|
|
|
|
ভাওয়াল সন্ন্যাসীর মতোই চাঞ্চল্যকর ফেরা ও পরিণতি |
গৌতম ভট্টাচার্য • কলকাতা |
রাহুল দ্রাবিড় ওয়ান ডে থেকে এত দিন অবসর নেননি এ জন্য নয় যে, আবার তিনি ভারতীয় দলে ফেরার আশা দেখছিলেন।
অবসর নেননি একমাত্র এ জন্য যে, সেই সিদ্ধান্তটার কোনও মানে হত না। কেউ মারা যাওয়ার পাঁচ বছর বাদে তাঁর পরিবারবর্গ কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়ে বলে না, অমুক মারা গিয়েছেন। তদ্দিনে সবার জানাই হয়ে যায়। কোনও কাগজও পাঁচ বছর বাদে শোকগাথা বার করে না। স্বাভাবিক জনজীবনে রাহুলও এক জন। আর সামান্য পরিচিতেরাও জানে, অর্থহীন লোক হাসানো ব্যাপারে অন্তত রাহুল দ্রাবিড়ের কোনও রুচি নেই।
দ্রাবিড়ের ওয়ান ডে কেরিয়ারের যে শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়ে গিয়েছিল সেটা ২ এপ্রিল রাতে আতসবাজিগুলো ওয়াংখেড়ের আকাশে ওঠার অনেক আগেই সবাই জানত। নিছক ক্রিকেটীয় তুলনা-টুলনায় তাই বিশ্বের সবচেয়ে বেশি বয়সি ক্রিকেটারের এমন আধিদৈবিক ওয়ান ডে কামব্যাকের পাশে রাখার মতো কাহিনি নেই।
রাহুল শনিবার দুপুরে চেন্নাইতে ফিরে এলেন যেমন চমকপ্রদ ভাবে তেমনই বিয়োগান্তের রেশ টেনে নর্দাম্পটনের প্রেস কনফারেন্সরুমে জানালেন, এই শেষ। আর কখনও ভারতের হয়ে ওয়ান ডে খেলবেন না। সাংবাদিকরা কেউ আঁচই পাননি হঠাৎ করে লিখিত বিবৃতি নিয়ে দ্রাবিড় আবির্ভূত হবেন। তিনি একই সঙ্গে জানিয়ে দেন, টি টোয়েন্টি ক্রিকেট থেকেও অবসর নিচ্ছেন। তার মানে কী আইপিএলও? কেউ জিজ্ঞেস করার সুযোগই পাননি। দিনটা শুরু হল যেমন রোমাঞ্চকর ভাবে। তাঁকে শিরোনামে এনে। শেষটাও হল মাত্র কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে ইংল্যান্ডের মাটিতে।
জনজীবন থেকে তুলনা টানতে হলে? সেই ভাওয়াল সন্ন্যাসীর মতো। লোকচক্ষুতে ১৯০৯ সালে মৃত ভাওয়ালের মেজকুমার রমেন্দ্র নারায়ণ চৌধুরির যেমন অত্যাশ্চর্য প্রত্যাবর্তন ঘটেছিল ১৯২১ সালের জনজীবনে। এমনকী প্রিভি কাউন্সিল তাঁর স্বপক্ষে রায়ও দিয়ে দেয় দীর্ঘ মামলা চলার পর। তখন ডিএনএ পরীক্ষার চল না থাকায় সেই রিপোর্টকেই ধরা হয়েছিল চূড়ান্ত। যদিও তাঁর স্ত্রী মেনে নিতে
চাননি। রায় বেরোবার দু’দিন বাদে যখন জনসমক্ষে প্রমাণ হয়ে গিয়েছে তিনিই প্রকৃত ভাওয়ালের মেজকুমার তখন মেজকুমার মারা যান। অতি চমকপ্রদ কাহিনীর অতিনাটকীয় সমাপ্তি।
এ যেন ভাওয়াল সন্ন্যাসীরই ক্রিকেটীয় প্রত্যাবর্তন! সবাই অবাক হয়ে ভাবছে, এ-ও কী করে সম্ভব? দু’বছর আগে যাঁকে কামব্যাক করিয়ে ছুড়ে ফেলে দেওয়া হয়েছিল, কেউ জানত না তাঁকে দিয়ে এই উনচল্লিশ ছুঁইছুঁই বছরে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন টিমের কোনও কাজ হতে পারে। এমনকী শনিবার চেন্নাইয়ের বৈঠকে বসার আগে নির্বাচকেরাও জানতেন না। দল গড়তে গড়তে হঠাৎ করে তাঁরা আবিষ্কার করেন, যুবরাজ নেই। গৌতম গম্ভীর ইংল্যান্ডে তেমন অভিজ্ঞ নন। সহবাগ চোট সারিয়ে ফিরছেন। ধোনির ফর্ম নেই। তা হলে খেলবে কে? ধরবে কে?
