২৯ ভাদ্র ১৪১৮ বৃহস্পতিবার ১৫ সেপ্টেম্বর ২০১১


হলদি রঙের রোদ্দুর ছড়িয়ে পড়েছে চরাচরে। আশমানি রঙের উপর কখনও সাদা, আবার কখনও হাল্কা কালচে মেঘের চরে বেড়ানো আকাশ প্রতি মুহূর্তে জানান দিচ্ছে এসেছে শরৎ...
হিমের পরশ এখনও না লাগলেও পুজোর স্পর্শ অনুভব করছে গোটা বঙ্গজীবন। সেই মাহেন্দ্র ক্ষণের ক’দিনই বা বাকি আর! দু’হাতের আঙুলগুলোর সমস্ত কর একত্রিত করারও আর
প্রয়োজন নেই। তবে এই প্রাক-শারদীয় ছোঁয়ায় ঠিক কী কী আছে? নজর দেওয়া যাক শারদ উৎসবের সকল প্রস্তুতির দিকে। এতে যেমন ঝালিয়ে নেওয়া যাবে পুজোর চার দিনকে
সাজিয়ে তোলার পরিকল্পনাগুলিকে তেমনই জানা যাবে কী পরিমাণ নিরলস পরিশ্রম লুকিয়ে থাকে এই আনন্দ আয়োজনের নেপথ্যে। শরৎ-পুজোর এই মরশুমে শারদ সংখ্যার রমরমা
খুবই। এ সময়ে কি তা হলে পড়াশুনোর আগ্রহ বাড়ে? সে কথা ভেবেই ‘শারদ সংবাদে’এক আশ্চর্য বই জগতের হদিশ রইল পাঠপ্রিয় পাঠকদের জন্য; ভাসমান বইমেলা।


সংসার আর পড়াশোনা সামলেও মণ্ডপসজ্জায় ব্যস্ত তন্দ্রা-মৌমিতা
প্রথমে তাঁদের উপরে ঠিক ভরসা করতে পারেননি উদ্যোক্তারা। পরে অবশ্য সে ভুল ভেঙেছে। এক জন শিল্পী পরিবারের বধূ। অন্য জন কলেজছাত্রী। তন্দ্রা পালের শ্বশুর প্রয়াত হরকান্ত পাল ছিলেন বাংলাদেশের নামী শিল্পী। এই পারে চলে আসার পরে তাঁর তিন ছেলেও বংশ পরম্পরায় শিল্পী। তাঁদের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে কাজ করার অভিজ্ঞতা রয়েছে তন্দ্রার। আর বর্ধমানের রাজ কলেজের বাংলা বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী মৌমিতা রায় যদিও এই কাজ করছেন নিছক শখেই। এর আগে তিনি কলকাতার ভবানীপুরে মণ্ডপের ভিতরের নকশার কাজে এক শিল্পীকে সাহায্য করেছেন।

প্রতিমার সঙ্গে মানানসই মণ্ডপসজ্জার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে এই দুই মহিলাকে। সারাদিন তো প্রতিমার অলংকরণ নিয়েই ব্যস্ত। পুজোর বাজার? দু’জনেই বললেন, “মানুষের যদি এই সাজসজ্জা ভাল লাগে, আর তা যদি উদ্যোক্তাদের জন্যে নিয়ে আসে কোনও পুরস্কার, সেই আনন্দ অনেক বেশি। পুজোর বাজার তো প্রতিবারই আছে।”

মাটির দামও হয়েছে দ্বিগুণ, কৃষ্ণনগরের প্রতিমাশিল্পীদের মাথায় হাত
দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির ধাক্কায় বেসামাল কৃষ্ণনগরের পটুয়া পাড়া। মূর্তি শিল্পীদের দাবি, বেশ কয়েক বছর ধরে প্রতিমা তৈরির উপকরণের দাম বাড়লেও এ বার তা চরম আকার নিয়েছে। কোনও কোনও উপকরণের দাম বেড়ে হয়েছে দ্বিগুণ। কিন্তু প্রতিমার চাহিদা এ বার কম। তার উপরে মিলছে না প্রতিমা নির্মাণের কাজে উপযুক্ত শ্রমিক। শিল্পীরা বলছেন, যাও বা দু’এক জন মিলছে, তাঁরাও দ্বিগুণ পারিশ্রমিক দাবি করছেন। কিন্তু সব মিলিয়ে এই সঙ্কটের থেকে মুক্তির উপায় কিন্তু জানা নেই এই শিল্পীদের। প্রতিমা শিল্পী দিলীপ পাল বলেন, “জিনিসপত্রের যা দাম বেড়েছে, তাতে প্রতিমার দাম দ্বিগুণ হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু তেমনটা তো হবে না। বরং এ বার চাহিদা কম থাকায় প্রতিমার মূল্য কম। কোনও কোনও ক্ষেত্রে গত বারের চেয়েও কম দামে প্রতিমার বায়না হয়েছে।”

পটুয়া পাড়ার শিল্পীরা জানাচ্ছেন, গত বারে যে বাঁশের দাম ছিল ৬০ টাকা, এ বার তা কিনতে হচ্ছে ১২০ বা ১৩০ টাকা দিয়ে। বিচালির দামও অস্বাভাবিক রকম বেড়ে গিয়েছে। পেরেক, রং, দড়ির দামও তাই। দিলীপবাবু বলেন, “মালদহ, মুর্শিদাবাদ, বর্ধমানে আমার প্রতিমা যায়। কিন্তু যখন প্রতিমা বায়না করার সময়, তখনই বৃষ্টি হচ্ছিল। অনেকেই ভেবেছিলেন, পুজোর সময়টা মাটি হয়ে যাবে। ফসলও নষ্ট হবে। তাই ভয়ে অনেকেই বায়না করার ইচ্ছে থাকলেও করেননি।”

তাই এ বার কৃষ্ণনগরে পটুয়াপাড়া তাকিয়ে রয়েছে শেষ মুহূর্তের বাজারের দিকেই।

‘হাল্কা দুর্গা’র বনকাপাশি
মঙ্গলকোটের এই গ্রামের নাম বনকাপাশি। সবাই চেনে শোলাগ্রাম নামেই। গোটা গ্রামটাই শোলা-শিল্পীদের আখড়া। পুজোর মরসুমে আট থেকে আশি সকলেই দেবীর সাজ তৈরিতে হাত লাগিয়েছেন।

গ্রামের মিহির পণ্ডিত অন্যতম সেরা শোলাশিল্পী। এই বছর তাঁর শিল্পকর্ম শোভা পাবে ভবানীপুরের জাগৃতি সঙ্ঘ থেকে উত্তরপাড়া টাউন ক্লাবে। এই গ্রামের আশিস মালাকার রাষ্ট্রপতি পুরস্কারপ্রাপ্ত শিল্পী। তাঁর বাবা প্রয়াত আদিত্যবাবু ও ঠাকুরমা কাত্যায়নীদেবীও শোলাশিল্পী হিসেবে রাষ্ট্রপতি পুরস্কার পান। ২০০৯ সালে আদিত্যবাবুকে ‘শিল্পগুরু’ সম্মানে ভূষিত করে কেন্দ্র সরকার। এই পরিবারের হাত ধরেই বনকাপাশি গ্রামে শোলার গয়না তৈরির কাজ শুরু হয়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে গোটা গ্রাম শোলার কাজে নিযুক্ত হয়ে পড়েন। একটা সময় ছিল, যখন কলকাতার কুমারটুলি, কালীঘাটের পটুয়াপাড়ার মৃৎশিল্পীরা বনকাপাশি থেকে দেবীর সাজ নিয়ে যেতেন। এখন অবশ্য পুজো-কর্তারাই সরাসরি শোলা-শিল্পীদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। আর তাঁদের মণ্ডপে নিয়ে গিয়ে ‘থিম’ অনুযায়ী দেবীকে সাজাতে বলেন।

‘থিম’ পুজোর দৌলতে শিল্পীদের কাজও আগের থেকে বেড়েছে। বনকাপাশি গ্রামের পণ্ডিতপাড়ার বাসিন্দা মিহিরবাবু নিজের শিল্পকর্ম দিয়ে কারিগর থেকে শিল্পী মর্যাদা ছিনিয়ে এনেছেন। তাই কলকাতা ছাড়াও মুম্বই, দিল্লিতেও তাঁর কাজ শোভা পেয়েছে। ইতিমধ্যেই তিনি কলকাতার চালতাবাগান, মুদিয়ালি, ভবানীপুর-সহ বিভিন্ন জায়গায় দেবী দুর্গাকে সাজিয়েছেন।


