|
|
|
|
চক্ররেলে আটক যাত্রীরা, বেআব্রু বিপর্যয় মোকাবিলা |
নিজস্ব সংবাদদাতা |
বাইরে তুমুল বৃষ্টি। লোকাল ট্রেনটার জানলাগুলো তাই বন্ধ। বন্ধ আলো-পাখা। লাইনের উপরে জমে থাকা এক কোমর জলে ডুবে ট্রেনটাই বিগড়ে গিয়েছে। ভ্যাপসা গরমে গলদঘর্ম যাত্রীরা। লাইনে জমা জলে ভাসছে মলমূত্র, আবর্জনা। দু’পাশে খাড়া দেওয়াল। ভয়ানক দূষিত বাতাসে দম আটকে আসছে। এ ভাবেই থাকতে হচ্ছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। অসহায়ের মতো চিৎকার করেও লাভ কিছুই হচ্ছে না।
শনিবার সকালে মাত্র এক পশলা বৃষ্টির পর মহাকরণ থেকে ঢিল ছোড়া দূরত্বে মল্লিকঘাট ফুলবাজারের কাছে বিকল হয়ে পড়ে ওই চক্ররেল। তার পর শ’খানেক যাত্রীর এই ভয়াবহ অভিজ্ঞতাই বুঝিয়ে দিল ‘বিপর্যয় মোকাবিলা’ নিয়ে সরকারের ঢক্কানিনাদ কতটা ঠুনকো।
বেলা ১১টা থেকে টানা সাড়ে পাঁচ ঘণ্টা ওই ট্রেনে বন্দি রইলেন যাত্রীরা। তাঁদের অভিযোগ, বারবার ফোন করা সত্ত্বেও রেল বা পুলিশের তরফে কেউ ঘটনাস্থলে আসেনি। হাওড়া-শিয়ালদহে ফোন তোলেনি কেউ। আর লালবাজার শুধু হাওড়া স্টেশনের একটা ফোন নম্বর জানিয়েই দায় সেরেছে। শেষ পর্যন্ত বিকেল সাড়ে চারটে নাগাদ দমকল ও স্থানীয় মানুষ যখন ব্যারাকপুর থেকে মাঝেরহাটগামী ওই ট্রেনের যাত্রীদের উদ্ধার করলেন, তখন তাঁদের ধৈর্য শেষ সীমায় পৌঁছেছে। অসুস্থও হয়ে পড়েছেন কয়েক জন।
আসলে ট্রেন থেকে নামার কোনও সুযোগই ছিল না যাত্রীদের। কারণ, কোথায় কতটা জল জমে রয়েছে, তা বোঝার উপায় নেই। জমা জলে সাপও ঘুরছিল। তাই সাহস করেননি কেউ। সঙ্গে থাকা পানীয় জলটুকুও শেষ হয়ে যাওয়ার পরে চিৎকার শুরু করেন যাত্রীদের একাংশ। তা শুনে স্থানীয় কিছু মানুষ লম্বা পাটাতনের সাহায্যে কোনও রকমে যাত্রীদের হাতে চা-জল পৌঁছে দেন। নিমেষে তা শেষ হয়ে যায়। বিকেলের দিকে ঘটনাস্থলের আশেপাশে চারটি পাম্প চালিয়ে জল নামান রেল কর্তৃপক্ষ। তার পর দমকলের সাহায্যে রেল পুলিশ একে একে উদ্ধার করে যাত্রীদের। |
নরক-যন্ত্রণা
|
বিকল চক্ররেল। সাড়ে পাঁচ ঘণ্টার দুর্ভোগে যাত্রীরা।
শনিবার মল্লিকঘাটের কাছে। ছবি সুদীপ আচার্য |
আস্ফালন প্রচুর, কিন্তু সত্যিকারের বিপর্যয় এসে পড়লেই বারবার ঠুঁটো হয়ে যায় মোকাবিলার যাবতীয় বন্দোবস্ত। রেল নিজের মতো সাফাই দিয়েছে। পূর্ব রেলের জনসংযোগ আধিকারিক সমীর গোস্বামীর কথায়, “কোনও ঘটনা ঘটলে তার উপায় বার করতে সময় লাগে। যাত্রীদের উদ্ধারের জন্য প্রথমে একটি ইঞ্জিন পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু সেটিও জলের জন্য ঘটনাস্থলে পৌঁছতে পারেনি।” হাওড়ার অতিরিক্ত ডিভিশনাল ম্যানেজার উৎপল বল আবার বলছেন, “ট্রেনটি আটকে পড়ার দেড় ঘণ্টার মধ্যেই আমরা ঘটনাস্থলের কাছাকাছি পৌঁছে যাই। কিন্তু মল্লিকঘাট ফুলবাজারের কাছে যেখানে ট্রেনটি আটকে ছিল, সেখানে পৌঁছনোর কোনও পথ ছিল না। ফলে উদ্ধারকাজ শুরু করতে অনেক সময় লেগে যায়।”
