বাংলাদেশের ৯৭টি উপজিলা নির্বাচনে বি এন পি’র সমর্থিত প্রার্থীদের বড় আকারের সাফল্য দেশের প্রধান বিরোধী দলের নেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে একটি প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করাইয়া দিয়াছে: তবে দেড় মাস আগের নির্বাচন তাঁহারা বয়কট করিলেন কেন? প্রশ্নটি পুরানো। গত বছরে দেশের বিভিন্ন শহরের পুরসভা নির্বাচনেও তাঁহার দল চমকপ্রদ সাফল্য অর্জন করিয়াছিল। স্থানীয় স্তরের দুইটি নির্বাচনপর্ব শেখ হাসিনা সরকারের আওতাতেই সম্পন্ন হইয়াছে। ইহাতে দুইটি সত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। এক, বিভিন্ন অঞ্চলের নাগরিকদের মধ্যে বি এন পি রীতিমত জনপ্রিয়। দুই, দেশের কেন্দ্রীয় সরকার আওয়ামি লিগের দখলে থাকিলেও সেই জনপ্রিয়তার ফসল কুড়াইতে বিরোধী দলের কোনও অসুবিধা হয় নাই। অর্থাৎ, এই জমানায় বিরোধীরা নির্বাচনে কার্যত গোটা দেশ জুড়িয়াই সফল হইতে পারে। সুতরাং, ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার ভিন্ন নির্বাচন লড়িব না, কারণ শেখ হাসিনার সরকার নিরপেক্ষ ভোট করিতে দিবে না’, বি এন পি’র এই অবস্থানটি রীতিমত নড়বড়ে। বেগম খালেদার সাফল্যই তাঁহার অভিযোগের ধার এবং ভার বহুলাংশে কমাইয়া দিয়াছে। এই ধারণা দ্বিগুণ জোরদার করিয়াছে যে, আওয়ামি লিগের নিরপেক্ষতার অভাব নয়, জামাতে ইসলামির চাপই তাঁহার ভোট বয়কটের প্রকৃত কারণ।
বিক্ষিপ্ত কিছু ঘটনা ছাড়িয়া দিলে উপজিলা নির্বাচনে যে শান্তিপূর্ণ ও স্বাভাবিক পরিস্থিতি দেখা গিয়াছে, তাহা প্রমাণ করে, দেশের নাগরিকরা অশান্তি চাহেন না, অশান্তির স্বনিযুক্ত এবং স্বার্থপ্রণোদিত কারিগররাই আগুন জ্বালাইয়া থাকেন। যেমন ভারতে, তেমনই বাংলাদেশে। বেগম খালেদা জিয়াকে সাহস করিতে হইবে। গণতান্ত্রিক সাহস। তাঁহাকে হিংসার রাজনীতির কারবারিদের সঙ্গ ত্যাগ করিতে হইবে, যুদ্ধাপরাধ বিচারের গুরুতর প্রশ্নটির মোকাবিলায় সেই কারবারিদের কায়েমি স্বার্থের বশীভূত থাকিলে চলিবে না। বেগম খালেদা জিয়াকে স্মরণ করিতে হইবে যে, জামাত নহে, তাঁহারাই দেশের প্রধান বিরোধী দল। শাসক দলের রাজনৈতিক বিরোধিতা অবশ্যই জরুরি, তাহার যথেষ্ট কারণও আছে আওয়ামি লিগের বিভিন্ন নেতার বিরুদ্ধে দুর্নীতি, দলতন্ত্র ও অন্যবিধ অভিযোগ বিপুল। এমনকী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিকেও অযৌক্তিক বলিয়া উড়াইয়া দেওয়া চলিবে না, বাংলাদেশে গণতন্ত্রের পুনর্বাসনের ইতিহাসে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ভূমিকা তাৎপর্যপূর্ণ। কিন্তু এই সমস্ত প্রশ্নে যথার্থ গণতান্ত্রিক বিরোধিতার স্বার্থেই বি এন পি’র কর্তব্য নেতির রাজনীতি ছাড়িয়া গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের মূলস্রোতে ফিরিয়া আসা। তাহাতে তাঁহাদের রাজনৈতিক শক্তি এবং মর্যাদা বাড়িবে।
শেখ হাসিনা এবং তাঁহার দলের দায়িত্বও কম নহে। তাঁহাদের নির্বাচনী সাফল্য আইনের দৃষ্টিতে অবৈধ না হইতে পারে, কিন্তু তাঁহাদের সরকারের নৈতিক ভিতটি নিতান্ত দুর্বল। সংসদীয় রাজনীতিতে বিরোধী দলকে ফিরাইতে চাহিলে নূতন নির্বাচন ভিন্ন উপায় নাই। কিন্তু সে জন্য দুই দলকে পারস্পরিক অসেতুসম্ভব দূরত্ব ঘুচাইতে হইবে। আপনাপন অবস্থানে দাঁড়াইয়াই সমস্ত মতানৈক্য ও অভিযোগের মোকাবিলা করা সম্ভব। তাহাই যথার্থ গণতন্ত্রের ধর্ম। শেখ হাসিনাকে হয়তো দুই পা আগাইয়া যাইতে হইবে, কারণ তিনি প্রধানমন্ত্রী, তাঁহার দল শাসনক্ষমতায় আসীন। উপজিলা নির্বাচন দেখাইয়া দিল বাংলাদেশে গণতন্ত্রের জমি উর্বর। দুই পক্ষ মিলিয়া চাষ করিলে এখনও সোনা ফলিতে পারে। |