|
|
|
|
|
ঐতিহ্য |
ন্যাশনাল থিয়েটারের বাড়ি |
কলকাতা নাটকের শহর। এমন নাট্যপ্রেমী শহর ভূ-ভারতে বোধহয় আর দ্বিতীয়টি নেই। বাংলার সুপ্রাচীন যাত্রা ঐতিহ্যের সঙ্গে বিদেশি থিয়েটার মিশে ক্রমে যে উন্নত থিয়েটার সংস্কৃতির জন্ম হয়েছিল, আজও কলকাতা তা সগৌরবে বহন করে চলেছে।
উনিশ শতকের কলকাতা ছিল একেবারে গণ্ডগ্রাম। মনোরঞ্জনের মাধ্যম বলতে ছিল গ্রাম্য যাত্রা, কবিগান আর পাঁচালির আসর। কিন্তু সে সব দেশি নাচ-গান সাহেবদের ভাল লাগবে কেন! তাই তারা নিজেদের রুচি-সংস্কৃতি অনুযায়ী নাচ-গান-অভিনয়ের ব্যবস্থা করতে সচেষ্ট হল। তারই ফল হিসেবে উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে কলকাতা গ্রামে একে একে গড়ে উঠতে থাকে বিদেশি ধাঁচের নাচ-গান-অভিনয়ের কেন্দ্র। ভারতীয় সংস্কৃতিতে নাট্যাভিনয় প্রচলিত থাকলেও বঙ্গদেশে তার কোনও প্রভাব ছিল না। এখানকার প্রাচীন অভিনয় ঐতিহ্য হল যাত্রা। আর সেই যাত্রা হত খোলা জায়গায়, দর্শকের মধ্যে। ইংরেজিতে যাকে বলে প্রসেনিয়াম, সেই বাঁধা মঞ্চের কোনও ধারণা আগে এখানে ছিল না। ইউরোপের নাট্যধারার অনুকরণে সাহেবরা সেই বাঁধা মঞ্চ বা প্রসেনিয়াম থিয়েটারের প্রবর্তন করল এ দেশে। |
|
কলকাতা শহরের প্রথম যে মঞ্চটির কথা জানা যায়, সেটি ইংরেজদের তৈরি। নাম The Play House। এর সঠিক প্রতিষ্ঠাকাল জানা যায় না, তবে ১৭৫৩ সালের উইলস-এর ম্যাপে এর উল্লেখ পাওয়া যায়। পূর্বতন ডালহৌসি স্কোয়্যার বা বর্তমান বিনয় বাদল দীনেশ বাগ অঞ্চলে সেন্ট অ্যান্ড্রুজ চার্চের বিপরীতে, এখন যেখানে মার্টিনবার্ন বিল্ডিংটি রয়েছে, সেখানেই ছিল The Play House নামের ওই নাট্য মঞ্চটি। নাট্যঘরটির ঠিক সামনেই লালদিঘি আর দিঘির অপর পাড়েই ছিল সে যুগের ইংরেজদের প্রথম কেল্লা ফোর্ট উইলিয়ম। ১৭৫৬ তে সিরাজদ্দৌল্লার কলকাতা আক্রমণের সময়ে মঞ্চটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, পরে সেটি একটি নিলামঘরে পরিণত হয়।
কলকাতার মঞ্চের ইতিহাসে দ্বিতীয় যে নামটি পাওয়া যায়, সেটি হল—The New Play House বা Calcutta Theatre। কলকাতার নাট্যচর্চার ইতিহাসে Calcutta Theatre-এর আলাদা গুরুত্ব আছে। ওই থিয়েটারে ১২০ টাকার টিকিট কাটলে এক জন পুরুষ ও তাঁর বাড়ির মহিলারা ছ’টি নাটকের অভিনয় দেখার সুযোগ পেতেন। নাটকের দর্শক