প্রবন্ধ ১...
কেবল শিক্ষকের নয়, দায়িত্ব সকলেরই
কটা সময় ছিল খুব বেশি দিন নয়, এক-দেড় দশক আগেই যখন আমাদের বাচ্চাদের বড় একটা অংশই স্কুলে যেতে পারত না। বঞ্চিত এই শিশুদের বেশির ভাগই ছিল মেয়েরা; এদের প্রতি অবহেলার প্রতিফলন দেখা যায় নারী-সাক্ষরতার নিম্ন হারে। অবস্থাটা বেশ খানিকটা বদলেছে: স্কুল ব্যবস্থার প্রসার, নতুন নতুন স্কুল খোলা, স্কুলে ভর্তি করার ‘অভিযান’, মিড-ডে মিল প্রভৃতির যৌথ প্রভাব মা-বাবার আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে যুক্ত হয়ে পরিস্থিতিটাকে খানিকটা আশাপ্রদ করে তুলেছে; এখন প্রায় সব শিশুই স্কুলে আসতে পারে। এবং বাচ্চারা যে কিছু শিখছে তার প্রমাণও পাওয়া যাচ্ছে; যেখানে ২০০১-০২ সালে ৩০ শতাংশ বাচ্চা নিজের নাম লিখতে পারত না, ২০০৮-০৯ সালে সে সংখ্যাটা নেমে দাঁড়ায় ৪ শতাংশ (অন্তত একটি সমীক্ষা থেকে এই সিদ্ধান্ত বের হচ্ছে)। ২০১১ সালে উত্তরবঙ্গের পিছিয়ে পড়া জেলাগুলোতে এবং ২০১২ সালে পশ্চিমাঞ্চলের অনগ্রসর জেলাগুলোতে করা সমীক্ষায়ও আমরা এই অগ্রগতি লক্ষ করেছি।
কিন্তু এই অগ্রগতিকে বাচ্চাদের প্রকৃত অর্জনের প্রতিফলন হিসাবে না দেখে, একটা অনুপ্রেরণা হিসাবেই দেখা উচিত; কিছু যে করা সম্ভব, সেই বিশ্বাসটাকে বলবান করে তোলার ক্ষেত্রে এর ভূমিকা। কেননা, শুধুমাত্র নাম লিখতে পারছে কি না সেটা দিয়ে বাচ্চাদের শিক্ষা কতটা হল তার বিচার চলে না; কতটা এগনো গেল, যতটা এগোতে চাই তা থেকে আমরা কতটা পিছনে পড়ে আছি, তার একটা স্পষ্ট ধারণা পাওয়াটাও একান্ত জরুরি (যেমন জরুরি, ভাল কিছু করা সম্ভব সেই উপলব্ধি)।
এখানে বড় সমস্যা হল শিক্ষার গুণগত মান বিষয়ে স্পষ্টতার অভাব। এক দিকে যেমন এ নিয়ে সমাজের ভিন্ন ভিন্ন অংশের আলাদা আলাদা ধারণা আছে, তেমনই আবার শিক্ষা-প্রশাসন ও শিক্ষকদের মধ্যেও এ বিষয়ে অনুভবের বিরাট তারতম্য। যেমন, এটা বোধ হয় ধরেই নেওয়া হয়েছে যে, যার বাড়িতে লেখাপড়া-জানা কেউ নেই, সেই ‘প্রথম প্রজন্মের পড়ুয়া’দের কোনও ভাবেই শিক্ষা দেওয়া প্রায় অসম্ভব। ‘প্রথম প্রজন্মের পড়ুয়া’ বলতে গিয়ে এটা ভুলে যাওয়া হয় যে, যে কোনও শিক্ষার্থীই যখন প্রথম স্কুলে ভর্তি হয়, সে প্রথম শিক্ষার্থীই বটে স্কুলটা তার শিক্ষার সূচনার জায়গা। সৌভাগ্যবশত, এই প্রভেদগুলো সত্ত্বেও শিক্ষার মান বিষয়ে কিছু পরিমাণ মতৈক্য গড়ে