|
|
|
|
|
|
প্রবীণা হলেও চির নবীনা |
শাশ্বতী দাস
(বেঙ্গালুরু থেকে) |
কলকাতা,
মানে,
— শিকড়ের যোগ, নাড়ীর টান
— মনুমেন্টের চূড়ায় উঠে গোটা শহরটাকে এক বার দেখার গোপন ইচ্ছে
— প্রিন্সেপ ঘাট-মিলেনিয়াম পার্ক থেকে সূর্যাস্ত
— ঘুম ভাঙা চোখে গরম চা আর আনন্দবাজার কী বলল তা জানার আগ্রহ
— বর্ষায় এক হাঁটু জল-কাদা মেখে কাকভেজার স্বাধীনতা
— সরস্বতী পুজোয় স্কুল-কলেজে ঘুরে রঙিন প্রজাপতি হওয়া
— কলেজ কেটে প্রথম সিনেমা দেখার নিষিদ্ধ আনন্দ,
বাড়ি ফেরার পথে গাঙ্গুরাম-নন্দলাল-কলসের মিষ্টি খাওয়া যথেচ্ছ
— হাতিবাগান-গড়িয়াহাটের ফুটপাথে প্রচণ্ড দর-দাম করে পাঁচ টাকার দুল কিনে রাজত্ব-প্রাপ্তি
— সিটি সেন্টার-স্বভূমি-সাউথ সিটির ‘উইন্ডো শপিং’ সেরে রাস্তার ধারের ফুচকা আর ফাউ চেয়ে চেয়ে ফুচকাওয়ালাকে বিরক্ত করা
— কলেজ স্ট্রিটের পুরনো বইয়ের স্টক ঘেঁটে গলদঘর্ম হয়ে প্যারামাউন্টের শরবত
— পার্ক স্ট্রিটের নির্দিষ্ট আইসক্রিম পার্লারে একাধিক আইসক্রিমে ডুবে ‘আমি দিবস’ উদযাপন
— অটোওয়ালার ডান পাশে বসে নিপাট বেপরোয়া
— অফিস টাইমে মেট্রোতেই বনগাঁ লোকালের এলবো-পুলিং
— শিয়ালদহ স্টেশনে টিকিট ফাঁকি দিয়ে যাতায়াতের উগ্র বিপ্লব
— প্রথম প্রেমে ‘দাগা’ খেয়ে মহানগরীর পথে উদ্দেশ্যহীন হাঁটা
— বেথুন কলেজের পাশে তরুণ পুলিশ সার্জেন্টকে অনাবিল ‘ঝাড়ি মারা’
— ভ্যালেন্টাইন্স ডে-র দিন গড়িয়াহাট মোড়ের চলমান ভীড়ে একাকিত্ব অনুভব
— প্রথম মাসের মাইনেতে মা-বাবাকে নিয়ে দক্ষিণেশ্বর-বেলুড় মঠ বা ভাইয়ের দাবিতে পিটার ক্যাট,
অ্যান্টি জাঙ্ক ফুড দাদুকেও ফুচকার প্রেমে ফেলা
— মাঝরাতের অসহ্য পেট ব্যাথায় পাশের বাড়ির ডাক্তারকাকুর প্রাণখোলা সাহায্য
— দোলের দিন পাড়ার সকলে প্রভাতফেরীর গান
— পাড়ার মুচি দাদুর সঙ্গে অনর্গল বকবক
— হাউজিং কমপ্লেক্সের কচিকাঁচাদের নিয়ে রবীন্দ্রজয়ন্তী
— জন্মাষ্টমীর পর থেকেই পাড়ায় পাড়ায় থিম পুজো আর শারদোৎসবের প্রস্তুতি
— শিউলির গন্ধ
— ঘেমে-নেয়ে উত্তর-দক্ষিণ মন্থন করে ‘পুজো শপিং’
— নিউ মার্কেটের কামানকে সেন্টার করে ঘুরতে থাকা গোলোকধাঁধায়
— নাহুমের কেক আর ছাম্বা লামার সিলভার জুয়েলারি
— বাবার হাত ধরে গঙ্গার পাড়ে সপ্তমীর কলাবউ স্নান দেখা