রেল যদি না-ই পারল, দমকলের কাছেও খবরটা গেল অনেক দেরিতে। দমকলের সদর দফতরের স্টেশন অফিসার অশোককুমার বিশ্বাস বলেছেন, “বেলা ৩টে নাগাদ আমাদের জানানো হয় মল্লিকঘাটের কাছে চক্ররেল বিকল হয়ে গিয়েছে। তাতে আটকে পড়েছেন যাত্রীরা। তাঁদের উদ্ধার করতে হবে।” তার পরেও দমকলের নড়ে বসতে কেন দেড় ঘণ্টা লাগল, তার কোনও ব্যাখ্যা নেই।
ওই ট্রেনের যাত্রী শান্তি দেব বলেন, “পৌনে ১১টা নাগাদ ট্রেনটা মল্লিকঘাট ফুলবাজারের কাছে থেমে যায়। তখন বাইরে প্রবল বৃষ্টি। ফলে জানলা খোলা যাচ্ছিল না। ট্রেনে বিদ্যুৎ না থাকায় আলো-পাখাও সব বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। সে এক নরক-যন্ত্রণা।” অন্য এক যাত্রী পিনু গুপ্তর অভিযোগ, “বারবার হাওড়া ও শিয়ালদহ স্টেশনে ফোন করি আমরা। কিন্তু কেউ ফোন তোলেনি। ফোন করা হয়েছিল লালবাজারের পুলিশ কন্ট্রোল রুমেও। তারা হাওড়া স্টেশনের শুধু একটি ফোন নম্বর জানিয়ে হাত তুলে নেয়।” যাত্রীদের বক্তব্য, শনিবার ছুটির দিন বলে ট্রেনে ভিড় ছিল না, কিন্তু কাজের দিনে এই ঘটনা ঘটলে পরিস্থিতি আরও ভয়ানক হতে পারত। ভিড়ে অসুস্থ হয়ে কেউ মারাও যেতে পারতেন। রেল সূত্রে বলা হচ্ছে, একটু বেশি বৃষ্টি হলেই চক্ররেলের লাইনে অনেক জায়গায় জল জমে যায়। গঙ্গার জল ঢুকেও মাঝেমধ্যে বিপত্তি ঘটায়। বিশেষ করে ভারী বৃষ্টি হলে মল্লিকঘাট ফুলবাজার লাগোয়া অংশ থেকে হাওড়া ব্রিজ পর্যন্ত আধ কিলোমিটার লাইনের উপর যে ভালো রকম জল জমে যায়, সে কথা অজানা নয় রেল কর্তৃপক্ষের। তাই লাইনে জল উঠলে চক্ররেল বন্ধ করে দেওয়া হয়। কিন্তু এ দিন কেন ট্রেন চলাচল বন্ধ করা হয়নি, তার কোনও সদুত্তর দিতে পারেননি রেলকর্তারা। লাইনের উপর জল জমেছে জেনেও বড়বাজার স্টেশন থেকে ট্রেনটিকে কেন বিবাদী বাগের দিকে যাওয়ার সবুজ সঙ্কেত দেওয়া হল, এই প্রশ্নের উত্তরে এক রেলকর্তার যুক্তি, ট্রেনটি যখন বড়বাজার থেকে ছেড়েছিল তখন লাইনে খুব বেশি জল ছিল না। কিন্তু মল্লিকঘাটে পৌঁছনোর মধ্যেই লাইনের উপরে ৫৫ সেন্টিমিটার জল জমে যায়। যুক্তি আরও আছে। রেলের সিনিয়র ডিভিশনাল ইঞ্জিনিয়ার (কো-অর্ডিনেশন) আর এস রাজপুত বলেন, “বড়বাজার থেকে বিবাদী বাগ স্টেশনের মধ্যে একাধিক স্থানে লাইন আধ মিটার থেকে এক মিটার উঁচু করা দরকার। কিন্তু ওই দুই স্টেশনের মধ্যে কম উচ্চতার দু’টি সেতু থাকায় সে কাজ করা যাচ্ছে না। ফলে জল জমলেই ট্রেন চালানোয় সমস্যা দেখা দিচ্ছে।”
সমস্যাটা সবাই জানেন, সমাধানটাই শুধু ‘হয়ে ওঠেনি’। এ দিনের ঘটনায় পুলিশ-দমকল তো বটেই, মুখ্যমন্ত্রীর দলের হাতে থাকা রেল মন্ত্রকের গাফিলতির ছবিটাও প্রকট হয়ে পড়েছে। ভুক্তভোগী সাধারণ মানুষ তাই আরও এক বার প্রশ্ন তুলেছেন বিপর্যয় ঘটলে রক্ষা করবে কে? |
|
|
|
|
|