শনিবারের নিবন্ধ ৩...
জীবিত ও মৃত
কাঠের সিঁড়ি বেয়ে ওঠার সময় মনে হল সময়টা কয়েক দশক পিছিয়ে গেছে। এই বাড়িতেই ১২৫ বছরের প্রাচীন পাঠাগার, চৈতন্য লাইব্রেরি। ঠিকানা বিডন স্ট্রিট।
দোতলায় উঠতেই চোখে এল প্রশস্ত একটি ঘর। কড়িকাঠ থেকে ঝোলানো তারে কতগুলো টিমটিমে বাল্ব জ্বলছে। ঘরের কাঠের র্যাকে থরে থরে সাজানো বই। এক একটা বইয়ে টোকা মারতেই ধুলোয় ধুলো।
ও-ঘর ছেড়ে বেরিয়ে দালানে গিয়ে আরেকটির শিকল খুলে দিলেন লাইব্রেরির তত্ত্বাবধায়ক বলভদ্র খামরি। দশ ফুট বাই দশ ফুট। এখানেও র্যাক ভর্তি বই। সেগুলোর এতই ঝুরঝুরে দশা যে বাঁধা আছে দড়ি দিয়ে।
সন্ধ্যা সাতটা। লাইব্রেরির সদর ঝাঁপ খুলে গেলেও পাঠকের দেখা নেই। ঢোকার মুখে যে ফলক চোখে পড়েছে তাতে লেখা, লাইব্রেরির প্রতিষ্ঠাতা ও সদস্যদের পরিচয়। প্রতিষ্ঠাতা ও সহসম্পাদক হিসাবে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নামও খোদাই করা। শুধু রবীন্দ্রনাথ নয়, ওই ফলকে জ্বলজ্বল করছে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় থেকে দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর, সিস্টার নিবেদিতা, গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের নামও।
রিডিং রুমের শূন্য চেয়ার টেবিলগুলোর দিকে তাকিয়ে বলভদ্রবাবু বলেন, “মাঝেমধ্যে গবেষকরা আসেন বইয়ের সন্ধান করতে। গল্প উপন্যাসগুলো পড়ার লোক নেই। পাড়ার যে সব মহিলা বই বদল করতে আসতেন, তাঁরা এখন সন্ধ্যাবেলা টিভি সিরিয়াল দেখতে ব্যস্ত। কে আসবে বলুন?”
তালতলা পাবলিক লাইব্রেরি। শোনা যায় এটিই নাকি শহরের সব চেয়ে প্রাচীন গ্রন্থাগার। সেখানে গিয়ে দেখা মিলল কয়েকজন বৃদ্ধর। ঘড়ির কাঁটা তখন সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায়। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে খবরের কাগজ পড়ছেন তাঁরা। এখানেও বই আর ধুলোর পাহাড় মিলেমিশে একাকার।
পাঠাগারের দায়িত্বে শঙ্কর নাথ। জানালেন, দশ পনেরো বছর আগেও এখানে মেয়েদের ভিড় এতটাই ছিল যে তাঁদের জন্য আলাদা একটা ‘উইং’ রাখতে হয়েছিল। দোতলায় সেই ‘উইং’ এখন শূন্য।
শঙ্করবাবু বললেন, “সরকার থেকে যে কয়েক হাজার টাকা পাই তা দিয়ে তো শুধু কিছু বই-ই কেনা হয়। লাইব্রেরির পরিকাঠামো উন্নতি কী ভাবে হবে?” শোনা গেল, আগে যেমন পাড়ার ছেলেরাই এগিয়ে আসত পাঠাগারের হাল ধরতে, এখন সে সব পাট নেই। ফলে হাহাকার লোকবলেরও।
উল্টো ছবি দেখা গেল কাঁকুড়গাছির রাজ্য কেন্দ্র গ্রন্থাগারে। রিডিং রুমের প্রায় প্রতিটা টেবিলেই এই প্রজন্মের যুবক যুবতী। তাঁদের চোখ পাঠ্যপুস্তকে।