উঠেছে সমাজের সবচেয়ে বঞ্চিত, সবচেয়ে অন্ধকারে পড়ে থাকা মানুষটির মধ্যেও একটা আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছে যে, তার বাচ্চা যখন ইস্কুলে যাচ্ছে তখন সে অন্ততপক্ষে লিখতে পড়তে এবং সাধারণ অঙ্ক কষতে শিখবে। শিক্ষার অর্জন সংক্রান্ত এই ধারণাগত মতৈক্যটা একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার।
কিন্তু এ ক্ষেত্রে যেটা বড় পার্থক্য থেকে যাচ্ছে, তা হল শিক্ষাগত মানের সঠিক নির্ণয়ন। শিশুর ন্যূনতম যতটা শেখা উচিত, সেটা মাপা হবে কী ভাবে? আগে এটার একটা ব্যবস্থা ছিল, বছরের শেষে বাচ্চার একটা পরীক্ষা নেওয়া হত, তাতে সে কত নম্বর পেল তার ভিত্তিতে বলা হত সে কতটুকু শিখতে পারল এবং যে পারল না তাকে ‘ফেল’ করিয়ে দিয়ে সুবিচার করা হল। এ ব্যবস্থার মস্ত ত্রুটি ছিল এই যে, ব্যর্থ শিশুদের ব্যর্থতার দায়টা তাদেরই ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া হত। একটা বাচ্চা তো স্কুলে আসে শিখবার জন্য, এবং শিশু বলেই নিজে নিজে শিখে নিতে অপারগ বলেই তার জন্য স্কুল, শিক্ষক ইত্যাদির ব্যবস্থা এটাই ব্যবস্থাটির মূলগত কারণ। এখন, এগুলো থাকার পরও যদি সে ন্যূনতম শিক্ষা না পায় তা হলে সে দায়িত্বটা তো শিশুর নয়। বিশ্বসংসারে শিক্ষাব্যবস্থা এ সত্যটি মোটামুটি ভাবে মানে, এবং এই চিন্তায় বহির্বিশ্বে যে ব্যবস্থাটা গড়ে উঠেছে তাতে পাশ-ফেল নিয়ে ভাবতেই হয় না। কিন্তু আমরা শুধু ধারণাগত ভাবে এমন একটা ব্যবস্থা মেনে নিলাম বটে, কিন্তু তার রূপায়ণে খানিকটা চিন্তার ঘাটতি ঘটল। সব শিশু যাতে শিখতে পারে, তার ব্যবস্থা তো হলই না, সে অভাবের দোষটা শিশুদের ছোট ঘাড়ে চাপানো হল। তা ছাড়া, তারা কী শিখছে সেটা মাপারও কোনও ঠিক প্রকরণের পথে গেলাম না।
অকৃতকার্যতার দায়টা একান্ত শিশুর নয়, এটা একটা বড় সামাজিক সত্য। এই ভ্রান্তি দূর করতে হলে শিশু কৃতকার্য হওয়ার মতো অবস্থায় পৌঁছতে পারছে কি না, এবং কোথায় সে আটকাচ্ছে, এটা দেখা খুবই জরুরি। পরিমাপের ব্যবহারটা প্রকৃতপক্ষে না থাকার ফলে বহু শিশুই ফি বছর এক ক্লাস থেকে অন্য ক্লাসে উঠে যায়, কিন্তু তার শিক্ষাগত মানের কোনও প্রগতি হয় না। নিরবচ্ছিন্ন সার্বিক মূল্যায়ন (কনটিনিউয়াস কমপ্রিহেনসিভ ইভ্যালুয়েশন, সংক্ষেপে সিসিই) বলে একটা জিনিস চালু হল, কিন্তু এখনও পর্যন্ত জানা গেল না, এটা