উৎসবের মরসুমে বহরমপুরের বাজার জমজমাট
ঈদ থেকে শুরু। তার পরে প্রায় মাস খানেক ধরে চলে উৎসবের মরসুম। বাজারও তাই এই সময়টা থাকে জমজমাট। মুর্শিদাবাদ জেলার ব্যবসায়ীদের বক্তব্য, এই সময়টায় রবিবার বা অন্য ছুটির দিন ছাড়া সাধারণ দিনেও ক্রেতাদের ভিড় উপচে পড়ে দোকানে দোকানে।

এই উৎসব মরসুমে বহরমপুরের বাজারে কয়েক কোটি টাকার লেনদেন হয়ে থাকে। তবে বহরমপুরে হোলসেল মার্কেট নেই বললেই চলে। বেলডাঙার হোলসেল মার্কেটে অবশ্য ভাল ব্যবসা হয়।

কিন্তু যে যতই যা সুযোগ দিক, পুজোর নতুন পোশাকই সব থেকে বড় কথা। পুজোর পোশাক হবে এমন কিছু যা, সারা বছরের পোশাকের থেকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। কারও পছন্দের তালিকায় শাড়ির পাশাপাশি রয়েছে চুড়িদার, তেমনি কেউ কেউ জামদানি, ঢাকাই জামদানি, জারদৌসি কিনে ব্যাগ ভরিয়ে তুলেছেন। অনেকেরই পছন্দের তালিকায় রয়েছে খিচা সিল্ক, তসর, কোসা সিল্ক। কেউ আবার শাড়িতে গুজরাটি স্টিচ, বেনারস ও কেরালা সিল্ক কিনছেন। এ দিকে বিভিন্ন দোকানের পাশাপাশি পুজোর বাজার ধরতে ব্যারাক স্কোয়ার ময়দানে তাঁতবস্ত্র ও গ্রান্টহল ময়দানে বস্ত্র মেলা রমরমিয়ে চলছে।


পুজোয় চাই আমকল্কা
পুজো এলেই উঠে আসে শাড়ির নতুন নতুন নাম। এ রকমই শাড়ির বাজার দখলের দৌড়ে নেমেছে কালনার সমুদ্রগড়-ধাত্রীগ্রামের আমকল্কা। বহু বছর ধরেই তাঁত শিল্পের জন্য এই এলাকা দু’টি বিখ্যাত। সারা বছর রমরমিয়ে ব্যবসা চলে এখানে। তবে পুজোর মরসুমে ব্যবসা তুঙ্গে ওঠে। দুর্গাপুর, আসানসোল, কলকাতা, হাওড়া-সহ রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ে কালনা মহকুমার শাড়ি। নিয়ম করে প্রতি বছরই পুজোর মরসুমে বেশ কিছু নতুন চমক বাজারে নিয়ে আসেন এখানকার তাঁতিরা। পুজো মরসুমে ব্যবসা হয় একশো কোটির টাকারও বেশি। এ বারও আমকল্কা নিয়ে তাঁতিরা বেশ উচ্ছ্বসিত। তাঁদের দাবি, চওড়া পাড় আর চওড়া নকশার জোরে আমকল্কা আগের সব রেকর্ড ভেঙে দেবে।

একশো কাউন্টের মিহি সুতোয় বোনা এই শাড়ির আঁচল, পাড় এবং গায়ে রয়েছে সুতো ও জরির নকশা। সেই নকশায় ফুটে উঠছে পদ্ম, আম, রথ। প্রায় ৪৮ ইঞ্চি চওড়া কাপড়ের মধ্যে ৬-৮ ইঞ্চি এলাকা জুড়ে জরির পাড়। শিল্পীদের দাবি, আমকল্কার নকশা অপেক্ষাকৃত বড় বলেই নজর কাড়ছে বেশি। সব ধরনের ক্রেতাদের কথা মাথায় রেখেই এই শাড়ির সুতোয় ব্যবহার করা হয়েছে অজস্র রং। দুই এলাকার গুরুত্বপূর্ণ বাজারে আবার মিলছে তসরের আমকল্কাও। খোলা বাজারে তাঁতের আমকল্কা বিকোচ্ছে হাজার থেকে বারোশোর মধ্যে। তবে তসরের আমকল্কার জন্য দিতে হবে ১৮০০ থেকে ২ হাজার টাকা।

জৌলুসহীন নবদ্বীপের পুজো বাজার
পুজোর কাউন্টডাউন শুরু হয়ে গেছে। অথচ বাজারে এখনও ভিড় জমেনি। নবদ্বীপের বস্ত্র ব্যবসায়ীদের মুখে তাই চিন্তার ছাপ! এক দিকে বন্যা ও অন্য দিকে গ্রামীণ ক্রেতার অভাব সব মিলিয়ে কেনাকাটার বাজারের যেন মুখভার।

নবদ্বীপের পোশাকের বাজারে সাধারণত দু’ধরনের ব্যবসা হয়। একটা হল, স্থানীয় ভাবে ব্যবসায়ীরা নিজেরাই উৎপাদন করেন। আর তার বাজার ছড়ানো গুপ্তিপাড়া থেকে বর্ধমান, মুর্শিদাবাদের প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে।

এ ছাড়া, কলকাতা থেকে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের জামাকাপড় আসে। তার বাজারটা প্রধানত শহারঞ্চলে সীমিত। অন্য দিকে, কৃষ্ণনগর, কাটোয়া, কালনা এমনকী সালার পর্যন্ত ছড়ানো নবদ্বীপের পাইকারি বাজারের প্রভাব। গ্রামীণ ক্রেতারা এই বাজারের বড় ভরসা। কিন্তু সেই গ্রামীণ ক্রেতারাই এখন নবদ্বীপের মতো বড় পাইকারি বাজারে নেই বললেই চলে।

সকাল থেকেই ভিড়, জমজমাট পুজো বাজার
আনারকলি সালোয়ার না কুর্তি-লেগিংস! শর্ট শার্ট, ফর্মাল না পাঞ্জাবি-পাজামা! ঢাকাই, চান্দেরি না ইক্কত! পুজোর আর দেরি নেই। দোকানে দোকানে ঘুরে সাধ্যের মধ্যে পছন্দের সেরা পোশাকটা খুঁজে বের করার অভিযান কিন্তু শুরু হয়ে গিয়েছে। সঙ্গে মানানসই জুতো, ব্যাগ, গয়না, সাজগোজের জিনিস। প্রতীক্ষার চারটে দিন নিজেকে অন্য রূপে দেখতে, দেখাতে তৎপর সকলেই। সপ্তাহান্তের ছুটির দিনটা তাই মেদিনীপুর-খড়্গপুরের বাজারগুলিতে উপচে পড়া ভিড়।

খড়্গপুরের গোলবাজার, গেটবাজার, ইন্দার জামাকাপড়ের দোকানগুলিতেও সকাল থেকেই ঠাসা ভিড়। শুধু রেলশহর নয়, আশপাশের এলাকার মানুষও এখানেই কেনাকাটা করেন। মেদিনীপুরের বড়বাজার, ছোটবাজার, স্টেশন রোডে আবার ক্রেতারা আসেন জেলার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে। পুজো বাজারের হাল দেখে ব্যবসায়ীদের মুখে হাসি। তাঁদের আশা, বাজার এ বার ভালই জমবে। গত কয়েকটা বছর জঙ্গলমহলের অশান্তির ছায়া পড়েছিল জেলা জুড়ে। তবে এ বার অবস্থা অন্য রকম। বিক্ষিপ্ত কিছু ঘটনা ঘটলেও মোটের উপর জেলার সর্বত্রই পরিস্থিতি স্বাভাবিক রয়েছে। শারদোৎসবের প্রস্তুতিও শুরু হয়ে গিয়েছে জোরকদমে। স্বভাবতই আশায় বুক বাঁধছেন ব্যবসায়ীরা।