— দুর্গাপুজো-টু-কালিপুজো— ‘ফেস্টিভ সিজনে’ আলোকোজ্জ্বল প্রাঞ্জলতা
— সোমেন-ফাটাকেষ্টর কালিঠাকুর বিসর্জন দেখার প্রাণপন দৌড়
— টানা রিকশা উঠে যাওয়ার পক্ষে গলাবাজি
— পোস্তা-বড়বাজারে ঠ্যালা-লরি-মিনিবাসের ‘ট্রায়ো কম্পিটিশন’
— ২০০৩-এ জানুয়ারির শীতের রাত-আকাশে কল্পনা চাওলার কলাম্বিয়া ‘স্পেস শাটল’কে খুঁজে পাওয়ার আনন্দ
— নন্দন, অ্যাকাডেমিতে সিনেমা-নাটক বা কবিতা উৎসবে নাক গলানো
— বারো দিন ধরে ময়দানের বইমেলার ধুলোয় স্নান করে শেষ দিনে চোখের জলে রাত ন’টার ঘন্টাধ্বনিতে ‘হাততালি’
— লাল না সবুজ— ‘অবভিয়াস’ তর্ক
— যৌথ পরিবার ভেঙে অণু পরিবারে বদ্ধ হওয়ার যন্ত্রণা
— ক্রম বর্ধমান ফ্যাশন শো-নাইট লাইভ বা লেট নাইটে নিঃসাড়ে নিজেকে ‘সেট’ করে নেওয়া
— টালা থেকে টালিগঞ্জের অজস্র ফুটপাথে সব হারানো মানুষদের ভর-ভরন্ত (!) সংসার
— সামাজিক ছত্রাকগুলো না সরিয়ে চলচ্চিত্রের ‘ছত্রাক’ নিয়ে অযথা মস্তিষ্ক-বিভ্রাট
— বৃষ্টিস্নাত শহরকে সাক্ষী রেখে জীবনসঙ্গীকে খুঁজে পাওয়া
— ক্রমশ অনতিক্রম্য পরিবর্তনের স্রোতে ভাসতে শেখা...
কলকাতা মানে যে ঠিক কী তা বোধহয় অল্পে বলা অসম্ভব।
সুতানুটির কাল থেকে পরিবর্তনের স্রোতে ভেসে আজ কলকাতা ‘সিটি অফ কালার্স অ্যান্ড লাইফ’। এ কলকাতা কত স্মৃতি বুকে নিয়ে, কত্ত রাজনৈতিক-সামাজিক অবক্ষয়ের নির্বাক সাক্ষী। বয়সের ভারে জীর্ণ নয়, আজ সে অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধ। কলকাতা নিয়ে বলতে গিয়ে কত কী যে বাদ পড়ে গেল! সমুদ্রের ধারে ঝিনুক তোলার মতোই না-বলা রইল বেশির ভাগ।
কথায় আছে দাঁত থাকতে দাঁতের মর্যাদা কেউ দেয় না। কথাটা হাড়ে হাড়ে সত্যি। যত দিন কলকাতায় থেকেছি, বুঝিনি এই শহরের এত মায়া, এত মোহ, এত প্রেম, এত প্রাণপ্রাচুর্য! আবার কত অন্ধকার, প্রকাশ্য আলোয়ও যা চোখে পড়ে। লোকজন রাস্তায় যেখানে সেখানে ‘ডোন্ট কেয়ার’ জলবিয়োগ করছে। ফুটপাথের বাচ্চারা ‘পটি’ করছে দেখে মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছি। এই সব পরিবর্তনগুলোর প্রায়োজনীয়তা নিয়ে মাথা ঘামানোর প্রয়োজন অনুভূত হয়নি। এখন যে শহরে থাকি সেখানে ওই দৃশ্য বিরল। তাই ভীষণ প্রকট