প্রবন্ধ ২...
রাজারাজড়ার বড় ইতিহাস ছাড়িয়ে
৯৫২ সালে পঞ্চম শ্রেণিতে ভর্তি হলাম। স্কুলের নাম ময়ূরভঞ্জ স্টেট সিলভার জুবিলি হাইস্কুল। জায়গাটা বর্তমান পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার গোপীবল্লভপুর থানার নয়াবসানে। সাবেক নয়াবসান পরগনা ছিল ময়ূরভঞ্জ রাজার খাস তালুক। রাজা সেখানে একটা মিডল ইংলিশ স্কুল খুলেছিলেন, রাজকোষাগার থেকে খরচপত্র আসত। সেটাই ১৯৩৫-এ হাই স্কুল হল, পঞ্চম জর্জের রাজত্বের রজত জয়ন্তীর বছর বলে রাজার ইচ্ছায় স্কুলের নাম হল সিলভার জুবিলি হাই স্কুল। স্বাধীন ভারতে, ১৯৫৬ সালে স্কুলের পরিচালন সমিতি এর নাম বদলে রাখেন নয়াবসান জনকল্যাণ বিদ্যাপীঠ। প্রাথমিক শিক্ষার জন্য ভর্তি হতে হয়েছিল নিকটবর্তী সিজুয়া মৌজায় আমার গ্রাম ধর্মপুরে স্কুল ছিল না। কিন্তু সেখানে পাঠশালা ছিল, ওড়িয়া ভাষায় শিক্ষাদান চলত। ঠাকুরদা ও তাঁর ভাইয়েরা সেই পাঠশালায় পড়েছিলেন। বাড়িতে ওড়িয়া ভাষায় তালপাতায় লেখা অনেক পুঁথি ছিল। ঠাকুরদা রোজ সন্ধেবেলা সেই সব পুঁথি সুর করে পড়তেন, অনেকে শুনতে আসত।
১৯৩১ সালে যখন আলাদা ওড়িশা রাজ্য গঠনের আন্দোলন হয়, তখন নয়াবসান পরগনা সহ বেশ কিছু এলাকা ওড়িশার অন্তর্ভুক্ত হবে কি না, সেটা নিয়ে বিতর্ক দেখা দেয়। ভারত সরকার নিযুক্ত সামুয়েল ওডোনেল কমিটি রায় দেয় যে, মেদিনীপুর জেলার কোনও অংশ ওড়িশার অন্তর্ভুক্ত হবে না। ফলে নয়াবসান পরগনা বাংলাতেই থেকে যায়। এর ফলে ওড়িয়াভাষী ওই এলাকার মানুষের শেষ পর্যন্ত লাভ হয়েছে কি না, সেটা ভবিষ্যৎ বলতে পারবে। কিন্তু তার আশু ফল এই হল যে, একটা গোটা প্রজন্ম নিরক্ষর হয়ে গেল। আমার ঠাকুরদা ও তাঁর ভাইয়েরা সকলেই সাক্ষর ছিলেন। কিন্তু আমার বাবা-জ্যাঠাদের গোটা প্রজন্ম নিরক্ষর হয়ে যায়। পরের প্রজন্মে আমরা বাংলায় পড়াশোনা করে সাক্ষর হই। আর একটি ফল, এলাকার মানুষদের মধ্যে একটা জাতীয় হীনম্মন্যতার বোধ গড়ে ওঠা। তারা ইস্কুলে বাংলা শিখে ‘বাঙালি’ হওয়ার চেষ্টা করল, কিন্তু সেটা হয়ে উঠতে পারল না।

বৌদ্ধ সংস্কৃতির নিদর্শন। মোগলমারি উৎখনন, দাঁতন, পশ্চিম মেদিনীপুর।
আসলে ওই সীমান্ত এলাকা (যা এখন জঙ্গলমহল বলে পরিচিত) দীর্ঘকাল ধরে মুঘল ও মরাঠাদের মধ্যে আধিপত্যের সীমারেখা ছিল এবং আধিপত্যের জন্য সংঘর্ষে কখনও মরাঠারা এগিয়ে আসত তো কখনও মোগলরা তাদের হটিয়ে দিত। মরাঠাদের আক্রমণে পর্যুদস্ত হয়ে আলিবর্দি খাঁ ১৭৫১ সালে মরাঠাদের সঙ্গে একটি শান্তি-চুক্তি স্বাক্ষর করেন। চুক্তি অনুযায়ী সুবর্ণরেখা নদীকে বাংলা ও ওড়িশার সীমারেখা ধরা হয় এবং নদীর অংশ ওড়িশা ও উত্তরাঞ্চল বাংলা হিসেবে পরিগণিত হয়। ময়ূরভঞ্জের রাজারা ছিলেন মরাঠাদের আশ্রিত। সুবর্ণরেখার দক্ষিণ তীরে মরাঠারা যে অনেক ঘাঁটি ও মন্দির তৈরি করেছিল, তার বহু নিদর্শন এখনও রয়েছে।
