মেধায় জোয়ার। কিন্তু ভাটা মানসিকতায়। আড়ষ্টতা নতুন পণ্য চেখে দেখা বা নাম না-জানা সংস্থায় চাকরি করার ক্ষেত্রে। আর এই অতি রক্ষণশীল মানসিকতার কারণেই পশ্চিমবঙ্গ থেকে ভিন্ রাজ্যে পাড়ি দিচ্ছে তথ্যপ্রযুক্তির বিভিন্ন নতুন ব্যবসা (স্টার্ট আপ)। বাকি ভারতের তুলনায় ক্রমশ আরও বেশি করে পিছিয়ে পড়ছে কলকাতা-সহ পূর্বাঞ্চল।
কোনও ব্যবসা শুরুর সময়ে তার ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা বিচার করে একেবারে গোড়াতেই সেখানে টাকা ঢালে বিভিন্ন ভেঞ্চার ক্যাপিটাল (উদ্যোগ-পুঁজি) সংস্থা। ভারতে মাইক্রোসফটের উদ্যোগ-পুঁজি সংস্থা মাইক্রোসফট ভেঞ্চার্সের কর্তা মকুন্দ মোহনের মতে, “শুধু পণ্য বা পরিষেবা উদ্ভাবনই যথেষ্ট নয়। তা বিক্রির জন্য চাই বড় বাজার। প্রয়োজন এমন ক্রেতার, যিনি নতুন প্রযুক্তিকে স্বাগত জানাতে এবং তার ব্যবহার করতে তৈরি। আর এর অভাবেই কলকাতা-সহ পূর্বাঞ্চলে স্টার্ট আপের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল নয়।”
কমিউনেট ও ট্রিভিয়া ভেঞ্চার্সের শীর্ষ কর্তা বোধিসত্ত্ব বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে, বেঙ্গালুরুতে বড় (এমনকী বহুজাতিক) তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থা ছেড়ে স্টার্ট আপে চাকরি করতে আসবেন অনেকেই। সম্ভাবনা ভাল বুঝলে, চেষ্টা করবেন শুরু থেকেই তার সঙ্গে জড়িয়ে থাকার। কিন্তু কলকাতায় সেই ঝুঁকি নিতে রাজি হওয়া তথ্যপ্রযুক্তি কর্মীর সংখ্যা অনেক কম। পর্যাপ্ত সংখ্যায় পাওয়া তো প্রায় অসম্ভব। তাঁর মতে, একে তো ঝুঁকি নেওয়ার মানসিকতা এমনিতেই এখানে কম। তার উপর এ ক্ষেত্রে মুম্বই-চেন্নাই-বেঙ্গালুরুকে বহু যোজন এগিয়ে রাখে সেখানে কাজের বিপুল সুযোগ। “মানুষ জানে, স্টার্ট আপ ডুবলেও ফের কাজ পেতে তেমন অসুবিধা হবে না,” বলছেন তিনি।
তা ছাড়া, পণ্য-পরিষেবা পছন্দের বিষয়ে মানসিকতার ফারাকের কথা বলছেন বোধিসত্ত্ববাবুও। তাঁর মতে, একেবারে নতুন সংস্থার আনকোরা জিনিস বা পরিষেবা নিতে পিছপা হবে না বেঙ্গালুরুর অনেক সংস্থাই। যে প্রবণতা কলকাতায় অনেকটাই কম। অনলাইন বাজারেও ক্রেতার সংখ্যা বেঙ্গালুরুতে অনেকটাই বেশি।
ক্ষুরধার মেধা, সম্ভাবনাময় ব্যবসায়িক পরিকল্পনা, দক্ষ কর্মীর জোগান এবং তৈরি পণ্য ও পরিষেবা বিক্রির উপযুক্ত বড় বাজার। মূলত এই চারটি বিষয় খতিয়ে দেখেই কোনও স্টার্ট আপে (বিশেষত তথ্যপ্রযুক্তি) টাকা ঢালে ভেঞ্চার ক্যাপিটাল সংস্থাগুলি। মোহন এবং বোধিসত্ত্ববাবুর মতে, এর মধ্যে প্রথম দু’টি কলকাতায় যথেষ্ট। কিন্তু বাকি দু’টির অভাবেই পিছিয়ে পড়ছে এই শহর। যা স্পষ্ট পরিসংখ্যান থেকে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে খবর, দেশের প্রযুক্তি সংক্রান্ত স্টার্ট আপগুলির ২৮ শতাংশেরই শিকড় বেঙ্গালুরুতে। দিল্লিতে ২০%, মুম্বই-পুণে ১৫%। সেখানে কলকাতা-সহ সারা পূর্বাঞ্চলে তা মাত্র ১০%।
কেন এই পিছিয়ে পড়া, তার হাতেগরম নমুনাও দিলেন মোহন। তুলে আনলেন স্রেফ বাজারের টানে কলকাতার সংস্থা টুকিটাকি ডট কম-এর বেঙ্গালুরু পাড়ি দেওয়ার উদাহরণ। তাঁর দাবি, অনলাইন বিজ্ঞাপনের বৃত্তে রীতিমতো সাড়া ফেলেছে টুকিটাকির প্রযুক্তি। যা কাজে লাগাতে চাইছে ফেসবুকের মতো সংস্থাও। মাইক্রোসফট ভেঞ্চার্স কর্তা জানালেন, ব্যবসায়িক সম্ভাবনা এবং তাকে ফলপ্রসূ করতে উপযুক্ত বাজারের জন্যই টুকিটাকি-কে বেঙ্গালুরুতে ব্যবসা সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার কথা বলেছিলেন তাঁরা। উদ্যোগ-পুঁজি সংস্থার দেখানো সেই পথে হেঁটে আখেরে টুকিটাকি-র লাভই হয়েছে বলে তাঁর দাবি।
উল্লেখ্য, ছোট-মাঝারি তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থার সংখ্যা এ রাজ্যে বেশ কম। অথচ কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা নেয় এগুলিই। নতুন কাজের সুযোগের ৮০ শতাংশই তৈরি হয় এখানে। কিন্তু আরও অনেক বেশি ‘স্টার্ট আপ’ সফল হলে তবেই ছোট সংস্থার সংখ্যা বাড়বে পশ্চিমবঙ্গে। এটা মাথায় রেখেই নিজস্ব উদ্যোগ-পুঁজির তহবিল গড়েছে রাজ্য। পাঁচ কোটি থেকে ফুলেফেঁপে এখন যার পরিমাণ হয়েছে ২৫ কোটি টাকা।
তবে রাজ্য বিলক্ষণ জানে যে, প্রয়োজনের তুলনায় এই পুঁজি নগণ্য। তাই শিল্পোদ্যোগী তুলে আনতে জেলায় জেলায় ইনকিউবেশন সেন্টার গড়ার জন্য কর্পোরেট দুনিয়ার হাত ধরতে চাইছে তারা। |