কেন? দ্রাবিড়! সাধারণত এ রকম নাটকীয় সিদ্ধান্তের পশ্চাদপটে সিনিয়র ক্রিকেটার হলে তাঁর সঙ্গে আগাম কথা বলে নেওয়ার ব্যাপারটা থাকে। থাকে বিপদ এড়াতে। মনে করা যাক, নির্বাচকেরা নিলেন। রাহুল বলে দিলেন, আমি আর ওয়ান ডে খেলতে চাই না। তখন চূড়ান্ত হাস্যকর হতে হবে কমিটিকে।
অথচ এ ক্ষেত্রে সেই সতর্কতাও নেওয়া হয়নি। বৈঠকের আগে যেহেতু শ্রীকান্তরা ভাবেনইনি রাহুলের কথা। বৈঠক শেষে সব সইসাবুদ যখন হয়ে গিয়েছে, এক নির্বাচক বলেন, “রাহুল যদি নর্দাম্পটনে চেয়ারে বসে থাকা অবস্থায় টিমটা শোনে ও নির্ঘাৎ বিস্ময়ে উল্টে পড়ে যাবে।” শুনে বাকিরা হাসতে থাকেন, “ঠিক কথা।” তখন নির্বাচকেরা কল্পনাও করেননি যে রাহুলের কাছ থেকে মর্যাদাব্যঞ্জক প্রত্যাঘাত আসতে পারে। তিনি মনে করিয়ে দিতে পারেন, আমাকে যখন বিশ্বকাপের প্রাথমিক দলেও রাখার প্রয়োজন মনে করনি, তখন আজ তোমাদের স্বার্থের দয়ার দান আমি চাই না।
গত বিশ্বকাপের সময়কার ছবিগুলো এখন প্রত্যক্ষদর্শীদের কাছে কেমন আশ্চর্য আর অবাস্তব লাগতে শুরু করেছে। বিশ্বকাপে বেঙ্গালুরুতে সবচেয়ে বেশি সময় কাটিয়েছে ভারত। আর প্রতিদিনই সেখানে ছিলেন দ্রাবিড়। জেনে নিতেন ধোনির ভারত কখন আসবে। আর তার দু’ঘণ্টা আগে নেটে আবির্ভূত হতেন নিজে। স্থানীয় দু’চার জন বোলার থাকত। ঠিক যে সময় থেকে টিভি ক্যামেরার ভিড় জমতে শুরু করার কথা সেই সময়ে ন্যাশনাল ক্রিকেট অ্যাকাডেমিতে চান-টান সেরে ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে যেতেন। তাঁর ব্যাট করার ছবি তাই কোনও ক্যামেরায় ওঠেনি। কিন্তু সেই প্র্যাক্টিসও ছিল খানিকটা আইপিএলমুখী। তার চেয়েও বেশি ওয়েস্ট ইন্ডিজে টেস্ট খেলতে যাওয়ার প্রস্তুতি। ইংল্যান্ডে দিন কয়েক কাউন্টি খেলবেন কি না এমনও ভাবছিলেন রাহুল। স্রেফ ম্যাচ প্র্যাক্টিসটা ঝালিয়ে নেওয়ার জন্য।
২০০৯-এর সেপ্টেম্বরে দক্ষিণ আফ্রিকায় চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে ব্যবহার করে প্রয়োজন ফুরোতেই রাহুলকে ছুড়ে ফেলে দেওয়া হয়েছিল। এ বারও কি একই স্কিম? ইউজ অ্যান্ড থ্রো? ইংল্যান্ড থেকে ফিরে দেশের মাঠে ওয়ান ডে সিরিজ। বিপক্ষে এই ইংল্যান্ড। তদ্দিনে যুবরাজ সুস্থ হয়ে যাবেন। ইউসুফ পাঠানকে ঘরের মাঠে স্যামসনের মতো লাগবে। তখন প্রয়োজন হবে রাহুলকে? শনিবার দুপুর দুপুর চেন্নাইতে ফোন করার পর একজন তখন বলেছিলেন, “ইউজ অ্যান্ড থ্রো করাটা খারাপ হয়েছিল। তবে এ মুহূর্তে ওকে নিয়ে বিশেষ কিছু ভাবিনি। এখন ইংল্যান্ডের পিচে ব্যাট হাতে দাঁড়ানোর লোক দরকার। সেটা যে পারবে তার যত বয়সই হোক সে খেলবে।”