কী, খায় না মাথায় দেয়? সিসিই-র নামে যেটা চলছে, শুধু পশ্চিমবঙ্গে নয়, দেশের প্রায় সর্বত্র, সেটা হল দিনগত পাপক্ষয় নিরবচ্ছিন্নতার যেটুকু যোগ এর সঙ্গে আছে, তা হল দিশাহীন অকর্মণ্যতা, সার্বিকের যোগটা শিক্ষার নিম্ন মানের সর্বব্যাপিতায়। এর রূপায়ণের জন্য যে সুস্থ, বৈজ্ঞানিক, গণতান্ত্রিক ও দায়বদ্ধ পদক্ষেপ করার দরকার ছিল, তার কোনওটাই করা হল না। এর ফলে এক অংশের লোকের মধ্যে সিসিই-র কার্যকারিতা নিয়েই প্রশ্ন উঠে আসছে, কেউ কেউ বলতেও শুরু করেছেন, ‘বীরভূমের মাটিতে কি কাশ্মীরি আপেল ফলে?’ অবশ্যম্ভাবী ফল হিসাবে, পুরনো পরীক্ষা পদ্ধতির শরণ নেওয়ার ঝোঁকটাও খুব সরব হয়ে উঠেছে।
এটা বাস্তবিকই একটা ঘোরতর সমস্যা। এক দিকে সামাজিক নৈতিক দায়িত্বের অসাফল্য এবং শিশুর ব্যর্থতার দায় যেমন তার অপ্রসর কাঁধে চাপানো চলে না, তেমনই তাকে কিছুই না শিখিয়ে কেবল পরের পর উঁচু ক্লাসে তুলে দেওয়াটাও সর্বনাশা অপরাধের মধ্যে পড়ে।
তা হলে কী করা?
প্রথমত, এটা যে বাস্তবিকই একটা সমস্যা, যার কুফল সুদূরপ্রসারী, সেটা সৎ ভাবে স্বীকার করা এবং এ নিয়ে প্রকাশ্য আলোচনার মধ্য দিয়ে সমাধানের পথ খুঁজে বার করা সে আলোচনায় শুধু তথাকথিত বিশেষজ্ঞরাই নন, সমাজমুখী জনসাধারণ যাতে যোগ দিতে পারেন, তেমন একটা উপায় নিয়েও চিন্তা করার প্রয়োজন আছে। এই বড় আলোচনাটি চট করে শেষ করা যাবে না, কিন্তু এই সঙ্গে, এখনই এখনই কার্যকরী করা সম্ভব, সাধারণ কাণ্ডজ্ঞাননির্ভর এমন কিছু পদক্ষেপের কথাও ভাবা প্রয়োজন। স্কুলের যে মূল্যায়ন ব্যবস্থা আছে সেটাকে সচল করা একটা কাজ, শিশুদের সাফল্য ও ব্যর্থতাগুলোকে চিহ্নিত করে শিক্ষকরা নিজেরা যাতে তাঁদের পরিকল্পনাগুলো করতে পারেন, সেটা দেখাও খুব দরকারি। কিন্তু, সেই সঙ্গে একটা নিরপেক্ষ এবং বাস্তবমুখী বহির্মূল্যায়নের ব্যবস্থাও করা দরকার, নিজেদের গুণগানে মুগ্ধ থাকার মধ্যে সমাধান নেই। বহির্মূল্যায়নটাকে একটা হাড়িকাঠ হিসেবে না দেখে, সেটাকে দেখা দরকার একটা সাহায্যকারী ব্যবস্থা হিসেবে। আমরা নিজেরা অনেক সময়ই নিজেদের কাজের ঠিক মূল্যায়ন করে উঠতে পারি না। আত্মবাৎসল্যের আচ্ছন্নতা ছাড়াও জ্ঞানের অভাবও একটা বাধা হয়ে দাঁড়ায়। সেখানে একটা বাইরের চোখ দিয়ে জিনিসটাকে দেখার মধ্যে একটা বৈজ্ঞানিক প্রয়োজনীয়তা আছে। সুতরাং বহির্মূল্যায়নটাকে শিক্ষক প্রশিক্ষণ, পরিদর্শন, মিড ডে-মিল এবং সর্বোপরি, পঠনপাঠনের মতোই একটা অত্যাবশ্যকীয় অঙ্গ হিসেবে দেখা উচিত, এবং মূল্যায়নের ফল প্রকাশ্যে আলোচিত হওয়া উচিত, যাতে ত্রুটিগুলি দূর করার ব্যাপারে বহু লোকের চিন্তার সাহায্য পাওয়া যায়।
