোনও আলোচনা করতেই রাজি ছিল না সরকার পক্ষ। আজ ঐক্যবদ্ধ বিরোধীদের দেখে সরকার আলোচনার প্রস্তাব মেনে নেয়। দ্বিতীয়ত, আজ যন্তরমন্তর-জনপথে যে ভাবে অণ্ণার সমর্থনে মানুষের ঢল নামে, যে ভাবে সংবাদ মাধ্যম অণ্ণার সমর্থনে এগিয়ে আসে, তাতে কংগ্রেসের স্নায়ুর জোর আরও কমে যায়।
বিজেপি নেতা অরুণ জেটলি বলেন, “আমরা আইনজীবী। যখন আমরা রাজনীতিতে আসি, তখনও অনেক সময় আইনের পাঠ্য পুস্তক থেকে বেরোতে পারি না। আমরা আইনের অনুচ্ছেদ এবং তার নানা ধরনের বিধি ও যুক্তির কথাই শুধু মনে রাখি। কিন্তু বাস্তব রাজনীতি ভুলে যাই। রাজনীতির কৌশল গ্রহণের সময় জনমত কী বলছে, সমীক্ষার রিপোর্ট কী বলছে, সেটা ভুলে যাই।” আসলে পরিস্থিতিটা এমনই হয়ে গেল যে, লোকপাল বিল নিয়ে আজ আর কোনও আলোচনাই হচ্ছে না। আলোচনার বিষয়বস্তু হয়ে উঠেছে অণ্ণার গ্রেফতার। লোকপাল বিল নিয়ে বিজেপি যে বিরাট উৎসাহী ছিল, এমন নয়। লোকপালকে প্রবল ক্ষমতা অর্পণ করা নিয়ে আশঙ্কা বিজেপির মনেও আছে। কিন্তু আজ যেন সেটা আর কোনও বিতর্কের বিষয়ই নয়।
এই অবস্থায় কংগ্রেসের অনেকেই অণ্ণাকে গ্রেফতার করার কৌশলের বিরোধিতা করছেন। ঘটনা হল, এ দফায় গোড়া থেকেই অণ্ণা সম্পর্কে কড়া মনোভাব নিচ্ছিল কংগ্রেস। তাই ব্যক্তিগত ভাবে তাঁকে আক্রমণও করেন দলীয় মুখপাত্র। কিন্তু রাহুল দেশে ফিরে এ ব্যাপারে আপত্তি জানান। তখন অণ্ণার সমালোচনা বন্ধ হলেও সরকারের অবস্থান পাল্টায়নি। যার জেরে গত কাল তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। এমন নয় যে অণ্ণার গ্রেফতারির বিষয়টা রাহুল জানতেন না। কিন্তু কংগ্রেস মহল গোটা ঘটনার জন্য চিদম্বরমকেই দায়ী করছে। দলের অনেক নেতাই বলছেন, যে, গোড়ার দিকে চিদম্বরম এক তরফা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। কারণ দিল্লি পুলিশকে নিয়ন্ত্রণ করেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। তখন প্রণববাবুর সঙ্গে কোনও পরামর্শই করা হয়নি। এখন বিপাকে পড়ে কংগ্রেসের শীর্ষ নেতৃত্ব অবশ্য ফের প্রণববাবুর দ্বারস্থ। খোদ রাহুলও প্রণববাবুর সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে কথা বলেন।
কংগ্রেসেরই একটা বড় অংশ বলছে, অণ্ণা প্রসঙ্গে এতটা অনড় অবস্থান নেওয়াটা ঠিক হয়নি। এমনকী, গোড়ায় কড়া হয়ে পরে পরিস্থিতি বুঝে পিছিয়ে এলেও কিছু মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যেত না। রাজীব গাঁধী একদা প্রেস বিল পেশ করে সংসদে ও রাজপথে প্রবল বিক্ষোভের মুখে পড়েন। দু’-তিন দিন সংসদ অচল থাকার পর তিনি লোকসভায় এসে দুঃখপ্রকাশ করে বিলটি প্রত্যাহার করে নেন। তিনি বলেছিলেন, “আমার উদ্দেশ্য ভালই ছিল। কিন্তু আমি মানুষকে ও বিরোধী দলকে বোঝাতে ব্যর্থ হয়েছি। তাই এই বিল প্রত্যাহার করে নিচ্ছি।” সেই ঘটনায় রাজীবের ভাবমূর্তি বিন্দুমাত্র অনুজ্জ্বল হয়নি। এর পর নরসিংহ রাও বা অটলবিহারী বাজপেয়ীর আমলেও সরকার একাধিক বার এক কদম এগিয়ে দু’কদম পিছিয়েছে। আসলে ইগো, জেদ নিয়ে শাসক দলের রাজনীতি হয় না। সময় সময় আপসেরও প্রয়োজন হয়। কিন্তু এখন সরকার ও দলের মধ্যে সমন্বয়ের অভাবে সিদ্ধান্তগ্রহণে দিশাহীনতা প্রকট হচ্ছে।
সরকার পরিচালনা বা প্রশাসনিক দক্ষতার জন্য প্রয়োজন হয় শক্তপোক্ত রাজনৈতিক কর্তৃত্ব। প্রশাসন ও নেতৃত্ব দুর্বল হয়ে গেলে সদিচ্ছা থাকলেও সিদ্ধান্তের প্রয়োগের ক্ষেত্রে ভুল হয়। শীর্ষ এক কংগ্রেস নেতাই বলেন, রোগী দুর্বল, তাই রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে গিয়েছে। ফলে কথায় কথায় সর্দি-জ্বর হচ্ছে। ভাইরাল আক্রমণে কাবু হচ্ছে রোগী।
সংসদে আজ কংগ্রেস নেতারাও বলছেন, এই সরকারের মস্তিষ্কটা যেন মনে হচ্ছে হারিয়ে গিয়েছে। তা না হলে এমন একটা ‘নন ইস্যুকে’ ভুল রাজনীতির মাধ্যমে কংগ্রেস ‘ইস্যু’ করে তোলে! |
|
|
|
|
|