পুজোয় নিজেকে সাজাতে
পুজোয় নিজেকে সেরা হিসাবে মেলে ধরতে হলে হাতে কিন্তু আর তেমন সময় নেই। এমনটাই জানাচ্ছেন রূপচর্চার কারিগরেরা। রীতিমতো রুটিন করে এগোনোর পরামর্শ দিচ্ছেন তাঁরা। কী ভাবে? শরীরচর্চা থেকে শুরু করে দুপুর ও রাতের মেনু, ত্বক ও চুলের যত্ন কী ভাবে নিতে হবেসবই রয়েছে তাদের নিদের্শিকায়। এ বার শুধু নিয়ম করে তা মেনে চলার পালা।

সবার আগে মাথায় রাখতেই হবে বর্ষার কথা। কারণ, বর্ষা মানেই পেটের রোগ। সঙ্গে ত্বকের নানা সমস্যা লেগেই থাকে। যেমন, এই সময় জল ফিল্টার করে খেতে হবে। দিনে অন্তত ২ লিটার। সকালে আধ ঘণ্টা শরীর চর্চা। তার পরে লিকার চা। হাল্কা ব্রেক ফাস্ট। দুপুরে ভাত-ডালের সঙ্গে অল্প মশলা দিয়ে রান্না করা পদ। বিকেলে হাল্কা কিছু টিফিন। রাতে আবার পরিমাণ মতো রুটি তরকারি। ফাস্টফুড এড়িয়ে চলাই ভাল। তবু মন না মানলে মাঝে মাঝে চলতে পারে।

বিশেষজ্ঞেরা জানাচ্ছেন, প্রতি দিন নিয়ম করে শরীরচর্চা করলে চেহারায় আসবে ঔজ্জ্বল্য আর আত্মবিশ্বাসের ছাপ। ত্বক পরিষ্কার রাখাটা জরুরি। বর্ষায় ফাংগাল ইনফেকশনের হার বেশি। ত্বকে সাদা ছোপ তৈরি হয়। ত্বকের জন্য বিউটি ক্লিনিকে গিয়ে অ্যারোমা ট্রিটমেন্ট করাতে পারলে খুব ভাল। তা ছাড়া করা যেতে পারে এক্সট্র্যাক্ট ফেসিয়াল। চামড়ার ট্যান দূর করতে ক্যারোটিনয়েড ফেসিয়াল বেশ কার্যকরী। ত্বকে যাঁদের বড়সড় সমস্যা নেই, তাঁরা অবশ্য বাড়িতে বসেই ময়দা, মধু, দুধ দিয়ে প্যাক তৈরি করে লাগাতে পারেন।

চুল ওঠা ও খুসকির সমস্যার জন্য ওজোন ট্রিটমেন্ট অত্যন্ত জরুরি। প্রতি দিন শ্যাম্পু করতে হবে যাতে চুলের গোড়ায় ভিজে-স্যাঁতসেতে ভাব না থাকে। এ ছাড়া ১৫ দিন অন্তর হারবাল স্পা ক্লিনিকে যেতে পারলে ভাল ফল মিলবে। বাড়িতেও হেয়ার স্পা করার উপায় আছে। নারকেল তেল গরম করে ভাল করে ম্যাসাজ করতে হবে চুলের গোড়ায়। এর পরে পাকা কলা, দই, মধু, ভিনিগার ভাল করে মিশিয়ে প্যাক তৈরি করে চুলের সব অংশে সমান ভাবে লাগিয়ে আধ ঘণ্টা রাখতে হবে। এর পরে অ্যারোমা প্রোটিন শ্যাম্পু করে সব শেষে এক কাপ বিয়ার এক মগ জলে মিশিয়ে চুল ধুয়ে ফেলতে হবে।


পুজোয় এ বার কলকাতা পুরসভার মন্ত্র, পরিষেবা ও নিয়ন্ত্রণ
শহরের বারোয়ারি পুজোয় রাস্তা কিংবা পার্কের জমি ব্যবহারে এ বার কঠোর নিয়ন্ত্রণ চাইছে পুরসভা। সোমবার পুরভবনে অনুষ্ঠিত ‘পুজো প্রস্তুতি’ বৈঠকে পুর-কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। বৈঠক শেষে মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায় বলেন, “প্রশাসনের নির্দিষ্ট করা জায়গার বাইরে অতিরিক্ত জমি এ বার বারোয়ারি পুজোর অনুষ্ঠানে ব্যবহার করতে দেওয়া হবে না। পুজোর দিনগুলিতে শহরের শৃঙ্খলা এবং যাতায়াতে নাগরিক স্বাচ্ছন্দ্য বজায় রাখতেই এই ব্যবস্থা।” একই সঙ্গে তিনি জানান, সদ্য কলকাতা পুলিশের আওতায় আসা যাদবপুর, বেহালা, মেটিয়াবুরুজ-সহ পুরসভার ৪৮টি ওয়ার্ডের ১৭টি থানা এলাকার যান-শাসনে পুলিশকে সব রকম ভাবে সহযোগিতা করা হবে।

পুজোর দিনগুলিতে বিশেষ ভাবে নজর দেওয়া হচ্ছে পানীয় জল সরবরাহ, নিকাশি এবং পুর-বিদ্যুৎ বিভাগের কাজে। দুর্ঘটনা এবং দুর্যোগ মোকাবিলায় দমকল এবং পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ রাখার দায়িত্ব থাকছে পুরসভার বিপর্যয় মোকাবিলা বিভাগের উপরে। পুরসভার প্রতিটি বরো এলাকায় থাকবে পুরসভার মেডিক্যাল টিম। খোলা রাখা হবে পুরসভার স্বাস্থ্য-ক্লিনিকগুলিও। পুজোর দিনগুলিতে ২৪ ঘণ্টা পুর-কন্ট্রোল রুম খোলা থাকবে বলে সিদ্ধান্ত হয়েছে।

শহরের সমস্ত রাস্তার গালিপিট সাফাই চলছে। কোনও কারণে নিকাশি নর্দমায় জল আটকে গেলে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে মজুত রাখা হয়েছে এমটি আর, জেটিং মেশিন-সহ আরও কিছু নিকাশির আধুনিক সরঞ্জাম, যা দিয়ে খুব তাড়াতাড়ি নালা সাফাই করা যাবে। এ ছাড়া, জমা জল দ্রুত নামাতে ম্যানহোলের ঢাকনা খুলে দেওয়ার জন্য প্রতিটি বরো কমিটির দফতরে পর্যায়ক্রমে ২৪ ঘণ্টা থাকবেন মোট ১১৪ জন নিকাশি কর্মী।

পুর-প্রশাসনের কর্তারা জানান, শহরে পুরসভার ৪৮টি পাম্পিং স্টেশনের প্রতিটি পাম্পে নিয়মিত নজরদারি চলছে। বিশেষ করে পাম্পিং স্টেশনের বিদ্যুতের লাইন নিয়মিত পরীক্ষা করা হচ্ছে। পাম্পিং স্টেশনের এলাকাভুক্ত নয়, এমন জায়গার জমা জলে দ্রুত নিকাশির জন্য তৈরি রাখা হয়েছে ২৬৪টি পোর্টেবল পাম্প সেট।

বিসর্জনের খরচ দিতে পুজো কমিটিকে নির্দেশ হাইকোর্টের
গঙ্গার দূষণ রোধে পরিবেশসম্মত ভাবে প্রতিমা বিসর্জনের খরচ দিতে হবে পুজো কমিটিকে। পুজোর বাজেটের আনুপাতিক হারে তাদের থেকে খরচ নিতে হবে। বুধবার কলকাতা হাইকোর্ট এই নির্দেশ দিয়েছে। এ বছর তা কার্যকর করা না-গেলে আগামী বছর থেকে করতেই হবে। পরিবেশকর্মী সুভাষ দত্তের করা জনস্বার্থ মামলায় দুই বিচারপতি পিনাকীচন্দ্র ঘোষ ও সৌমেন সেনের ডিভিশন বেঞ্চে গঙ্গা-দূষণ নিয়ে শুনানিতে কলকাতা বন্দরের তরফে আইনজীবী জয়দীপ কর জানান, গঙ্গা থেকে প্রতিমার কাঠামো তোলা ও বিসর্জন ব্যবস্থাপনায় বিপুল খরচ হয়। ‘দূষণমূল্য’ আদায়ের বিধি মেনে পুজো কমিটির থেকে তা নেওয়া উচিত। বিচারপতিদের মন্তব্য, বাণিজ্যিক সংস্থার সাহায্যপ্রাপ্ত পুজোয় প্রচুর খরচ হয়। তাই পুরসভা ও পুলিশ পুজোর অনুমতি দেওয়ার সময়েই বিসর্জন ব্যবস্থাপনার খরচ আদায় করুক। আদালত পুরসভা, বন্দর ও কলকাতা পুলিশকে পুজো কমিটিগুলির সঙ্গে বিসর্জনের দূষণ কমানো নিয়ে বৈঠক করতে বলেছে।