এ প্রসঙ্গে আর একটা কথাও বোঝার দরকার আছে বলে মনে হয়। প্রাথমিক স্তরের ব্যবস্থাটাকেই অবিকল ভাবে উচ্চ স্তরে প্রয়োগ করা চলে না। প্রাথমিকে যে মূল্যায়ন চলবে, সেটাই উচ্চ মাধ্যমিকেও চলবে, এমনটা বিশ্বাস করা কঠিন। প্রাথমিক স্তরে শিশু নিজের দায়িত্ব নিজে নিতে পারে না, তার সব দায়িত্বই অন্যদের নিতে হয়, কিন্তু স্কুলের উঁচু ক্লাসের ছাত্রছাত্রীদের বেলায় তো এ কথা খাটে না। সেখানে তারা নিজেদের ব্যাপারে চিন্তা করতে শিখেছে। শিক্ষার একটা বড় উদ্দেশ্যই তো এই যে শিশু বড় হতে হতে নিজের এবং অন্যদের ব্যাপারে চিন্তা করার সামর্থ্য অর্জন করবে। সুতরাং, পঠনপাঠনেও যেমন, তেমনই মূল্যায়নের পদ্ধতিতেও শিক্ষার বিভিন্ন স্তরের মধ্যে পার্থক্য করতে হবে।
এই সঙ্গে কোন কোন মূল্যায়ন পদ্ধতি কী ভাবে কাজ করছে, সেটাও বিচার করার প্রয়োজন আছে। কেন্দ্রীয় বোর্ড পরিচালিত স্কুলগুলোতে সিসিই কিছুটা রূপায়িত করা গিয়েছে, এবং ব্যবস্থাটা নিশ্চয়ই খানিকটা ফলপ্রসূ। অন্য বোর্ডের স্কুলগুলোতে এটা কেন হয়ে উঠছে না, তা নিয়ে চিন্তাভাবনা করা দরকার। কিন্তু এগুলোর সঙ্গে বহির্মূল্যায়নের কোনও ঝগড়া থাকার কথা নয়। এটা নিজের দাবিতেই একটা জরুরি ব্যাপার। আরও যেটা জরুরি, তা হল, এই মূল্যায়নের ভিত্তিতে গোটা শিক্ষা দফতরের জবাবদিহি নিশ্চিত করা। কেবল শিক্ষক নন, শিক্ষা দফতরের নীচ থেকে ওপর পর্যন্ত সকলকেই এই মূল্যায়ন থেকে পাওয়া ফলের দায়িত্ব নিতে হবে। প্রায়ই দেখা যায়, সবচেয়ে নিচুতলার কর্মীটিকেই বলির পাঁঠা করে দেওয়া হয়। যে কোনও সুস্থ বৈজ্ঞানিক মূল্যায়ন ব্যবস্থাকেই এমন ‘সহজ সমাধান’ খোঁজা থেকে সম্পূর্ণ বিরত থাকতে হবে। প্রত্যেকেরই নিজস্ব দায়িত্ব পালনের অপরিহার্য কর্তব্যটা অবিরাম জনমানসে প্রতিফলিত করার কাজটাও এই মূল্যায়নের একটি বড় দিক, এটা না মানার কারণ খুব একটা নেই। বাচ্চারা যেটা পারতে পারে, সেটা না পারার পিছনে কার কতটা এবং কী মাত্রায় দায়িত্ব আছে, সেটা চিহ্নিত করেই আমরা ভবিষ্যৎ বিষয়ে ভাবতে পারি।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.