|
|
|
|
জঙ্গি অধ্যুষিত ঝালদায় নয়া বিপ্লব, সশস্ত্র নয়, কৃষির |
ঋজু বসু • ঝালদা |
কয়েক মাস আগে মাওবাদী হামলায় পঞ্চায়েত প্রধান-সহ সাত জন ফরোয়ার্ড ব্লক নেতা-কর্মীর খুনের ঘটনায় শিরোনাম হয়েছিল এই ঝালদা-দাঁড়দা অঞ্চল। যে ঘটনার সৌজন্যে খোদ রাজ্যপালের পদার্পণ ঘটে রাজ্যের এই প্রত্যন্ত সীমায়। ঝাড়খণ্ড লাগোয়া পুরুলিয়ার এই ঝালদা এক নম্বর ব্লকে ঘুরে গিয়েছেন নতুন সরকারের খাদ্যমন্ত্রীও। গ্রামের দরিদ্রতম মানুষদের অনাহারের ঘটনা রুখতে স্থানীয় প্রশাসনকে সতর্ক থাকতে বলে গিয়েছেন তিনি।
জঙ্গিদের ‘সশস্ত্র বিপ্লবের’ এ হেন চারণ-ভূমিতে কিন্তু এই গ্রামবাসীরা আর একটি নিঃশব্দ ‘বিপ্লব’ ঘটিয়ে ফেলেছে। কৃষি বিপ্লব! বৃষ্টির আকাল, অনুর্বর জমি আর সীমাহীন দারিদ্রের ত্রিমুখী প্রতিকূলতা ঠেলে ধান ফলানোর চেষ্টায় ক্লান্তি নেই লক্ষ্মীকান্ত মাহাতো, সোমবারি মাহাতো বা শকুন্তলা মাহাতোদের। গত দু’বছরের খরার ধাক্কা এখনও ফিকে হয়নি। কিন্তু সিকিভাগ পুঁজিতে, ন্যূনতম বীজ-সারের ব্যবহারে, প্রায় দ্বিগুণ ফসলের ধান চাষের এক নয়া কসরত হাসি ফোটাচ্ছে ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষিদের মুখে। পাহাড়-জঙ্গলের কোলে অর্জুনডি গ্রাম থেকে শুরু করে পাশের মাওবাদী গণহত্যা-খ্যাত গ্রাম গুটিলোয়া, বাগবিন্ধ্যা, চিরুটাঁড়-সহ এই অঞ্চলের গাঁয়ে গাঁয়ে ধান রোয়ার মরশুমে একটি নামই মুখে মুখে ফিরছে। শ্রী-সিস্টেম অব রাইস ইনটেনসিফিকেশন (এসআরআই-শ্রী)। কৃষিবিজ্ঞানীদের গবেষণাগারে নয়, নিছকই চাষির খেতের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতেই শ্রী-র উদ্ভব। হায়দরাবাদের কেন্দ্রীয় ধান্য উন্নয়ন অধিকরণের (ডিরেক্টরেট অফ রাইস ডেভেলপমেন্ট--ডিআরডি) প্রিন্সিপাল সায়েন্টিস্ট মহেন্দ্র কুমারের মতে, বীজের আকাশছোঁয়া দামের সমস্যা মেটাতে সরকারি গবেষণাগারে তৈরি এই ‘শ্রী’ বীজের বিকল্প নেই। তবে বীজের পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ শ্রী-চাষের পদ্ধতিও। মহেন্দ্র কুমারের কথায়, “এক লক্ষ হেক্টরে শ্রী-পদ্ধতির চাষে ৮০ শতাংশ বীজ কম লাগে। মানে ১০০ কোটি টাকার সাশ্রয়। হেক্টরপিছু পাঁচ কেজি বীজই যথেষ্ট। ধানের ফলনও কম করে ২৫-৫০ শতাংশ বেশি।”