নেতাদের পুজোয় ‘নাম’-মাহাত্ম্যই ওঠাপড়ার চাবিকাঠি
শহরের অনেক পুজোরই একটা চালু নাম থাকে এবং তা হয় সেই পুজোর সঙ্গে যুক্ত রাজনৈতিক নেতাদের নামেই। অতীত বলছে, কখনও এই নেতাদের নামের সঙ্গে জুড়ে জনপ্রিয় হয়েছে পুজো, আবার কখনও বা নামী পুজোর সঙ্গে জুড়ে মান বেড়েছে ‘কর্তা’র। উল্টো দিকে, সেই নেতার পড়তির দিনে জৌলুস হারিয়েছে পুজো, এমন দৃশ্যও অমিল নয়।
দক্ষিণ কলকাতার পুরনো পুজোগুলির অন্যতম একডালিয়া এভারগ্রিন। সাধারণের কাছে সেটির ডাকনাম সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের পুজো। গলির ছোট পুজো থেকে নামী পুজো হয়ে ওঠায় এই নেতার ভূমিকা অনস্বীকার্য। কিন্তু লোকে বলে, কয়েক বছর আগে সুব্রতবাবুর খারাপ সময়ে কিছুটা হলেও পিছিয়ে পড়ে একডালিয়া। তবে, তা মানতে নারাজ বালিগঞ্জের বিধায়ক। বললেন, ‘‘৭১-এর পরে কখনও একডালিয়া জৌলুস হারায়নি। আজও নয়।”

গত দশকে যে কয়েকটি পুজো প্রথম সারিতে উঠে প্রতিযোগিতায় এসেছে, তার মধ্যে অন্যতম সুরুচি সঙ্ঘ। এই পুজোর সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে যুক্ত টালিগঞ্জের বিধায়ক অরূপ বিশ্বাস। পর পর কয়েক বছরে নানা ধরনের থিম উপহার দিয়েছে সুরুচি। অরূপবাবুর উত্থানের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে সুরুচির জৌলুস। অরূপবাবু জানালেন, এ বার তাঁদের চমক জিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের থিম-সঙ্গীত। পাশাপাশি তাঁর দাবি, গত দশ বছরে তাঁদের মণ্ডপেই সব চেয়ে বেশি জনতার ঢল নেমেছে।

পুজোর টক্করে রয়েছে নাকতলা উদয়ন সঙ্ঘও। খোদ শিল্পমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের পুজো বলে কথা! বিরোধী দলনেতা থেকে শিল্পমন্ত্রী, পার্থবাবুর উন্নতির সঙ্গে পুজোর জৌলুসও বেড়েছে পাল্লা দিয়ে।

দক্ষিণ কলকাতার পুজো মানচিত্রে নতুন তারকা চেতলা অগ্রণী। বেশ কয়েক বছর ধরেই ফিরহাদ হাকিম (ববি) এই পুজোর কর্তা। এ বার তিনি পুরমন্ত্রী। ফলে কিছুটা হলেও বাড়তি জৌলুস থাকছেই। গত বারে সল্টলেকের এফডি ব্লকের শিল্পী রণো বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিয়ে এসেছে ফিরহাদের পুজো। থিম সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি। তবে ফিরহাদ বলছেন, ‘‘আমি নই, পুজো বেড়ে ওঠার পিছনে কৃতিত্ব স্থানীয় মানুষেরই।”

গত পাঁচ বছরে ক্রমাগতই নাম বাড়ছে ত্রিধারা সম্মিলনীর। যার অন্য নাম, কলকাতা পুরসভার দাপুটে নেতা দেবাশিস কুমারের পুজো। দেবাশিসবাবু জানালেন, এ বার পুজো প্রাঙ্গণে রাজস্থানি হস্তশিল্প ও খাবারের স্টলের পাশাপাশি থাকবে রাজস্থানি সঙ্গীত ও নাচ।


রাজনীতির আগেই পুজো করে পরিচিতি তৈরি করেছিলেন কোন নেতা? ক্যুইজে প্রশ্নটা করলে পলকেই জবাব মিলবে, সুজিত বসু। আর তাঁর পুজো? লেকটাউনের শ্রীভূমি স্পোর্টিং। অবশ্য শ্রীভূমি যখন সুজিতবাবুকে পরিচিতি দিয়েছিল, তখন তিনি ছিলেন অন্য রাজনৈতিক শিবিরে। কিন্তু পরে যখন দল বদলালেন, তখনও শ্রীভূমি ছাড়েননি তিনি। দুর্জনেরা বলেন, বাম শিবির ছাড়ার পরে কয়েক বছর কপাল খারাপ গিয়েছিল শ্রীভূমির। কিন্তু সুজিতবাবুর দাবি, মোটেও তা নয়। প্রতি বারই পুজোর পাশাপাশি পংক্তিভোজ আর সমাজসেবার অনুষ্ঠান চলেছে। একই ব্যবস্থা রয়েছে এ বারও।

উত্তরের ভিড় অনেকটাই নিজেদের মণ্ডপে টানে সন্তোষ মিত্র স্কোয়ার। কংগ্রেস নেতা প্রদীপ ঘোষের পুজো বলেই যা লোকের কাছে পরিচিত। রাজনীতির আঙিনায় প্রদীপবাবুর সেই দাপট ইদানীং পড়তির দিকে। তার সঙ্গে কি সন্তোষ মিত্র স্কোয়ারের পুজোও হারাচ্ছে তার পুরনো জৌলুস? মানতে নারাজ প্রদীপবাবু। বললেন, “লোকের ভিড়ে এখনও এক নম্বর আমরা।” উত্তরের পুজোগুলির মধ্যে রয়েছে হাতিবাগান ও নবীন পল্লি। এই দু’টি পুজোর সঙ্গেই রয়েছেন কলকাতা পুরসভার মেয়র পারিষদ অতীন ঘোষ।

অবশ্য কলকাতার এমন অনেক নামী পুজো আছে, যাঁদের সঙ্গে সক্রিয় ভাবে কোনও রাজনৈতিক নেতা না থাকলেও পুজোকমিটির কর্তারা রাজনৈতিক নেতাদের ঘনিষ্ঠ। কলেজ স্কোয়ারের পুজোকমিটির প্রায় সবাই সোমেন মিত্রর ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত। মহম্মদ আলি পার্কের সঙ্গে জুড়ে রয়েছে দীনেশ বাজাজের নাম।

এর পাশাপাশি, বাম দলের নেতারা অবশ্য কোনও দিনই পুজোর সঙ্গে সরাসরি যুক্ত থাকেন না। কিন্তু বেলেঘাটা থেকে জোড়াসাঁকো, অনেক পুজোর পিছনেই প্রচ্ছন্ন ভূমিকায় দেখা যেত তাঁদের।


থিমের টুকিটাকি
• ‘বড়িশা তরুণ তীর্থ’-র এ বার ২৭ বছর। এ বার এখানকার থিমে মানুষের এগিয়ে চলার গল্প। সেই চকমকি পাথর ঠুকে আগুন জ্বালাতে শেখার দিন থেকেই অসীম কৌতূহলে মানুষ শিখে নিয়েছে একটার পর একটা নতুন জিনিস। কখনও প্রকৃতির রহস্য সন্ধান, কখনও বিজ্ঞানের জয়যাত্রায় মানুষ আজ কত কী আবিষ্কার করেছে। কম্পিউটারে মাত্র একটা ক্লিকে আজ গোটা দুনিয়াটা তোর হাতের মুঠোয়। নতুনকে খুঁজে নিতে এই এগিয়ে চলার গল্পটাই এ বার সবাই দেখবে এখানকার পুজোয়।

• হরিদেবপুরের ‘সোদপুর প্রগতি সঙ্ঘে’ এ বার শামিয়ানার মতো মণ্ডপ গড়ে ভিতরে রামযাত্রা হবে। সেই আগেকার গ্রামবাংলার জমিদার বাড়িতে পুজোর সময়ে যেমন যাত্রাপালা হত। কোনও দিন ‘রাবণ বধ’, কোনও দিন ‘সীতা হরণ’ দেখতে ভেঙে পড়ত গোটা গ্রামের লোক। এত দিন গল্পের বইতে পড়া বিষয়গুলো এ বার পুজোর মণ্ডপে!