বাধা আসতে পারত একটা মহল থেকে। স্বয়ং ভারত অধিনায়ক থেকে। বাতাবরণ যা ছিল, তাঁর আপত্তি এলেও অগ্রাহ্য হত। তবে এ দিন মহেন্দ্র সিংহ ধোনিকে রাহুলের নাম বলা হলে তিনি কোনও প্রতিক্রিয়া দেননি। কোনও কোনও নির্বাচকের মনে হয়েছে, ০-২ না হয়ে সিরিজ ২-০ থাকলে নিশ্চয়ই প্রতিক্রিয়া দিতেন। রাহুল এত দিন ছিলেন বিশ্বের সবচেয়ে বেশি বয়সি টেস্ট ক্রিকেটার। এখন হয়ে গেলেন উনচল্লিশ ছুঁইছুঁই বয়সে আধুনিক আমলের প্রবীণতম ওয়ান ডে ক্রিকেটার। যা সাবেক আমলে সেই পঞ্চাশ বছরে টেস্ট ক্রিকেট খেলার মতো। ব্যাটসম্যানরা যাঁরা ওয়ান ডে টিমে থাকবেন মোটামুটি জানেন, তাঁরা লম্বা সফরে গেলে ওয়ান ডে-র জন্য অপেক্ষাকৃত হাল্কা ব্যাটও নিয়ে যান। টেস্ট ক্রিকেটের তুলনায় প্যাডও ব্যবহার করেন অনেক লাইট। নর্দাম্পটন ড্রেসিংরুমে থাকা রাহুলের কিটসে সেগুলো থাকার কথা নয়। এবং সম্ভবত আগামী কয়েক সপ্তাহে বেঙ্গালুরুর বাড়ি থেকে আমদানি করতে হবে।
তবে এ বারই শেষ। রাহুল তো জানিয়েই দিলেন খেলবেন না। এটা নির্বাচকদের কাছে ব্রেসনানের লাফিয়ে ওঠা বাউন্সারগুলোর মতো লাগবে।
ন্যাশনাল অ্যাকাডেমিতে সেই প্র্যাক্টিসের সময় তো বটেই। বিশ্বকাপ জেতার পর আরও বেশি করে। দ্রাবিড়ের দীর্ঘতম সুস্বপ্নেও কখনও ওয়ান ডে টিমে কামব্যাক আসেনি। ভাগ্যের বিভিন্ন বিপর্যস্ত অবস্থা যাঁকে সবচেয়ে বেশি তাড়া করেছে। যিনি বারবার কর্ণের সঙ্গে তুলনীয় হয়েছেন। তিনিই ক্রিকেটজীবনের প্রান্তে এসে শ্রীকান্তদের হাত থেকে লটারির টিকিটটা পেলেন। আবার সেটা ফিরিয়েও দিচ্ছেন এই বলে যে, এ বারের সিরিজের পর টিকিটটা অন্য কাউকে দিও।
দস্তুর ছিল এতকালের যে, রাহুল খেলবেন অথচ বিস্মৃত হয়ে যাবেন কারও না কারও কীর্তিতে। এ দিন ঠিক উল্টো। দুপুর থেকে রাত, তিনিই শিরোনাম। হরভজন সিংহ বাদ গেলেন ওয়ান ডে টিম থেকে। এত বড় সিদ্ধান্ত পিছনে চলে গেল। সচিন তেন্ডুলকর বিশ্বকাপের পর ওয়ান ডে থেকে অবসর নেবেন ধরা হয়েছিল। কার্স্টেন বলেওছিলেন, সচিন অবসর নেবেন। তিনি দলে থাকলেন। মানে আরও ওয়ান ডে খেলবেন। অথচ কারও কোনও কৌতূহল নেই। যাবতীয় চাঞ্চল্য, জল্পনা এবং কৌতূহল প্রচারের আলো থেকে দূরে থাকতে চাওয়া বেঙ্গালুরুবাসীকে ঘিরে।
