|
|
|
|
শরীরে ক্যানসার, তবু গবেষণা চালাতে চান ক্যানসার নিয়েই |
দেবারতি সিংহচৌধুরী • কলকাতা |
পর্বতকে যেতে হল মহম্মদের কাছে!
এ কাহিনিতে ‘মহম্মদ’ বছর ঊনত্রিশের সুমনা চট্টোপাধ্যায়।
বাড়িতে ক্যানসারে একের পর এক মৃত্যুমিছিল দেখেছেন এই তরুণী। নিজের গবেষণাতেও এই মারণ ব্যাধির উৎস খুঁজতে চেয়েছিলেন তিনি। ওরাল ক্যানসার নিয়ে গবেষণা করতে করতে তিনি নিজেই এখন ওরাল ক্যানসারে শয্যাশায়ী। সুমনার গবেষণাপত্রের মৌখিক পরীক্ষা নিতে শনিবার দুপুরে তাঁর কসবার বাড়িতে গিয়েছিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষকরা। গিয়েছিলেন, লড়াকু সুমনার জীবনতৃষ্ণাকে কুর্নিশ জানাতে।
দু’চোখে বিজ্ঞানী হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে বিছানায় তখন আধশোয়া সুমনা। উঠে বসার, হাঁটাচলার ক্ষমতা নেই। অস্ত্রোপচারে বাদ চলে গিয়েছে জিভ। খুব কাছে বসেও স্পষ্ট বোঝা যায় না তাঁর কথা। কিন্তু তা-ও তিনি নাগাড়ে বলতে থাকেন তাঁর স্বপ্নের কথা। ইচ্ছের কথা। তাঁর অনুপ্রেরণা, স্টিফেন হকিংয়ের কথা। হকিংয়ের ‘আ ব্রিফ হিস্ট্রি অফ টাইম’-এর পাতায় চোখ রেখে নিজেকে শক্তি দেওয়ার উৎসাহ খুঁজে পান, খুঁজে পান মা-ভাই-ঠাকুমাকে ভরসা দেওয়ার সাহস। |
|
মারণ রোগের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের সঙ্গেই চলছে সেই রোগকে আরও জানার চেষ্টা।-সুদীপ আচার্য |
চোখের সামনে দেখেছেন কোলন ক্যানসারাক্রান্ত বাবাকে তিল তিল করে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যেতে। দেখেছেন গলার ক্যানসারে হারিয়ে যেতে পিসিকে। শুনেছেন, ক্যানসারেই দুই দাদু-র (সুমনার বাবার দুই কাকা) মৃত্যুর কথা। একের পর এক এই মৃত্যুর কারণ খুঁজে পেতে চেয়েছিলেন গবেষণার মধ্যে। সুমনা দেখেছিলেন, পূর্ব ভারতে ওরাল ক্যানসারের প্রকোপ অনেক বেশি। কেন? নেপথ্য-ভিলেন কি তবে ‘জিন’? সুমনার অনুসন্ধানের বিষয় ছিল এটাই। রহস্যের উত্তর খোঁজার মাঝেই গত বছর জানুয়ারিতে সুমনার জিভের কোষে ছড়িয়ে পড়ল ক্যানসারের মারণ বিষ। “বাবা তখন কোমায়। আমার জিভে ওরাল ক্যানসার ধরা পড়ল। গবেষণা তখনও অনেকটা বাকি। কাজটা তাড়াতাড়ি শেষ করতে হবে, নিজেকেই নিজে তাগাদা দিতাম।” একটু থেমে সুমনা বলেন, “বিদেশে গিয়ে ক্যানসারের উপর আরও গবেষণা করার স্বপ্ন ছিল। জানি না, পারব কি না। এখন ল্যাবেও যেতে পারি না। এত কষ্ট আর সহ্য করতে পারছি না।”