ষোড়শ শতকে শ্রীচৈতন্য যখন পুরী যান, তখন কলাইকুন্ডার কাছে ধারেদা গ্রামে রাত্রি যাপন করেছিলেন এবং সেই গ্রামের সদগোপ জাতির এক ভক্ত তাঁর শিষ্য হয়েছিলেন। তিনি শ্যামানন্দ। সুবর্ণরেখা ও ডুলং-এর সংযোগস্থলে স্থিত রোহিণী গ্রামের রসিকানন্দ হলেন শ্যামানন্দের শিষ্য। রসিকানন্দ সুবর্ণরেখার দক্ষিণ তীরে গোপীবল্লভপুরে রাধাকৃষ্ণ মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। এটা সপ্তদশ শতকের প্রথম ভাগে। এই তিনশো বছর ধরে সুবর্ণরেখার দু’পাশের গ্রামগুলো শ্রীচৈতন্য ভাবধারার মধ্যে থেকেছে। মনে হয়, এই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে জঙ্গলমহলে বসবাসকারী অনেক আদিবাসী বা অর্ধ-আদিবাসী জনগোষ্ঠী হিন্দু সমাজের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
সুবর্ণরেখা বেরিয়েছে ছোটনাগপুর মালভূমি থেকে। তার গতিপথ জুড়ে ইউরেনিয়াম, সোনা ও তামা প্রভৃতি ভারী ধাতুর আকরিক ছিল বা এখনও আছে। সুতরাং এটা স্বাভাবিক যে, লোহার ব্যবহার শেখার আগেই তাম্র-প্রস্তর যুগে মানুষ তামার খোঁজে এখানে বসতি স্থাপন করেছিল। কয়েক বছর আগে সুবর্ণরেখার বন্যায় ধস নামায় নয়াগ্রাম-গোপীবল্লভপুর সীমান্তে পাতিনা গ্রামে তাম্রযুগের চুল্লি আবিষ্কৃত হয়। সম্প্রতি দাঁতনের কাছে মোগলমারিতে প্রত্নতাত্ত্বিক উৎখননে অন্তত ষষ্ঠ শতক থেকে বৌদ্ধ সংস্কৃতির নিদর্শন পাওয়া গেছে। দাঁতনের কাছেই সরশঙ্কা নামে একটি বিরাট দিঘি রয়েছে (যার আয়তন ৫০০ একরের বেশি), যা সপ্তম শতকে রাজা শশাঙ্কের আমলে সেচের সুবিধার জন্য খনন করা হয়েছিল।
জঙ্গলমহল বা সুবর্ণরেখা অববাহিকায় আজকের সামাজিক অর্থনৈতিক অবস্থা বুঝতে হলে এই দীর্ঘ ইতিহাস অনুধাবন করা প্রয়োজন। সেই অনুসন্ধান তখনই অর্থবহ ও কার্যকর হবে, যখন এলাকার মানুষ তাতে হাত লাগাবেন। সম্প্রতি গোপীবল্লভপুরের ছেলে মধুপ দে ঝাড়গ্রামের ইতিহাস অনুসন্ধানের কাজে হাত লাগিয়েছেন। মধুপ অধ্যাপক বা গবেষক নন, এক জন অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মচারী। কিন্তু নিজের ইতিহাস জানার তাগিদে তিনি কঠোর পরিশ্রম করেছেন এবং সপ্তদশ শতকে রচিত ‘রসিক মঙ্গল কাব্য’ সহ জঙ্গলমহলের ইতিহাস নিয়ে ইংরেজ প্রশাসকরা ও পরবর্তী কালের গবেষকরা যা-কিছু লিখেছেন, সেগুলো তিনি যত্ন সহকারে অধ্যয়ন করেছেন। তাঁর লেখা যদি অনেক মানুষকে অনুপ্রাণিত করে, তা হলে একটি