সাধারণ ভাবে বলে, ক্লাস ইজ পার্মানেন্ট, ফর্ম ইজ টেম্পোরারি। রাহুলের ওয়ান ডে মৃত্যুর পর প্রত্যাবর্তন প্রমাণ করল, দক্ষতাই দীর্ঘস্থায়ী। ওয়ান ডে স্ট্রোক ক্ষণস্থায়ী। আরও হয়তো প্রমাণ করল, স্ট্রোকের টাইমিংয়ে রাহুল অসাধারণ। ক্যাপ্টেন্সি ছেড়ে দিয়েছিলেন এই ইংল্যান্ডেই সিরিজ জিতে, ওয়ান ডে প্রত্যাবর্তনের পর আবার জানিয়ে দিলেন, থাকল তোমাদের ওয়ান ডে ড্রেসিংরুম। এ বারের পর আমি চললাম। আর আমাকে অপমানের সুযোগ পাবে না।
|
মহানাটকীয় নিষ্ক্রমণের সিদ্ধান্তও |
|
শেষ ছয় ওয়ান ডে |
• ১৪ বনাম নিউজিল্যান্ড (কলম্বো), সেপ্টেম্বর’০৯
• ৪৭ বনাম শ্রীলঙ্কা (কলম্বো), সেপ্টেম্বর’০৯
• ৩৯ বনাম শ্রীলঙ্কা (কলম্বো), সেপ্টেম্বর’০৯
• ৭৬ বনাম পাকিস্তান (সেঞ্চুরিয়ন), সেপ্টেম্বর’০৯
• ব্যাট করেননি বনাম অস্ট্রেলিয়া (সেঞ্চুরিয়ন) সেপ্টেম্বর’০৯
• ৪ বনাম ওয়েস্ট ইন্ডিজ (জোহানেসবার্গ) সেপ্টেম্বর’০৯ |
ওয়ান ডে জীবন |
ম্যাচ ৩৩৯ ইনিংস ৩১৩ রান ১০৭৬৫ সর্বোচ্চ ১৫৩ বনাম নিউজিল্যান্ড (হায়দরাবাদ,’৯৯) গড় ৩৯.৪৩ স্ট্রাইক রেট ৭১.১৭ সেঞ্চুরি ১২ |
|
পুনশ্চ: শনিবার অত্যাশ্চর্য নির্বাচনী দুপুর থেকে বেরিয়ে চেন্নাইতে দাঁড়ানো কোনও কোনও নির্বাচকের মনে পড়ছিল সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের কথা। অপেক্ষারাহুলকে এমনকী ওয়ান ডে-তেও মর্যাদাযুদ্ধ জিতিয়ে দিল। ওয়ান ডে-তে অনেক বেশি ম্যাচ জেতানো সৌরভের কি আরও অপেক্ষা করা উচিত ছিল? সৌরভ মনে করেন, পরিস্থিতি তাঁকে এমন ক্রুদ্ধ করেছিল যে, আবেগ তাঁকে ২০০৮-এ অবসর নিতে বাধ্য করে। ভারতীয় ক্রিকেট ইংল্যান্ডের মাঠে রাহুল প্রতিবার ওয়ান ডে ক্রিজে নামার সঙ্গে হয়তো মনে করবে, ধৈর্য কি তাঁর বাঁ-হাতির বন্ধুর প্রত্যাবর্তনটাও করাতে পারত? নাকি ক্রিকেট-রাজনীতি এমন ডেলিভারি যে, সেখানে ভাওয়ালের মেজকুমারও মামলা হারবেন। সৌরভ তো কোন ছার! তবে শনিবার রাতের সৌরভ হয়তো মনে মনে বলবেন, ফ্রেন্ড ওয়েল প্লেড। ওদের এটাই পাওনা ছিল। |
|
|
|
|
|