|
|
|
|
|
|
ফুটপাথের ‘আবহমানকাল’
পড়ে
পেলাম জীবনের উৎসাহ
দেবশঙ্কর হালদার
অভিনেতা |
|
|
আমার ছেলেবেলা থেকে বড়বেলা সব কিছুরই সাক্ষী বেলগাছিয়া। যখন খুব ছোট ছিলাম পাড়ার বাইরে পা রাখার কোনও অনুমতি ছিল না। কিন্তু বেড়ার ফাঁক খোঁজাটাও তো শৈশবের ধর্ম। তাই বাড়িতে মাকে না জানিয়েই মাঝে মধ্যে বেরিয়ে পড়তাম বাইরে। বাড়ির কাছেই ছিল বেলগাছিয়া ট্রাম ডিপো। আমাদের পাড়া প্রতিবেশীরা অনেকেই ওই ট্রাম কোম্পানিতে চাকরি করতেন। তাঁদের বাড়ির ছেলেরাও তো আমার বন্ধু। ব্যস, ওদের সঙ্গে ট্রাম চড়া। গোটা কলকাতা ঘুরে আবার ফিরে আসা। বন্ধুদের হাতে থাকত তাদের বাবা-কাকাদের দেওয়া ক্যান্টিনে খাওয়ার কুপনও— এক পয়সা, দু’ পয়সা, পাঁচ পয়সার হলুদ কুপন। খাওয়া যেত ঘুঘনি, পাঁউরুটি আর ফুলুরি।
|
পরবর্তী কালে আমার নেশা ছিল কলেজ স্ট্রিট কফি হাউসের পকোড়া আর কাটলেট খাওয়া। সেই কবে থেকে কফি হাউসে যাচ্ছি! কী খাব তার অর্ডার কিন্তু বাড়িতে বসেই দিতাম। ভাবছেন কী করে তা সম্ভব হত! বলছি। কফি হাউসের ঠিক পেছনেই ছিল আমার মেজমাসির বাড়ি। সেই বাড়ির বারান্দা থেকে কফি হাউসের রান্নাঘর দেখা যায়। আমার মাসতুতো ভাই সুদীপ্ত, বারান্দা থেকেই চিৎকার করে ওদের কানে আমার খাবারের অর্ডার পৌঁছে দিত। আমি ধীরে সুস্থে কফি হাউসে পৌঁছে সেই খাবার নিয়ে টেবিল জুড়ে বসতাম। আমার পাশেই কাঁধে বিকট ঝোলা ব্যাগ নিয়ে বসত কয়েক জন। কী যেন সব আলোচনা করত। বোঝার চেষ্টা করেও কোনও লাভ হত না।
সে সব দিন কোথা দিয়ে যেন কেটে গেল! আমার মতো আমার শহরও বাড়তে লাগল। স্কটিশ চার্চ কলেজে পড়ার সময় থেকেই রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েছিলাম। ঘুরে বেড়াতাম নানা জায়গায়। বিভিন্ন কলেজে গিয়ে বক্তৃতা দিতাম। কিন্তু এক দিন যেন সেই নেশাও কেটে গেল। আর আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলল অভিনয়ের নেশা। মাঝে মাঝে যখন কোনও পূর্ণিমার রাতে হেঁটে নান্দীকার থেকে বাড়ি ফিরতাম, আমাদের সেই বেলগাছিয়ার ট্রাম লাইনটা আরও বেশি ঝকঝকে মনে হত। সকালের রুক্ষ ও ঘষটানো সেই সব চিহ্ন কোথায় যেন উধাও হয়ে যেত।
আমার বাবা অভয় হালদার নাম করা যাত্রাভিনেতা ছিলেন। দিনের পর দিন বাড়ি থাকতেন না। গ্রামেগঞ্জে ব্যস্ত থাকতেন পালা নিয়ে। আমি তাঁকে খুব ভয় পেতাম। বাবা এখানে না থাকলেও মা ভয় দেখাতেন, “কালকেই তোর বাবা ফিরছেন। দস্যিপনার সব কথা বলে দেব”। ভয়ে চুপ! বাবা হয়তো তার পর দিন ফিরতেন না। কিন্তু ওই হুমকিতেই সাত দিন ভয়ে কাঠ!
স্কুলের
টিফিনের পয়সা বাঁচিয়ে কখনও কখনও কয়েক টাকা জমিয়ে ফেলতাম। সেই টাকা দিয়েই এক বার মহাত্মা গাঁধী রোডের ফুটপাথ থেকে তিন টাকা দিয়ে একটি বই কিনেছিলাম— অসীম রায়ের উপন্যাস ‘আবহমানকাল’। বইটি পড়ে কলকাতাকে নতুন করে আবিষ্কার করলাম। কেন জানি না, সেই বই পড়ে কলকাতার প্রেমে হাবুডুবু খেতে লাগলাম। জীবনের প্রতি নতুন করে উৎসাহও পেলাম। |
মঞ্চে... |
‘আওরঙ্গজেব’ নাটকে নামভূমিকায়
|
‘রুদ্ধসঙ্গীত’-এ দেবব্রত বিশ্বাসের ভূমিকায় |
|
তখন নান্দীকারের অফিসের বাইরে শ্যামবাজার স্ট্রিটের ফুটপাথে ‘ফুটবল’ নাটকের রিহার্সাল হত। কারণ অফিস ঘরে রিহার্সালের অত জায়গা ছিল না। সেই রিহার্সালের সময় দারুণ অভিজ্ঞতাও হয়েছিল। কত মানুষের সঙ্গে যে পরিচয় হত তা বলার নয়। পথ চলতি বহু মানুষ মহড়া দেখে আনন্দে জড়িয়েও ধরতেন। শহরটার যে কত প্রাণ ছিল এই মানুষগুলোকে দেখলে তা বোঝা যায়। সেই সব আনন্দ এখনও আমার মনের মধ্যে জমে আছে। এখন হয়তো ব্যস্ত অভিনেতা হয়েছি, কিন্তু ফেলে আসা দিনগুলো ভুলব কী করে?
ভুলতে পারি না শহিদ মিনার চত্বরকেও। কত বার যে আমার ছেলে চিকুকে নিয়ে ওখানে গিয়ে ঘুরেছি, ফুচকা খেয়েছি— তার ইয়ত্তা নেই। আমি সবুজ ঘাসের উপর চিৎ হয়ে শুয়ে আকাশ দেখছি, চিকু দৌড়ে বেড়াচ্ছে ঘাসের উপর। আহা কী আনন্দ! কী অপূর্ব অনুভব। এখন যখন মধ্যরাতে শুনশান রাজপথ ধরে ধর্মতলা দিয়ে এগোই, দূর থেকে ওই শহিদ মিনার দেখলে নিজের মনে এখনও বলে ফেলি, আমাকে যে ওর মতোই বড় হতে হবে এক দিন। পারব তো? |
|
|
|
|
|
|