|
|
|
|
শহরের শব্দে হারিয়ে যাচ্ছে পাখির মিলনের ডাক |
রাহুল রায় • কলকাতা |
এ পারে মুখর কেকা। ও পারে নীরব কুহু। কেউ শোনে না কারও সোহাগের ডাক। শহরের বিপুল শব্দে চাপা পড়ে যাচ্ছে মিলনের ইশারা। বসন্ত থেকে বর্ষা— প্রজননের ভরা মরসুমে সঙ্গিনীকে দিনভর বার্তা পাঠিয়েও মিলছে না কাঙ্ক্ষিত সাড়া।
তাই সুর বদলে ফেলেছে দোয়েল, খঞ্জন। নিচু তারের বদলে ওরা সুর বাঁধছে উঁচু তারে। বদলে ফেলছে আলাপচারিতার সময়ও। দিন-দুপুরের সুরেলা শিসের বদলে কলকাতার ফিঙেরা যেমন বেছে নিয়েছে রাতের নিরালাকে। দোয়েল-শ্যামার সুরের অনুকম্পন আর তেমন মিহি নয়। তাদের আলাপচারিতা এখন অনেক উচ্চগ্রামে বাঁধা। বেশ কয়েক বছর সমীক্ষা করে এমনই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন পক্ষী বিশেষজ্ঞ বিশ্বজিৎ রায়চৌধুরী। তিনি বলেন, “কলকাতায় এবং তার লাগোয়া জলাভূমি এলাকায় গত দশ বছরে পাখিরা ফিরতে শুরু করেছিল। দোয়েল, শ্যামা, ঘুঘুর সঙ্গে কুবো, ছাতারে, মরাঠি কাঠঠোকরা কিংবা দু-তিন রকমের মাছরাঙা ফের চোখে পড়তে শুরু করেছিল। কিন্তু ২০০৫ সালের পর থেকে শহরে যানবাহনের সংখ্যা হু হু করে বাড়তে শুরু করে। সেই সঙ্গে ই এম বাইপাস কিংবা বেহালা এলাকায় পাল্লা দিয়ে উঠতে শুরু করেছে বহুতল। এই কর্মযজ্ঞে বিপুল শব্দের আধিক্যে ক্রমেই হারিয়ে গিয়েছে পাখিদের শিস। পরস্পরকে খুঁজে নিতে যা ছিল তাদের এক মাত্র ভরসা।” |
|
প্রায় একই অভিজ্ঞতা বিশিষ্ট পক্ষীবিদ জর্জ ম্যাকার্থির। আন্তর্জাতিক এক পক্ষী সংগঠনের পক্ষ থেকে প্রায় দু’ বছর ধরে কলকাতা ও সংলগ্ন এলাকায় সমীক্ষা চালিয়ে তাঁর মন্তব্য, “দিনে নয়, অবাক লেগেছিল কলকাতায় পাখিদের রাতের কোলাহল শুনে। রাত তিনটেতেও শুনেছি ফিঙের (কমন ড্রঙ্গো) নিরবচ্ছিন্ন আলাপচারিতা। এক-দু’দিন নয়, মাসের পর মাস। মাছরাঙাদেরও (কমন ব্লু-কিংফিশার) দেখেছি, রাত জেগে পরস্পরের বার্তা বিনিময়। মজার ব্যাপার, এরা কেউ-ই কিন্তু রাতচরা নয়।”