• হরিদেবপুরে ‘৪১ পল্লি’র পুজোটাও বেশ ভাল হবে। এ বার মা দুর্গা ওখানে দুর্ভিক্ষের প্রেক্ষাপটে অন্নদামঙ্গলের দেবী অন্নপূর্ণার রূপে আবির্ভূত হবেন। শিব নর-করোটির পাত্র হাতে তাঁর কাছে ভিক্ষাপ্রার্থনা করবেন। আর ক্ষুধারূপী অসুরকে নিধন করবেন দেবী।

• ‘জ’পুর ব্যায়াম সমিতি’ এ বার ফুটিয়ে তুলছে আদিবাসী সংস্কৃতির রূপ। যাদের জীবন-জীবিকার সবটাই অরণ্যের উপরে নির্ভরশীল। হিংস্র জীবজন্তুর হাত থেকে বাঁচতে ওরা গাছের উপরেই ঘর বাঁধে। ইট-কাঠ-পাথরের শহরটায় হাজারো সুযোগ-সুবিধার মাঝখানে বসে জঙ্গলের এই জীবনযাপনটাকে কেমন অ্যাডভেঞ্চার মনে হয় না?

• ‘বেলেঘাটা প্রগতি সংসদ’-এর পুজোয় যেমন এ বার দক্ষিণ ভারতীয় ধাঁচের কাল্পনিক মন্দির। তাতে ১১ ফুটের প্রতিমা।

• বরাহনগরের ‘বন্ধুদল স্পোর্টিং ক্লাব’-এর মণ্ডপ আবার হবে দিল্লির অক্ষরধাম মন্দিরের মতো। পিতলের প্রতিমা গড়া হবে দক্ষিণ ভারতের চামুণ্ডা মন্দিরের প্রতিমার আদলে।

• মধ্য কলকাতার শশিভূষণ দে স্ট্রিটে আর রামকানাই অধিকারী লেনের মোড়ে উমেশ স্মৃতি সঙ্ঘে মায়াপুরের মন্দিরের আদলে মণ্ডপ। প্রতিমা হবে সাবেক ধাঁচে।


• যাঁরা শিল্পের শিকড় সন্ধানে উৎসুক, তাঁদের জন্য সুসংবাদ। ‘দমদম পার্ক সর্বজনীন’-এর হীরক জয়ন্তী বর্ষের পুজো সেই সব রসিকজনের জন্য সাজিয়ে তুলবে বাংলার পটচিত্র। দেবদেবীর আরাধনা থেকে সাংসারিক নানা ভাবনা, সবই ফুটে উঠবে পটশিল্পের সূক্ষ্ম কারুকাজে। এই পুজোর মণ্ডপসজ্জা দেখে আপনার মনে পড়তে পারে শিল্প-সমৃদ্ধ এক টুকরো বাংলার কথা। কোনও জিনিসের সাধনা করতে গেলে প্রয়োজন হয় বিবিধ উপকরণের। মা দুর্গার আরাধনার সঙ্গে যে উপকরণ সমার্থক হয়ে গিয়েছে, তার নাম চালচিত্র। ইতিহাস খুঁজলে দেখা যাবে, প্রাচীন রাজবংশ ও জমিদারবাড়ির পুজোয় চালচিত্র যোগ করত এক নান্দনিক মাত্রা। তার শৈল্পিক উপস্থাপনা বহন করত জমিদারবাড়ির গরিমা। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তনশীল সব কিছুই। সে থেকে বাদ যায়নি চালচিত্রও। বিভিন্ন ধরনের চালি আজ লুপ্তপ্রায়। সে সবই ফিরে আসছে আবার এই সর্বজনীনের পুজোয়।

• গড়িয়ার ‘বিধানপল্লি পূর্বপাড়া’ প্রথাগত পথ থেকে বেরিয়ে হাঁটতে চেয়েছে একটু অন্য ভাবে। বিভিন্ন কল্কা ও ছবির সাহায্যে তারা মণ্ডপসজ্জায় ফুটিয়ে তুলবে লুপ্তপ্রায় চালচিত্রের সৌন্দর্য।

• গ্রামের মাটির সঙ্গে মানুষের যে নাড়ির টান, তারই ছোঁয়া মিলবে কানাই ধর লেনের ‘অধিবাসীবৃন্দ’র পুজোয়। ৫০ শরৎ পেরিয়ে এই পুজোর এ বারের ভাবনা ‘ফিরে চল মাটির টানে’।

উন্মেষ থেকে কৃষ্টি-সংস্কৃতির পরতে পরতে জড়িয়ে আছে মাটির সোঁদা গন্ধ। যাপনশৈলীতে, লোকায়ত ও নাগরিক সৌন্দর্যের মেলবন্ধনে সেই পরশ পাওয়া যাবে ‘সিঁথি মুন্সির বাগান সর্বজনীন’-এ। মণ্ডপের দু’পাশে ঘট দিয়ে নানা কারুকাজ। মূল মণ্ডপে উজ্জ্বল রূপে বিরাজমান মহামায়া। থাকছে মধুবনী চিত্রকলার কাজও।

• অতীতকে সঙ্গে নিয়েই পথচলা মানুষের। দীর্ঘ অতীতে ফিরে ফিরে আসে কত বিশ্বাস, পুরাণকাহিনি কত। ব্রহ্মার সঙ্গে মন্ত্রণা করে বিষ্ণু যখন তাঁর সুদর্শন চক্রের আঘাত নামিয়ে আনেন সতীর উপরে, সতীর দেহ খণ্ডিত হয়ে পড়ে বিভিন্ন স্থানে। পরবর্তীকালে সেখানেই গড়ে উঠেছে একান্নটি পীঠ। সেই একান্ন পীঠ ছুঁয়েই এ বারের যাত্রা বাগমারি ‘আবাসিকবৃন্দ’র। পুরাণের সঙ্গে আধুনিকতা মিশে যাবে এখানে। কে বলতে পারে, হয়তো অজান্তেই গড়ে উঠবে এক পিছুটানের সম্পর্ক।

বড়িশার ‘সবেদাবাগান ক্লাবে’র মণ্ডপ এ বার সাজবে গৃহকর্ত্রীদের সেই ‘অফিসঘরের’ আদলে। দশ হাতে রন্ধনশালার নানা প্রকরণে সুসজ্জিত দেবীর এমনই মাতৃরূপ দেখা যাবে সেখানে।

• আন্দামানের সবুজ দ্বীপে সমুদ্রের ধারে মায়ের সঙ্গে বেড়াতে যাওয়ার আনন্দই আলাদা। সেলুলার জেলের আদলে তৈরি দমদমের ‘চোদ্দোর পল্লি সর্বজনীন’-এর মণ্ডপের মূল প্রবেশপথ দিয়ে ভিতরে গেলেই মায়ের সঙ্গে পৌঁছনো যায় সাদা বালির তটে। শহুরে ভিড়ভাট্টা পেরিয়ে মণ্ডপপ্রাঙ্গণে প্রবাল, ফসিলস্, সামুদ্রিক প্রাণী আর গাছপালায় মন উড়ে যেতে পারে বহু দূর। সঙ্গে বাঁশ, বেত, প্লাইউডে তৈরি বাড়ি আর সবুজ দ্বীপের আদিবাসী সংস্কৃতির ঝলকও মিলবে সে প্রাঙ্গণেই।