লাইব্রেরিয়ান অভিজিৎ কুমার ভৌমিক বললেন,“আমাদের এখানে ‘এডুকেশন সেল’-এ সব সময় ভর্তি পাঠক। এখান থেকে অনেকে পড়াশোনা করে চাকরির পরীক্ষায় পাশ করেছেন।” জানা গেল, লাইব্রেরিতে না এসেও ইন্টারনেটের সাহায্যেও এখানে বই পড়া যায়। তেমন বইয়ের সংখ্যা নেহাত কম নয়। ১৪ হাজার। তবে গল্পের বইয়ের পাঠক সংখ্যা কমেছে হু হু করে।
পাঠক কমেছে বলে গল্পের বই নিয়ে আর মাথাই ঘামাতে চান না কলকাতার আরেক পুরনো লাইব্রেরি সুকিয়া স্ট্রিটের কাছে রামমোহন লাইব্রেরির লাইব্রেরিয়ান শঙ্কর ভট্টাচার্য। রবীন্দ্রনাথ নোবেল পুরস্কার পাবার পর নাকি এই পাঠাগারেই সর্ংবধনা দেওয়া হয়। তিনতলার লাইব্রেরির ঘরে বসে শঙ্করবাবু বলছিলেন, “প্রচুর সমস্যা। তার মধ্যেও চালাতে হচ্ছে। পাঠক কমেছে। পাঠাগার বাঁচিয়ে রাখতে অন্য উপায় নিয়েছি।”
আশপাশে বস্তি এলাকা। সেখানে রয়েছে প্রচুর মেধাবী ছাত্রছাত্রী। ওই লাইব্রেরিতে এই মেধাবীদের জন্য দরজা সব সময় খোলা। “ওদের জন্য যত পারি কম্পিটিটিভ পরীক্ষার বই কিনি। গত বছর এই লাইব্রেরি থেকে ৪ জন গরিব ছাত্র রেলের পরীক্ষায় পাশ করে এখন চাকরি করছে,” বললেন শঙ্করবাবু।
বাগবাজারের আরেক প্রাচীন গ্রন্থাগার বাগবাজার রিডিং লাইব্রেরি। রিডিং রুমে কেউ নেই। কর্মীরা জানালেন, প্রচুর বই চুরি হয়ে গিয়েছে। তাই লেন্ডিং সেকশনে এখন কড়াকড়ি। খবরের কাগজের পাঠক সংখ্যাই এখন বেশি। গল্পের বইয়ের পাঠক আর কই!
ফোনে পাওয়া গেল গ্রন্থাগার মন্ত্রী আব্দুল করিম চৌধুরিকে। তিনি বলেন, “সারা রাজ্যের লাইব্রেরিতে ১৮০০টি পদ খালি রয়েছে। এর মধ্যে অনেক লাইব্রেরিতে লাইব্রেরিয়ানই নেই। চেষ্টা করছি পদগুলো পূরণ করার। তবে সরকারি স্পনসর লাইব্রেরিগুলোর অবস্থা অবশ্য ভাল হচ্ছে। খারাপ অবস্থা চৈতন্য বা তালতলার মতো পাঠাগারের। এগুলোর পরিকাঠামোর উন্নতির চেষ্টা চলছে।” এই জীর্ণ ছবিটা কিন্তু একেবার উল্টে যায় ব্রিটিশ কাউন্সিল বা আমেরিকান লাইব্রেরিতে। আমেরিকান লাইব্রেরির কর্মকর্তারা জানালেন, সাত বছর আগে যেখানে ছিল ২০০০ সদস্য, এখন সেখানে ১৯০০০। ঝকঝকে রিডিং রুম। রয়েছে ইন্টারনেট, ওয়াই ফাই, ই-লাইব্রেরির সুবিধা। চলে ছোটো ছোট পাঠকদের বই পড়ার অভ্যাস তৈরি করার জন্য নিয়মিত অনুষ্ঠান। সামান্য কিছু টাকার বিনিময়ে শুধু বই নয়, বাড়ি নিয়ে যাওয়া যায় পছন্দের ডিভিডি-ও। “মনের মতো পরিবেশ। কোনও দিন বই পড়ে, কোনও দিন শুধু সিনেমা দেখেই কাটিয়ে দিই। কিছু দিন না এলেই মিস করি,” বললেন লাইব্রেরি চত্বর থেকে বেরোনো এক কলেজ-পড়ুয়া পাঠক।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.