ধানের উৎপাদন বাড়াতে দেশ জুড়ে খাদ্য-সঙ্কটের পটভূমিতে জাতীয় খাদ্য নিরাপত্তা মিশন শ্রী-কে গুরুত্ব দেওয়ার নীতি ঘোষণা করেছে। কম জল ব্যবহার করে চাষের প্রসারে শ্রী-র হয়ে সওয়াল করছে কেন্দ্রীয় জলসম্পদ মন্ত্রকও। তামিলনাডু, অন্ধ্রপ্রদেশ বা বিহার সরকার ইতিমধ্যেই রাজ্যের কয়েক লক্ষ হেক্টর জমিতে শ্রী-ধানের চাষে উদ্যোগী। ছোট রাজ্য ত্রিপুরার ৫০ শতাংশ জমিতেই শ্রী-পদ্ধতির শোভা। তবে পশ্চিমবঙ্গে ৩৪ বছরের বাম-জমানার ‘ভিত্তি’, কৃষি নিয়ে যাবতীয় ঢক্কা-নিনাদ সত্ত্বেও সরকারি স্তরে প্রত্যাশিত উদ্যম দেখা যায়নি। তৃণমূল সরকারের আমলেও এখনও পর্যন্ত শ্রী নিয়ে নির্দিষ্ট নীতি বা লক্ষ্যমাত্রা নেই। |
বিস্তারিত... |
তবে সরকারি উদ্যমের অভাবের এই অভিযোগ মানতে চাননি রাজ্যের কৃষি অধিকর্তা সার্থক বর্মা। সার্থকবাবুর কথায়, “জেলায় জেলায় চাষিদের মধ্যে শ্রী-র প্রচার চলছে। সরকারি উৎসাহে বারাসতের ব্লকে ব্লকে শ্রী-বিধিতে জোরদার চাষ হচ্ছে। রাজ্যের সাড়ে ১২ হাজার হেক্টর জমি এখন শ্রী-র আওতায়।” বেশ কয়েকটি রাজ্যের সঙ্গে তুলনায় এই ‘সাফল্য’ অবশ্য নগণ্য। বিধানচন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে শ্রী-র প্রচার করে গিয়েছেন ডিআরডি-র অধিকর্তা মূলচাঁদ দিবাকর। তাঁর কথায়, “পশ্চিমবঙ্গে শ্রী-র প্রসারে আরও কর্মী দরকার। পুঁজি কম লাগলেও এই কৌশলে চাষিদের বিশেষ তালিম চাই। সরকারের সঠিক পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া খুব বেশি সংখ্যক চাষির কাছে পৌঁছনো সম্ভব নয়।”
বেসরকারি সংস্থার সাহায্যে শ্রী-র প্রয়োগ শিখে পুরনো কৃষিপদ্ধতিতে এখন ফিরতে নারাজ ঝালদার অর্জুনডি গ্রাম। গত দু’বছর বৃষ্টি না-হওয়ায় চাষ মার খেয়েছে। কিন্তু তার আগের বছরে যা ধান ফলেছিল তা বিক্রি করে ও খেয়ে খরার এই সময়টা, প্রায় পুরোটাই উতরে দিয়েছেন মাত্র ছ’বিঘে জমির মালিক মানিক মাহাতো ও তাঁর পরিবার। শ্রী-বিধিতে গাদাগাদি করে না-বসিয়ে অন্তত ১০-১২ ইঞ্চি ফাঁক রেখে ধান চারা রোপনের নিয়ম। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই পদ্ধতিতে অনেক কম রাসায়নিক সারে আলো-হাওয়া ও মাটির পুষ্টিতেই ধানগাছের বাড় ভাল হয়। এর পরিণতি, অনেক বেশি ধানে সমৃদ্ধ চার গুণ শাখা-প্রশাখা বা ৪০ থেকে ৭০টি পাশকাঠি-সহ স্বাস্থ্যবান এক-একটি ধান গাছ।
ফসলের এই শ্রী-তে অন্য সামাজিক বার্তাও পৌঁছচ্ছে গ্রামে। গাঁয়ের বধূ সোমবারি দেবীর কথায়, “এখন বুঝছি, গাদাগাদির সংসারের দুবলা-পাতলা বাচ্চাদের তুলনায় ছোট পরিবারের একটি-দু’টি শিশু কেন ভাল স্বাস্থ্যের হয়!” |
|
|
|
|
|