• অচেনাকে চিনে নিতে মাতৃদর্শনে চলে যাওয়া যায় কোনও পোড়ামাটির দেশেও। পোড়ামাটির কাজ করা প্রবেশপথে ঝুলছে বড়সড় একটা ঘণ্টা। তার ভিতরে বীরভূমের এক পুরনো মন্দিরের আদলে তৈরি মণ্ডপে চার সন্তানকে নিয়ে মা যেন আদিবাসী ঘরণী। তারই মধ্যে চার পাশের গ্রাম্য পরিবেশ ও লোকজীবনের অঙ্গ হয়ে উঠবেন শহুরে মানুষেরাও। ওই গাঁয়ের কেন্দ্রস্থলে রয়েছে একটা বুড়ো বটগাছ। মনে কোনও বাসনা থাকলে ওই গাছের ডালে মাদুলি বেঁধে ভগবানের কাছে করা হয় প্রার্থনা। বাগুইআটির ‘উদয়ন সঙ্ঘ’-এর পুজোমণ্ডপে সেই বটবৃক্ষের নীচে দাঁড়িয়েই পুজোর দিনে কিছুটা সময় কাটিয়ে নেওয়া যাবে মায়ের সান্নিধ্যে।

• উত্তর কলকাতার বিবেকানন্দ রোডে মন্দিদের আদলে তৈরি ‘শিমুলিয়া সর্বজনীন’-এর পুজো মণ্ডপে মা বসবেন সাবেক সাজেই। বনেদি পাড়ার হইহট্টগোলের মাঝে ডাকের সাজের প্রতিমা শুধু শক্তির আধার নন, স্নেহময়ী জননীও।

• শরৎকালের পাশাপাশি বসন্তও মিলন উৎসবে মাতার ঋতু। উল্টোডাঙার কাছে মুরারিপুকুরে ‘বিধান সঙ্ঘ’-এর মণ্ডপে তাই এ বার ফিরিয়ে আনা হচ্ছে বসন্তের আমেজ। দোল উৎসবকে মনে করেই মণ্ডপ তৈরি হচ্ছে রং-বেরঙের পিচকিরি দিয়ে। মা সাজবেন রাধিকা বেশে। রঙিন মণ্ডপে থাকবে তাঁর স্নিগ্ধতার স্পর্শ।

• ‘মুদিয়ালি ক্লাব’-এর পুজো এ বার ৭৭ বছরে পড়ল । মণ্ডপসজ্জায় স্থান পেয়েছে বাংলার বিভিন্ন জেলার পুতুলেরা। তবে আসল কথাটা সেখানে নয়। সব পুতুলই সাজবে নানা রঙের বৈদ্যুতিক তার দিয়ে। প্রতিমার সাজেও থাকবে সেই অভিনবত্ব।

• উত্তরের লালাবাগান যুবক বৃন্দের (নবাঙ্কুর সঙ্ঘ) এ বারের থিম মেদিনীপুরের পিংলা, জাড়া, ঘাটাল, নন্দীগ্রাম ও নাড়াজোলের পটশিল্পীদের বানানো ‘জৌ পুতুল’। ছেলে-বুড়ো-ঘোড়সওয়ার সেপাই, কে নেই এই জৌ পুতুলদের রাজ্যে! রংচঙে, হাসিমুখের এই পুতুলগুলো শুধু ছোটদের নয়, নজর কাড়বে বড়দেরও।

• লেক টাউনের প্রগতিপল্লি অধিবাসীবৃন্দ আবার এই পুজোয় নিয়ে আসছে বাঁকুড়ার পাঁচমুড়া গ্রামের মানুষদের তৈরি খড়ের লেচির পুতুল। মণ্ডপও হবে তাদের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে। আর মা দুর্গা এখানে ‘কোনও এক গাঁয়ের বধূ’। লক্ষ্মী-সরস্বতী-কার্তিক-গণেশকে সঙ্গে নিয়ে তিনি আসবেন মহিষের গাড়ি চড়ে।

• ম্যুর অ্যাভিনিউয়ের (বেন্রিক ক্লাব) পুজোয় এ বার থাকছে পুতুল-নাচ। দক্ষিণ ২৪ পরগনার কুলতলি গ্রামের মানুষদের ওটাই যে প্রধান জীবিকা! তাই গ্রাম্য পরিবেশে খড়-মাটির ছাউনি দেওয়া ঘরে পুতুল নাচের দল ব্যস্ত থাকবে তাদের এই অধুনালুপ্ত শিল্প নিয়ে।

• সেবক সঙ্ঘের পুজোমণ্ডপ এই পুজোয় সেজে উঠবে প্রায় হারিয়ে যাওয়া বেনারসের খেলনা দিয়ে।

• রামমোহন রায় রোডের রামমোহন সম্মিলনীর পুজোমণ্ডপ তৈরি হবে বেলুন দিয়ে। কাগজ আর আঠা লাগিয়ে বেলুনগুলোকে টেকসই করে নেওয়া হবে। প্রায় আট হাজার বেলুনে চোখ-নাক লাগিয়ে তৈরি হবে বাচ্চাদের মুখ, অথবা ফুল-পাখি-জীবজন্তু। সঙ্গে থাকবেন সনাতনী প্রতিমা তাঁর সিংহ-অসুরকে সঙ্গে নিয়ে।
• খুদেদের কথা মাথায় রেখে মতিলাল নেহরু রোডের কিশোর বাহিনী অ্যাথলেটিক ক্লাব মন দিয়েছে ‘ডিজনিল্যান্ড’ তৈরিতে। পুজোর ক’টা দিন যদি শহরের বুকেই পাওয়া যায় মিকি-ডোনাল্ড-গুফি বা আলাদিনদের, মন্দ কী! শুধু তা-ই নয়, মণ্ডপের প্রবেশপথে ডিজনিল্যান্ডের ইতিহাসও থাকবে ছোটদের ছড়ায়।

• রূপকথার থিম নিয়ে ‘অবসরিকা’র এ বারের পুজো হানা দেবে ‘পরির দেশের বন্ধ দুয়ারে’। ২০০-২৫০ ফাইবার গ্লাসের পরীর মডেলের সঙ্গে মা দুর্গারও এখানে পরীর সাজ।

• নবদ্বীপ, ওড়িশা, মালদা, অসম থেকে গামছা আসতে শুরু করেছে জলপাইগুড়িতে। লম্বা গামছা, ছোট গামছা, রঙিন গামছা, বাহারি গামছার হরেক রকম দিয়েই তৈরি হবে বিশালাকায় ঘোড়া টানা রথ। জলপাইগুড়ি শহরের বিগ বাজেটের পুজোগুলির মধ্যে অন্যতম তরুণ দল। এ বারের পুজোয় গৃহস্থালির প্রতিদিনের ব্যবহার্য গামছাই উদ্যোক্তাদের ইউএসপি। পুজোমণ্ডপ হবে পেল্লায় রথের আদলে। রথের ভেতরে থাকবে কৃষ্ণনগরের শিল্পীর তৈরি দেবী প্রতিমা। গামছার কারুকার্যের সঙ্গে সাযুজ্য থাকবে প্রতিমাতেও। গামছার কারুকার্য থাকবে মণ্ডপের বাইরে-ভেতরেও।

• নতুনপাড়া আরজি পার্টির মণ্ডপে ঢুকতে হবে আটপৌড়ে একটি গ্রাম পেরিয়ে। গ্রামটি বাংলার চিরপরিচিত বাউল সম্প্রদায়ের। গ্রামের প্রতিটি বাড়ি থেকে ভেসে আসবে একতারা, বা দোতারার সুর। গ্রামের ভেতরে বাউল আখড়া। সেখানেই পুজোর আয়োজন। প্রতিমাতেও বাউল ঘরানার ছাপ ফুটে উঠবে। থিম ‘পাতার নীড়ে বাউল সুরে’। নানা ধরনের পাতা, ডাল, আর বাঁশ দিয়ে মণ্ডপটি তৈরি হবে। বাউলদের ব্যবহার করা নানা সুর সরঞ্জামের প্রর্দশনীও থাকবে মণ্ডপে।

• মন যদি চায় টুক করে নাগাল্যান্ড ঘুরে আসতে, এ শহর হতাশ করবে না। দক্ষিণ কলকাতার ‘পূর্বাচল সর্বজনীন (ইস্ট) দুর্গোৎসব’-এর প্রবেশ তোরণ থেকে মূল মণ্ডপ, সর্বত্র থাকছে নাগাল্যান্ডের সংস্কৃতির টুকরো টুকরো উপাদান। রংবেরঙের মুখোশে সাজানো পুজোয় প্রতিমার সাজও হবে মানানসই।