গত সাত-আট মাস ধরে খাওয়া বন্ধ সুমনার। রাইলস টিউবে যেটুকু বা খেতেন, পর মুহূর্তেই বমি হয়ে যেত সব। গত নভেম্বরে দ্বিতীয় বার অস্ত্রোপচার হয় মুখে। আর তার পর থেকেই শয্যাশায়ী সুমনা। মা কৃষ্ণাদেবী বলছিলেন, “নাগাড়ে মুখ থেকে লালা গড়াত। এখন একটু কমেছে। রাইলস টিউব খুলে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এখনও যেটুকু খায়, বমি হয়ে যায়। না পারে শুতে, না বসতে।” হার মানেননি সুমনা। দু’বার অস্ত্রোপচার, রেডিয়েশন কেমোথেরাপির পরেও ভিড় বাস, মেট্রোয় চেপে ঘুরে বেড়িয়েছেন। ঘণ্টার পর ঘণ্টা গবেষণাগারে বসে তৈরি করেছেন তাঁর গবেষণাপত্র। “একটু হেঁটে আসি”, বলে চলে গিয়েছেন গোলপার্কের লাইব্রেরিতে। রাত জেগে কখনও হাতে লিখে, কখনও ল্যাপটপে লিখে একটু একটু করে তৈরি করেছেন গবেষণাপত্র। “খালি বলত, যেটুকু পারি, সেরে রাখি। যদি না শেষ করতে পারি!” কেঁদে ফেলেন কৃষ্ণাদেবী।
বরং হাসি লেগে থাকে সুমনার ঠোঁটেই, হাসি তাঁর দু’চোখে। মায়ের চোখে জল দেখে ধমকের সুরে বলেন, “সব সময় এত দুশ্চিন্তা কোরো না। সব ঠিক হয়ে যাবে। তোমরা এমন নেগেটিভ ভাবলে আমি ঠিক থাকব কী করে!”
নেতিবাচক নয়, ইতিবাচক ভাবতে চান সুমনার পিএইচডি ‘গাইড’ শীলা চক্রবর্তীও। মেডিক্যাল কলেজের ইনস্টিটিউট অফ হেমাটোলজি-র গবেষক শীলাদেবী ছাত্রীর পাশে বসে বলছিলেন, “অসুস্থ অবস্থাতেও ঘণ্টার পর ঘণ্টা ও ল্যাবে কাজ করত। এক বারও হতাশ হতে দেখিনি। নিজে আসতে না পারলে ই-মেলে আমায় লেখা পাঠাত। ওর শরীরের কথা ভেবে আমিও তাড়া দিতাম, কাজ দ্রুত শেষ করতে। ও সুস্থ হয়ে উঠুক, নিজের স্বপ্নকে ছুঁতে পারুক। এটাই চাই।” তিন বছরের মধ্যেই গবেষণার কাজ শেষ করেছেন সুমনা। গত এপ্রিলে জমা দেওয়া হয়ে গিয়েছে তাঁর গবেষণাপত্র। ল্যাপটপে সুমনার উৎসুক চোখ এখনও খুঁজে চলেছে দেশ-বিদেশে ক্যানসার গবেষণা-চিকিৎসার হাল হকিকৎ। এ বছরেই তো ক্যানসারের ইতিহাস নিয়ে বই লিখে আন্তর্জাতিক পুরস্কার জিতেছেন এক বাঙালি ক্যানসার-চিকিৎসক, সিদ্ধার্থ মুখোপাধ্যায়। তাঁর নিবাস, আমেরিকায়। সুমনাও চান, বিদেশে গবেষণা করতে। তাঁর বেশ কিছু লেখা ইতিমধ্যেই আন্তর্জাতিক জার্নালে বেরিয়েছে। সুমনা বলেন, “এখনও সুযোগ পেলে বিদেশে যেতে চাই। ওটাই আমার স্বপ্ন।”
সামনে বসে তখন সুমনার ভাই সুসীম। “প্রথম বার অস্ত্রোপচারের পরে একটা সময় দিদি ভাল হয়ে উঠছিল। একাই যাতায়াত করত। কিন্তু গত সাত-আট মাস ধরে বদলে গিয়েছে সব। কত ভাল গান গাইত। কত কিছু খেতে ভাল বাসত। কিন্তু এখন কিছুই খেতে পারে না।” কী খেতে সব থেকে ভালবাসতেন? প্রশ্ন শুনে মুচকি হাসলেন সুমনা। ভাই পাশ থেকে বললেন, ‘ইলিশ’।
ভরা বর্ষায় সে তো সব বাঙালিরই পছন্দ। কথাটা শুনেই জানলার দিকে তাকিয়ে সুমনা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। বাইরে তুমুল বৃষ্টি। সুমনা বললেন “কিন্তু সেটা হয়তো আমার জন্য নয়!” |
|
|
|
|
|