প্রায় সবাই ইংরেজ, কারণ সে যুগে ১২০ টাকা দিয়ে থিয়েটারের টিকিট কাটার মতো ধনী ভারতীয় খুব কমই ছিল। ১৮০৮ সালে সেটি বন্ধ হয়ে যায়। সে জায়গায় এখন নিউ চায়নাবাজার তৈরি হয়েছে। এ ছাড়া আরও ইংরেজি নাট্যশালার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল— মিসেস ব্রিস্টোস প্রাইভেট থিয়েটার (১৭৮৯), লেবেদেফের দ্য বেঙ্গলি থিয়েটার (১৭৯৫), হোয়েলার প্লেস থিয়েটার (১৭৯৭), এথেনিয়াম থিয়েটার (১৮১২) এবং চৌরঙ্গি থিয়েটার (১৮১৩), টাউন হল (১৮১৪), খিদিরপুর থিয়েটার (সম্ভবত ১৮১৫), দমদম থিয়েটার (১৮১৭), বৈঠকখানা থিয়েটার (১৮২৪), সাঁসুচি থিয়েটার (১৮৩৯)। এ ছাড়াও ড্রামন্ড থিয়েটার, জুভেনাইল থিয়েটার, রয়্যাল অ্যালবার্ট থিয়েটার, সেন্ট জেমস থিয়েটার, মিসেস লিউইসের থিয়েটার রয়্যাল, অপেরা হাউস (লিন্ডসে স্ট্রিট, এটাই আজকের গ্লোব সিনেমা হল), থিয়েটার রয়্যাল, থিয়েটার গ্যারিসন ইত্যাদির নাম উল্লেখযোগ্য।
সাহেবদের দেখাদেখি বাঙালি হিসাবে রঙ্গমঞ্চ স্থাপনে প্রথম উৎসাহী হলেন প্রসন্নকুমার ঠাকুর। তিনি শুড়া অঞ্চলে তাঁর বাগানবাড়িতে ১৮৩১ সালে ‘হিন্দু থিয়েটার’ নামে এক নাট্যশালা স্থাপন করেন। এর পরে নবীনচন্দ্র বসুর শ্যামবাজার থিয়েটার (১৮৩৫), ‘শোভাবাজার নাটমন্দির’ (১৮৪৪), ওরিয়েন্টাল সেমিনারির ছাত্রদের তৈরি ‘ওরিয়েন্টাল থিয়েটার’(১৮৩৫), জোড়াসাঁকো থিয়েটার (১৮৫৪), ছাতুবাবুর ঠাকুরদালান (১৮৫৭), বিদ্যোৎহিনী রঙ্গমঞ্চ (১৮৫৭), বেলগাছিয়া নাট্যশালা (১৮৫৮), মেট্রোপলিটন থিয়েটার (১৮৫৯), পাথুরিয়াঘাটা নাট্যশালা (১৮৫৯), পাথুরিয়াঘাটা বঙ্গনাট্যালয় (১৮৬৫), শোভাবাজার প্রাইভেট থিয়েট্রিক্যাল সোসাইটি (১৮৬৫), জোড়াসাঁকো নাট্যশালা (১৮৬৫), বহুবাজার বঙ্গনাট্যালয় (১৮৬৮), কৃষ্ণচন্দ্র দেবের ওরিয়েন্টাল থিয়েটার (১৮৭৩), জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভারত সংগীত সমাজ (১৮৯৮) প্রভৃতি মঞ্চগুলি বাঙালিদের উদ্যোগে স্থাপিত হয়। এই পর্যন্ত যে সব নাট্যমঞ্চের কথা বলা হল, সেগুলি প্রায় সবই সখের থিয়েটার। এ বার আমরা আসব পেশাদার থিয়েটারের কথায়।