• নাগাল্যান্ড সফর সেরেই টিকিট কাটুন চিনের। মণ্ডপে ঢোকার মুখেই যদি স্বাগত জানায় বিরাট ড্রাগন, তা হলে নিশ্চিত পৌঁছে গিয়েছেন বেলেঘাটার ‘পূর্ব কলিকাতা ছাত্র সমিতি’র চাইনিজ প্যাগোডায়।

• দক্ষিণ কলকাতার ‘নেতাজি জাতীয় সেবাদল’ পূর্ব ভারতের সঙ্গে মিলিয়ে দিয়েছে দক্ষিণ ভারতকে। মণ্ডপ তৈরি হচ্ছে ত্রিপুরার অদূরের ঊনকোটি পাহাড়ের আদলে। আলোর ব্যবহারে তৈরি হচ্ছে পাথুরে পরিবেশ। তবে মা দুর্গা একেবারে দক্ষিণী। তিনি সাজবেন মহল্লাপুরমের প্রস্তর দুর্গামূর্তির আদলে।

• ‘সিঁথি ইউথ অ্যাথলেটিক ক্লাব’-এর থিম এ বার কর্নাটকের এক ভগ্নস্তূপ মন্দির। মণ্ডপসজ্জার বেশিরভাগটা অবশ্য শিল্পীর কল্পনা।

• ‘গড়পাড় মাতৃ মন্দির’-এর মণ্ডপ ভাবনা রূপ পাচ্ছে কেরল ও কথাকলি নৃত্যকে ঘিরে। প্রতিমা থাকবে বজরায় ভাসমান। মণ্ডপের চার পাশ ঘিরে নারকোল গাছ। আর পঞ্চাশ বছরে পা দেওয়া শরৎ বসু রোডের ‘জাগরী’ নিয়ে যাবে দক্ষিণ ভারতের শেষ বিন্দু কন্যাকুমারীতে। ‘বিবেকানন্দ রক’-এর আদলে গড়ে উঠবে তাদের মণ্ডপ।

• গ্রামবাংলাকে দেখতে আসতে হবে শীল লেনের ‘অটল সুর রোড পল্লিবাসী দুর্গোৎসব সমিতি’-তে। দেবী এখানে অন্নপূর্ণার রূপে বিরাজমান। এই মণ্ডপ দেখাবে এক অন্য জঙ্গলমহল।

• জঙ্গলেরই আর এক ছবি ফুটিয়ে তুলছে বরাহনগরের মিলনগড় সর্বজনীন। তালপাতা, বাঁশ আর সুপুরি গাছ দিয়ে তৈরি এই মণ্ডপের থিম ‘আরণ্যক’।

• মণ্ডপে থাকবে মাটির সরা। আর সেই সরাতেই দেবীমূর্তি। এক একটি গোলকের উপরে আঁকা হয়েছে দেবী দুর্গা, তাঁর সন্তান-সন্ততি, সিংহ ও অসুর। দেবী, সিংহ ও অসুরকে যে সরাটিতে আঁকা হয়েছে, তার ব্যাস প্রায় সাড়ে ছয় ফুট। অন্য চারটি গোলকের ব্যাস দু’ফুট। সমস্ত সরাগুলি এক ‘ফ্রেম’-এ আঁটা হয়ে পূর্ণাঙ্গ মূর্তির চেহারা নেবে। এমন ভাবেই এ বার বর্ধমানের পিলখানায় প্রয়াত শিল্পী হরিহর দে-র বাড়িতে তৈরি হয়েছে দেবী মূর্তি। এই লোকচিত্রের নমুনা এ বার শোভা পাবে কলকাতার রাসবিহারীর একটি মণ্ডপে। এ ছাড়াও থাকছে গ্রামীণ পরিবেশ। অনেকটা যেন আদিবাসী গ্রাম। তাতে রয়েছে মাটির বাড়ি, মাটির পাঁচিল। গোলাকৃতি অ্যালুমিনিয়ামের হাঁড়ি ব্যবহার করে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে সমস্তটাই।

• পূর্ব বড়িশার ‘শীতলাতলা কিশোর সঙ্ঘের’ মাঠে গেলে চোখ টানবেই বায়োস্কোপের উপর রং-তুলির শৈল্পিক নকশা। কিশোর সঙ্ঘের বাসিন্দারাই নিজেদের আলপনা, পটচিত্রে সাজিয়েছেন বায়োস্কোপ-মণ্ডপ।

• পুরনোকে ফিরে দেখার ভাবনায় সাপুড়ে-বেদেদের জীবন নিয়ে ‘মল পল্লি সর্বজনীন পুজো কমিটি’র মণ্ডপ সাজাচ্ছেন সোমনাথ মুখোপাধ্যায়। সাপের ঝাঁপির ধাঁচে মণ্ডপ। সাপ যে ভাবে ঝাঁপিতে গুটিয়ে শুয়ে থাকে, সে ভাবেই পাক খেতে খেতে দর্শনার্থীরা পৌঁছে যাবেন প্রতিমার কাছে। ফণা তোলা সাপের নীচে মাংতা (বেদে উপজাতি) কন্যার মতোই আটপৌরে জংলা সাজে দুর্গা। গুটিয়ে থাকা সাপের লেজের উপরে লক্ষ্মী, সরস্বতী, গণেশ, কার্তিককে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা উমার হাত, গলায় মাংতা মেয়েদের মতোই রূপোর মাদুলি, তাবিজ, হাঁসুলি। অসুরনাশিনী উমা এখানে বেদিনী কন্যা। তাই তাঁর হাতে ত্রিশূলের বদলে খন্তা (এই অস্ত্রেই বেদিনীরা মাটি কুপিয়ে সাপ বার করে)।

• মণ্ডপ জুড়ে বেদেদের ঘর-গেরস্থালির টুকরো ছবি, বেহুলা-লখিন্দরের জীবনকথা। ভেসে আসবে বীণের ধুন। এমনই আবহ বেহালার ‘নন্দনা যুব সঙ্ঘে’র মণ্ডপে। বেদে-বেদেনীদের জীবনচর্যাই এই মণ্ডপের ভাবনায় ধরা দেবে।

• শ’তিনেক ছৌ মুখোশ বর্ণিল মণ্ডপ জুড়ে। মোরাম বিছানো পথ বেয়ে মণ্ডপে যেতে যেতে ধামসা-মাদলের দ্রিমি দ্রিমি তালে এক লহমায় শহর ছেড়ে মন উড়ে যাবে পুরুলিয়ার ছৌ-পুরীতে, ‘সূর্যনগর সর্বজনীন’-এর মণ্ডপে।

• সবুজে ঘেরা পাকদণ্ডী বেয়ে দুর্গম পাহাড়ের কোলের মন্দিরে পৌঁছে দেওয়ার ভাবনা নিয়ে সুন্দর মণ্ডপ তৈরি করছে বরাহনগরের ‘কর্মী সঙ্ঘ’।

• পাহাড় ছেড়ে সমুদ্রের আকর্ষণও দর্শনার্থীদের চুম্বকের মতো টানবে ‘কেন্দুয়া সর্বজনীন’-এর মণ্ডপে। নৌকার ছইয়ের ফুটো দিয়ে ঠিকরে পড়া চাঁদের আলোয় জীবন্ত ভাঙা ঘরে মাঝি-মাল্লাদের ঘরবসতের লড়াকু দিন-নামচা। চোখ টানবে সমুদ্রের পাড়ে মেলার পসরা। ঠিক যেন সমুদ্রপাড়ে বেড়াতে গিয়ে টুকিটাকি কিনে নেওয়ার সুযোগ।

• প্রকৃতির টানে তালগাছ ঘেরা গ্রামীণ মণ্ডপ চোখে পড়বে বেহালা ‘আদর্শপল্লি’র মণ্ডপে গেলে। এক পায়ে দাঁড়িয়ে থাকা সারি সারি তালগাছ দেখে চমক লাগবেই। মাঝারি পুকুর পেরিয়ে তালপাতা, চাটাইয়ে ছাউনি দেওয়া মণ্ডপে ঢুকতে ঢুকতে নজর কাড়বে তালগাছ কেটে তৈরি বিভিন্ন মূর্তি, কোথাও এক গাঁয়ের বধূ বঁটিতে মাছ কাটছেন, কোথাও মাথায় কলসী নিয়ে জল আনছেন মহিলারা, কোথাও বা ধান ঝাড়ছেন। একচালার প্রতিমা দেখতে দেখতে ঘোর লাগবে হাতে আঁকা আকাশ, ধানখেত, সবুজ মাঠ দেখে।