এখন ‘ল্যুপ হোল’গুলো। মনে হয় যদি ম্যাজিক তুলি-রং দিয়ে ভরাট করে দিতে পারতাম! গতবার কলকাতা গিয়ে হাতিবাগান মোড়ের ফুটপাথের ধারে দেখলাম একটা বাচ্চা ছেলে ‘পটি’ করছে। সেদিন মুখ ঘুরিয়ে নিতে পারিনি! একটা বিরাট শহরের বুকে এই তুচ্ছ ছবিও খুব দামি মনে হল। না হয় আমার শহরে এখনও এ রকম কিছু ‘কলঙ্ক’ আছে! সে তো চাঁদেও আছে! আমার শহর যে বিষ্ঠা বুকে নিয়েও কল্লোলিনী! চোখে জল এল। সহ্যশক্তির চরম নিদর্শন যে আমাদের বুড়ি-কলকাতাই। আগে তো এ ভাবে দেখিনি কোনও দিন! পরিবর্তনের সার্বিক প্রচেষ্টার স্রোতে এই কলঙ্কও ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে যাবে এক দিন। হারিয়ে কি যাবে না ওই ‘দৃশ্য’গুলো? সে দিন আমার শহর ‘জগত্সভা’য় সত্যি ‘শ্রেষ্ঠ’ আসনে বসবে।
প্রায় দু’ হাজার কিলোমিটার দূর থেকে কলকাতার গন্ধ, ওম, স্পর্শ পেতে ইচ্ছে করে খুব। কলকাতাগামী ট্রেন বা প্লেন যেই কলকাতার মাটি ছোঁয়, এক অদ্ভুত, অব্যক্ত, আনন্দ-অনুভূতি–শিহরণ হয়। নিজের জায়গা, নিজের শহর। ট্রেনে আসতে আসতে বাংলায় লেখা দেওয়াল লিখন প্রথম যেই চোখে পড়ে, মনটা নেচে ওঠে, গেয়ে উঠি ‘ঘরে ফেরার গান’। কিন্তু আবার ফিরে আসতে হয় কর্ম জগতে, অন্য শহরে। বিয়ের পরের দিন শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার সময় তত কাঁদিনি, যত কাঁদি এখন— প্রতি বার আমার শহরকে ছেড়ে আসার সময়। শুধু যে মা-বাবার জন্যই মন কেমন করে তাই নয়, থেকে যায় অনেক কিছু। কোনও ব্যাগেই যে সে সব ঢোকাতে পারব না কোনও দিন!
প্রতি বার চোখে জল নিয়ে তোমাকে ছেড়ে আসি যখন, রেখে আসি আমার মা-বাবা-ভাই-বন্ধু-স্বজন, আমার কৈশোর-যৌবন, হয়তো বা আধখানা মনও। সবাইকে নিয়ে ভাল থেকো কল্লোলিনী তিলোত্তমা, প্রবীণা হলেও চির নবীনা ‘আমার শহর, কলকাতা’।
|
কলকাতায় জন্ম, বিবাহসূত্রে বেঙ্গালুরুর বাসিন্দা। অবসর সময় কাটে গান শুনে আর ঘর গুছিয়ে। আর সুযোগ পেলে কবিতা লিখতে এবং পড়তে খুবই ভালবাসেন। তবে সবচেয়ে ভাল লাগে মানুষের সঙ্গে মিশতে। রান্না করতে একটুও ভাল লাগে না। কর্মজীবনের প্রথম দিকে ছিলেন মধ্য কলকাতার এক কলেজের আংশিক সংয়ের শিক্ষিকা। আর এখন শিক্ষকতা করেন বেঙ্গালুরুর একটি স্কুলে। |
|
|
|
|
|
|