সত্যিকারের ইতিহাস চর্চা শুরু হবে। জঙ্গলমহলের ইতিহাস খুঁজতে গিয়ে মানুষ দেখবে যে, তারা এমন এক ঐতিহ্যের উত্তরাধিকারী, যেখানে পাথরের হাতিয়ার ও তামা ব্রোঞ্জের হাতিয়ারের যুগ থেকে আধুনিক যুগ পর্যন্ত বহু জনগোষ্ঠী এবং বহু সংস্কৃতি এসে মিশেছে। তারা কারও চেয়ে উত্তম বা অধম নয়। এটা এক দিকে যেমন জাতীয় হীনম্মন্যতা কাটাতে সাহায্য করবে, তেমনই উগ্র-পরিচিতিবাদকে (‘আমরা আলাদা বা সবার উপরে’) প্রশমিত করবে।
কথাটা শুধু জঙ্গলমহলের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। দেশের যে-কোনও প্রান্তেই খুঁজলে পাওয়া যাবে বহু মানুষের পদচিহ্ন, তাদের ব্যবহৃত হাতিয়ার, তাদের কৃষি ও শিল্পকর্মের নানা নিদর্শন এবং ভিন্নতর বহু মানুষের সঙ্গে তাদের লেনদেন ও সংমিশ্রণ। সবাই তাদের মতো করে মানবজাতির সাধারণ অভিজ্ঞতাকে সমৃদ্ধ করেছে, আবার তার থেকে কিছু না কিছু নিয়ে নিজেদের সমৃদ্ধ করেছে। তাই, স্থানীয় ইতিহাসের চর্চা সব এলাকার জন্যই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বহু মানুষের অংশগ্রহণ ছাড়া এই চর্চা গড়ে উঠতে পারে না। বিশেষজ্ঞদের প্রয়োজন রয়েছে। অধ্যাপক গবেষকরা তাঁদের পাঠাগারে বসে অবশ্যই গবেষণা করবেন। কিন্তু বহু মানুষ কাজে না নামলে একটা সামগ্রিক ইতিহাস চর্চার বিকাশ ঘটবে না।
দেশের বিস্তৃত গ্রামাঞ্চলে এখন বহু প্রাথমিক ও উচ্চ বিদ্যালয় রয়েছে। তাতে অনেক শিক্ষকশিক্ষিকা কর্মরত। তাঁরা ছাত্রছাত্রীদের ইতিহাস পড়ান। কিন্তু তা সাধারণ ইতিহাস, বিশ্ব-ইতিহাস বা ভারতবর্ষের ইতিহাস, যা তাঁরা বইয়ে পড়েছেন, মুখস্থ করে পাশ করেছেন। শিশুদেরও কিছু নাম ধাম সাল সন তারিখ মুখস্থ করতে বলা হয়। শিক্ষকরা যদি স্থানীয় ইতিহাস অনুসন্ধানের জন্য অনুপ্রাণিত হন, তা হলে তাঁরা যেমন অনেক মালমশলা সংগ্রহ করতে পারেন, তেমনই ছাত্রছাত্রীদের মধ্যেও একটা ঐতিহাসিক অনুসন্ধিৎসা তৈরি হতে পারে।
গোটা দেশ জুড়ে আমরা যদি এই ধরনের চর্চা শুরু করতে পারি, তা হলে শুধু যে ইতিহাস সমৃদ্ধ হবে তা-ই নয়, যে মানুষেরা এই চর্চার সঙ্গে যুক্ত হবেন, তাঁদের ইতিহাস-চেতনাও বৃদ্ধি পাবে। সেই মানুষেরা যে জাতীয়তা বা পরিচিতির মধ্যে জন্মেছেন বা যে সংস্কৃতির মধ্যে লালিত-পালিত হয়েছেন, তার প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকেও ভিন্ন জাতীয়তা, পরিচিতি বা সংস্কৃতিকে ‘অপর’, তুচ্ছ বা নিকৃষ্ট হিসেবে না দেখে, তার মধ্যে যা-কিছু ভাল, সেটা গ্রহণ করবার চেষ্টা করবেন। মানবসমাজ এ ভাবেই আরও মানবিক হয়ে ওঠার পথে এগোবে।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.