থিমে ‘পরিবেশ বাঁচাও’: খামখেয়ালি প্রকৃতির বিভিন্ন রূপ থেকে শুরু করে বিশ্ব উষ্ণায়ণ— থিমের পুজোর ভাবনায় সেজে উঠছে শহরের বেশ কিছু পুজোমণ্ডপ। পরিবেশ সচেতনতা বাড়াতে ও পরিবেশ নিয়ে মানুষের আগ্রহ বাড়াতে থাকছে আরও অনেক ব্যবস্থা। তবে শুধু সচেতন করা নয়, এই ভাবনার মধ্যে দিয়ে ফুটে ওঠে মণ্ডপগুলির নান্দনিক দিকও।

• কালীঘাটের ‘৬৪ পল্লি পূজা পরিষদের’ মণ্ডপ সাজানো হচ্ছে ভেষজগুণ সমৃদ্ধ বিভিন্ন গাছ দিয়ে। এর ফলে সচেতনতা বাড়ার পাশাপাশি কোন গাছের কী সুফল, তাও জানতে পারবেন দর্শকেরা।

• অনেকটা এ রকমই বিষয়-ভাবনা ‘দমদম পার্ক ভারত চক্রের’ পুজোতে। যে সব গাছ বাঙালির উঠোনে শুধু শোভাই বাড়ায় না, পবিত্র গাছ হিসেবেও পরিচিতি বহন করে তেমন কিছু গাছ দিয়ে সাজবে তাদের মণ্ডপ। যেমন তুলসী, বেল, নিম।

• কচুরিপানার প্রতিমা ও মণ্ডপ দেখতে হলে যেতে হবে ‘হরিদেবপুর আদর্শ সমিতিতে’। পুরো মণ্ডপ জুড়ে থাকবে জলাশয় ও কচুরিপানার বিস্তার। গড়িয়ার ‘যাত্রা শুরু সঙ্ঘ’র মণ্ডপে আবার স্বাদ পাওয়া যাবে গহন অরণ্যের। ইট-কংক্রিটের শহরের বুকে সবুজের জয়গান শুনতে বিভিন্ন গাছ দিয়ে মণ্ডপ সাজিয়েছেন উদ্যোক্তারা। পৃথিবীতে বাড়ুক অরণ্যের পরিধি, জনমানসে এই ভাবনা ছড়িয়ে দিতেই তাঁদের এই প্রয়াস।

• ঠাকুরপুকুর ‘নবজীবন সঙ্ঘ’-এর এ বারের ভাবনা বিশ্ব উষ্ণায়ন এবং তার কুফল। বিশ্ব উষ্ণায়নের ফলে এক দিকে হিমবাহ গলছে, অন্য দিকে ক্ষতি হচ্ছে অরণ্যেরও। সারা পৃথিবী জুড়েই আজ বিশ্ব উষ্ণায়নের ভ্রূকুটি। শক্ত তথ্যের মাধ্যমে নয়, মণ্ডপসজ্জায় প্রাঞ্জল ভাবে ফুটিয়ে তোলা হবে এই সব দিকই।

• শকুন্তলা পার্কের ‘নেতাজি সঙ্ঘের’ পুজোর এ বারের ভাবনা ‘বৃক্ষের বন্দনে প্রাণের স্পন্দন’। গাছ না থাকলে যে পৃথিবীতে প্রাণের স্পন্দনও থেমে যাবে, সেটাই দেখানো হবে পুরো মণ্ডপ জুড়ে।

• শুধু গাছ নয়, মাটিও যে কত গুরুত্বপূর্ণ তা জানতে আসতে হবে ভবানীপুরের ‘২২ পল্লি শারদোৎসব’-এর মণ্ডপে। মাটি যে শুধু গাছকেই ধরে রাখে তা নয়, মাটি দিয়ে শিল্পীরা ফুটিয়ে তোলেন নানা শিল্পকর্ম। এই পুজোয় তাই দেখা যাবে কৃষ্ণনগরের শিল্পীদের মাটি দিয়ে তৈরি বিভিন্ন পুতুল, মাটির নানা পাত্র। মণ্ডপ জুড়ে থাকবে এক শৈল্পিক ছোঁয়া।


লোগোস হোপ— ভাসমান বইমেলা
জাহাজটির নাম লোগোস হোপ। আর তার ভেতরেই পৃথিবীর বৃহত্তম ভাসমান বইমেলা।

জাহাজটি বিশ্ব পরিক্রমা করছে জনমানসে জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে দেওয়ার লক্ষ্যে। ১৯৭০ সালে উত্তর জার্মানিতে ছোট্ট ফেরিতে করে প্রথম চলা শুরু হয়েছিল এই উদ্যোগের। প্রায় ৪১ বছর ধরে চলার মাঝে এই ২০১১ পর্যন্ত ঘটে গেছে অনেক কিছু, মালিকানা বদল থেকে দুর্ঘটনা, জাহাজ বদল থেকে নাম বদল কি হয়নি! ডাওলস, লোগোস টু থেকে এখনকার লোগোস হোপ।

ভাসমান এই বইমেলায় আছে পাঁচহাজার ‘টাইটেল’-এর প্রায় ৫ লাখ বই আর ৪৫টি দেশের প্রায় ৪৫০ জন সেচ্ছাসেবী ‘ক্রু মেম্বার’। অসরকারি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘জিবিএ শিপস’ দ্বারা পরিচালিত এই জাহাজটি সুস্থ সংস্কৃতি, জ্ঞান, ত্যাগ, আশা, সহযোগিতা ও জীবনের নতুন নতুন আঙ্গিক নিয়ে পৌঁছে যাচ্ছে মানুষের কাছে। এখানে নানা ধরনের বইয়ের পাশাপাশি আছে ‘মাল্টি কালচারাল ক্রু মেম্বার’দের সঙ্গে সংস্কৃতির আদানপ্রদান। প্রত্যেক স্বেচ্ছাসেবক বিনা পারিশ্রমিকে প্রায় দু’বছর একটানা ঘরবাড়ি, আত্মীয় পরিজন ছেড়ে এগিয়ে এসেছেন সহযোগিতা করতে। কে নেই এই সেবকদের তালিকায়! ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, কুক, মেকানিক, ক্যাপ্টেন (চালক)-সহ সাধারণ কর্মী পর্যন্ত।

জাহাজের ভিতরে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বইমেলা সত্যিই অভিনব। জ্ঞানের দিশা, আশার আলো, বিশ্ব সংস্কৃতির প্রসার এবং সহযোগিতার এক উৎকৃষ্ট উদাহরণ লোগোস হোপ।

মানুষের দেওয়া দান, বই বিক্রি ও টিকিট থেকে আসা অর্থ দিয়ে চলছে এই জাহাজ। বর্তমানে এই ভাসমান বইমেলা ভারত, শ্রীলঙ্কা ঘুরে মালয়েশিয়ার পেনাং-এ বিপুল বইয়ের সম্ভার নিয়ে হাজির হয়েছে। এর পর পোর্টক্লাং ও কুচিং হয়ে ঘুরবে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশ
জানালেন, লোগোস হোপের ক্যাপ্টেন।

তথ্য ও ছবি: ডঃ মুনমুন দত্ত
পেনাং, মালয়েশিয়া

পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট করে ইতিমধ্যেই পস্তাচ্ছি আমরা। বিশ্ব উষ্ণায়নের ফল হাতেনাতে পেয়েও টনক নড়ে ক’জনের? ব্যাতিক্রম
অবশ্য আছে। আর সেই ব্যাতিক্রমী মানুষদের প্রচেষ্টাকে কুর্ণিশ করি আমরা। তাঁদের দলবদ্ধ অথবা ব্যক্তিগত উদ্যোগকে
স্বাগত জানিয়ে পাঠক সমক্ষে নিয়ে আসার পরিকল্পনার শরীক হতে চাইলে আমাদের জানান নীচের ঠিকানায়
হাওয়াবদল, সংবাদের হাওয়াবদল



রোজের আনন্দবাজারএ বারের সংখ্যা • সংবাদের হাওয়াবদল পুরনো সংস্করণ