সাবেক কলকাতার পাথুরিয়াঘাটা অঞ্চলে মধুসূদন সান্যালের ৩৬৫ নম্বর আপার চিৎপুর রোডের বাড়ির একতলা ভাড়া নিয়ে দীনবন্ধু মিত্রের ‘নীলদর্পণ’ নাটকের অভিনয় দিয়ে ১৮৭২-এর ৭ ডিসেম্বর সূচনা হয়েছিল বাংলা পেশাদার থিয়েটারের। বাগবাজার নাট্যসমাজের সভ্যেরা টিকিট বিক্রি করে থিয়েটার করবার বাসনায় প্রতিষ্ঠা করেন ‘ন্যাশনাল থিয়েটার’। গোড়ায় ছিলেন অর্ধেন্দুশেখর মুস্তফি, অমৃতলাল বসু, অবিনাশচন্দ্র কর, ধর্মদাস সুর প্রমুখ সে যুগের বিশিষ্ট নাট্য-ব্যক্তিত্বরা। সূচনায় না থাকলেও পরে গিরিশচন্দ্র ঘোষও যোগ দেন ন্যাশনাল থিয়েটারে। বাংলার এই প্রথম পেশাদার থিয়েটার দলের কিন্তু কোনও নিজস্ব রঙ্গমঞ্চ ছিল না। পেশাদার থিয়েটার হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলেও ন্যাশনাল থিয়েটার কিন্তু বেশি দিন টিকে থাকতে পারেনি। মাত্র তিন মাসের মধ্যে বন্ধ হয়ে যায়। আভ্যন্তরীণ কোন্দল ও পেশাদারিত্বের অভাবেই সেটি বন্ধ হয়ে যায়। তার কয়েক বছর পরে, ১৮৭৬-৭৭ সাল নাগাদ সান্যালদের কাছ থেকে আশুতোষ মল্লিক বাড়িটি কিনে নেন। আশুতোষের ভাই মতিলালের উত্তরপুরুষেরাই এখন বসবাস করেন এখানে।
মল্লিকদের হাতে সে বাড়ির পরিবর্তন ঘটে অনেকটাই। ম্যাকিনটশ বার্ন সে যুগের রীতি অনুয়ায়ী বাড়িটির অঙ্গসজ্জা করে এবং বাড়ির মাথায় বসিয়ে দেয় এক বিশাল ঘড়ি। তার পর থেকে লোকমুখে বাড়িটির নাম হয়ে যায় ‘ঘড়িওয়ালা মল্লিক বাড়ি’। ‘কুক অ্যান্ড কেলভি’-র তৈরি সে ঘড়ি আজও সচল। বড় ঘড়িটি ছাড়াও এক সময়ে এই বাড়িতে ছিল ছোট-বড় নানা রকমের ঘড়ি ও ঔপনিবেশিক যুগের হরেক আসবাব এবং ভেনাস মূর্তি। ঢালাই লোহার গার্ডেন চেয়ার ও কিছু চিনেমাটির সাবেক গাছের টব ছাড়া এখন অবশ্য বিশেষ কিছুই নেই। মূল ঠাকুরদালানটি এখন আর না থাকলেও তৈরি করে নেওয়া হয়েছে অপেক্ষাকৃত ছোট মাপের একটি ঠাকুর দালান। বাড়ির বাসিন্দাদের উৎসাহে, ১৯৭২-এ ‘ন্যাশনাল থিয়েটার’-এর শতবর্ষ পূর্তির সময়ে সেই দালানেই গ্যাসবাতি জ্বালিয়ে অভিনীত হয়েছিল ‘নীলদর্পণ’ নাটক। রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে শহরের প্রাচীন স্থাপত্যের বেশিরভাগই যখন ভগ্নপ্রায় কিংবা স্থানাভাব দূর করতে সেগুলি ভেঙে বহুতল তৈরি হচ্ছে, তখন শুধু ইতিহাস রক্ষার তাগিদেই বহু অর্থ ব্যয় করে কলকাতা পুরসভার হেরিটেজ তালিকাভুক্ত এই বাড়ির পুরনো অবয়বকে রক্ষা করে চলেছেন পাথুরিয়াঘাটার ঘড়িওয়ালা মল্লিক বাড়ির বর্তমান সদস্যেরা।
|
তথ্য ও ছবি: গৌতম বসুমল্লিক |
|
|
|
|