তাঁর পর্যবেক্ষণ বলছে, দিনের শব্দময় শহরে অধরাই থেকে যাচ্ছে পাখিদের পরস্পরের বার্তা। তিনি বলেন, “কলকাতার অন্তত দু’টি এলাকায় সোনোমিটারে ধরা পড়েছে যে, মৌটুসি (পার্পল রাম্পড সানবার্ড) কিংবা বসন্তবৌরির (কপার স্মিথ বার্বেট) স্বরনিক্ষেপের তীক্ষ্নতা অনেক বেড়ে গিয়েছে।” কেন? তাঁর ব্যাখ্যা, সঙ্গীর কাছে বার্তা পৌছে দিতেই গলার স্বর অনেক উঁচুতে বেঁধে রাখছে পাখিরা। কলকাতা অবশ্য ব্যতিক্রম নয়, অস্ট্রেলিয়ার ক্যানবেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক দল গবেষক এবং বোম্বে ন্যাচারাল হিস্ট্রি সোসাইটির দুই পক্ষীবিদের রিপোর্টও বলছে গত দশ বছরে বিশ্ব জুড়েই শব্দ-শাসনে জেরবার হয়ে পড়েছে পাখির সুর।
বিশ্বজিৎবাবু বলেন, “চলতি দশকের গোড়াতেও কলকাতা বিমানবন্দর এবং তার আশপাশের পাড়াগুলো খঞ্জন, শ্যামা, গ্রিন বি-ইটারের ডাকে মুখর হয়ে থাকত। কিন্তু ক্রমেই বিমান ওঠানামা বেড়ে যাওয়ায় শব্দও বেড়ে গিয়েছে। ফলে পাখির ডাক হারিয়ে গিয়েছে। পূর্ব কলকাতার জলাভূমিগুলিতে ডাহুক, জাকানা কিংবা মুরহেন-এর (জলমুরগি) অনর্গল বকবক শোনা যেত বছর দশেক আগে। সেই সব জলা যে একেবারে হারিয়ে গিয়েছে, এমন নয়। কিন্তু ভোররাত থেকে যানবাহনের স্রোত এলাকায় শব্দের পরিমাণ প্রায় দ্বিগুণ করে দিয়েছে। ফলে সেই সব জলমুরগিরা অন্যত্র সরে গিয়েছে।”
শব্দদানবের এই চেহারাটা যে তাঁকেও অস্বস্তিতে রেখেছে, অকপটেই জানাচ্ছেন পরিবেশমন্ত্রী সুদর্শন ঘোষদস্তিদার। তিনি বলেন, “শব্দদূষণ যে বেড়েছে, অস্বীকার করে লাভ নেই। কিন্তু ব্যাপার কী জানেন? আমরা তো আইন ভাঙলে কাউকে গ্রেফতার করতে পারি না। সেটা পারে পুলিশ। ওঁদের সঙ্গে এ ব্যাপারে শিগগিরই বৈঠক হবে।’’
দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ কলকাতা ও শহরতলির মোট ৬টি জায়গায় দূষণ পরিমাপক সোনোমিটার বসিয়েছে। পাঁচ বছর আগেও সে যন্ত্রে শব্দ-মাত্রা ছিল ৬৫-৭০ ডেসিবেল। চলতি বছরের রেকর্ড বলছে ৮৭-৯০ ডেসিবেল। সকাল সাড়ে আটটার পর থেকেই যা ক্রমশ বাড়তে থাকে। সন্ধে সাড়ে সাতটাতেও বাইপাসের চিংড়িঘাটা বা ময়দানের ডোরিনা ক্রসিংয়ে শব্দ-পরিমাপ করে দেখা গিয়েছে ৮৫ ডেসিবেলের কম নয়। কলকাতা ট্র্যাফিক পুলিশ সূত্রে মিলেছে আরও একটি তথ্য। শহরে বেআইনি হর্নের আধিক্য। চেষ্টা করেও পুলিশ যে এ ব্যাপারে বিশেষ সফল হয়নি, তা স্বীকার করছেন কলকাতা পুলিশের এক পদস্থ কর্তা।
পুলিশি স্বীকারোক্তি পাখির কানে পৌঁছবে না। পৌঁছলেও কিছু যায় আসে না। পাখিরা একটু নিরালা খুঁজছে। সঙ্গীর সঙ্গে খুনসুটি করার। |
|
|
|
|
|