শনিবারের নিবন্ধ ২...
সব বই শব হয়ে গেছে
চা-বাগানে আমাদের বাড়ির লাগোয়া বাঙালি ক্লাবের একটি ঘরের চারটে আলমারিতে শ’তিনেক বই ছিল। বাইশটি বাঙালি পরিবারের কেউ কেউ ওই ঘরে ঢুকতেন না। যাঁরা ঢুকতেন তাঁদের বই নির্বাচনে সাহায্য করতেন রবিদা, যিনি ওই চা-বাগানের কর্মী, লাইব্রেরিয়ান হওয়া তাঁর শখ।
ছোটখাটো মানুষটা প্রতি সন্ধ্যায় বইগুলোকে যেভাবে যত্ন করতেন তাতে মনে হত নিজের ছেলেমেয়েকে লালন করছেন।
আমি তখন তেরো বছর বয়সে। ছুটিতে চা-বাগানে গিয়েছি। লাইব্রেরি খুলতেই ভেতরে ঢুকতেই রবিদা হেসে বললেন, “মা তারাশংকরের ‘কবি’ নিতে পাঠিয়েছেন তো। এই নাও। ওই খাতায় সই করে যাও।”
বইটি নিয়ে আমি আলমারির সামনে দাঁড়িয়ে দেখতে দেখতে বেশ উত্তেজিত হয়ে একটি বইয়ের দিকে হাত বাড়াতেই রবিদা তেড়ে এলেন, ‘না, না, ওই বই নেবে না।’
আমার স্কুলের মাস্টারমশাই বেণু দত্ত রায়ের মুখে এই লেখকের নাম শুনেছি। বইটির বাংলায় অনুবাদ দেখে পড়তে ইচ্ছে হয়েছিল।
রবিদা বললেন, “এই বই পড়ার বয়স তোমার এখন হয়নি। এটা বড়দের বই।” লেখকের নাম এমিলি জোলা। মন খারাপ হয়ে গিয়েছিল। তখন ভেবেছি কবে বড় হব? খুব রাগ হয়েছিল রবিদার উপর। কী করে জানি না, ‘নানা’ বইটি আজও পড়া হল না।
কয়েক দিন আগে একজন মহিলা ফোন করে বললেন, “আপনি আজও বাবাকে মনে রেখেছেন? আমি সুনীল পালের মেয়ে।” কী করে বোঝাই কোনও কোনও মানুষ আমাদের জীবনে নিজের অজান্তেই এমন ভূমিকা নিয়ে থাকেন, তাঁকে ভোলা যায় না।
জলপাইগুড়ির স্কুলে পড়ার সময় বাবুপাড়া পাঠাগারের সুনীলদা আমাকে বাংলা সাহিত্য চিনিয়েছিলেন। তখন লাইব্রেরি পরিচালনা করতেন কয়েক জন, কিন্তু তাঁদের একজনের প্রাণ ছিল বইগুলো।
আমি মোহনসিরিজ, স্বপনকুমার পড়ার নেশা নিয়ে বাবুপাড়া পাঠাগারে গিয়েছিলাম। তাই জেনে সুনীলদা প্রথমে পড়তে দিলেন ‘কালো ভ্রমর’। সঙ্গে সঙ্গে আগেরগুলো পানসে হয়ে গেল। তার পর শরদিন্দুর ব্যোমকেশ। কী আশ্চর্য, কালো ভ্রমরের আকর্ষণ ফিকে হয়ে গেল। তার পর শ্রীকান্ত। এ এক অন্য রকমের অ্যাডভেঞ্চার। জীবন খোঁজার কাহিনি। তার পর একের পর এক শরৎচন্দ্র। সেখানে হাবুডুবু খেয়ে বঙ্কিমচন্দ্রের রোম্যান্সে। স্কুল শেষ করার মুখে তারাশঙ্কর-বিভূতিভূষণ-মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়।
কলকাতায় পড়তে আসার আগের দিন দেখা করতে গিয়েছিলাম। সুনীলদা হেসে বলেছিলেন, ‘এখন তুমি রবীন্দ্রনাথ পড়ার উপযুক্ত হয়েছ।’
আমাদের হাতেখড়ি যিনি দেন তিনি পণ্ডিত হবেন এমন কথা নেই। আমার হাতেখড়ি দিয়েছিলেন বিধবা বড়পিসিমা যার বিদ্যে ছিল ক্লাস ফোর পর্যন্ত। অ-আ লিখিয়ে বলেছিলেন, ‘আমি তোর হাতেখড়ি দিলাম তো, তুই যদি মূর্খ হোস তাহলে লোকে আমাকেই গালাগাল দেবে।’
এখনও প্রতি দিন লিখতে বসার আগে চলে যাওয়া বড়পিসিমার কথা ভেবে কলম ধরি। তেমনি আমাদের সাহিত্য পড়ার জন্যে একজন মানুষের দরকার হয়, যিনি গাইডের কাজ করবেন। সে সময় পাঠাগারগুলোয় এ রকম এক একজন মানুষ ছিলেন।
একটা পাঠাগার মানে কয়েক মাইলের মধ্যে অনেক পাঠক-পাঠিকার মনের তীর্থ। মহিলারা কাজের লোক বা ছোটদের পাঠাতেন বই ফেরত দিয়ে নতুন বই নিতে। চিরকুটে পছন্দের বই না থাকলে সুনীলদাকে লিখে দিতেন, ‘আপনি পছন্দ করে বই দেবেন।’
আমি পনেরো বছর বয়সে ‘চাঁদের পাহাড়’ নিচ্ছি দেখে কলকাতা থেকে বদলি হয়ে যাওয়া একজন সরকারি অফিসারের মেয়ে ঠোঁট বেঁকিয়েছিল, ‘মাই গড, আমি তো এটা এগারো বছরে পড়েছি।’ দেখলাম মেয়েটি ‘শেষের কবিতা’ নিচ্ছে। সুনীলদাকে বলতেই তিনি হেসেছিলেন, ‘ধাপে ধাপে ওঠ, একবারে লাফ দিয়ে ওঠার কী দরকার!’
কলকাতার পাড়ায় পাড়ায় তখন লাইব্রেরি। উত্তর কলকাতার বাগবাজার রিডিং লাইব্রেরি, রামমোহন লাইব্রেরিতে বিকেল হলেই বই দেওয়ানেওয়ার জন্য ভিড় উপচে পড়ছে। অনেকে ঠাট্টা করত, মহিলারা দুপুরের ঘুম আনতে লাইব্রেরি থেকে বই নিয়ে যান। তখন বয়েজ ওন লাইব্রেরি, চৈতন্য লাইব্রেরি, সমাজপতি পাঠাগারের খুব রমরমা। আর ছিল বাংলা বইয়ের বিশাল খনি বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ।
অথচ কী আশ্চর্য, আমি এ সব পাঠাগারে না গিয়ে শুধু কলেজ লাইব্রেরি থেকে যেমন রবীন্দ্রনাথ পড়ে গিয়েছি তেমনি সমরেশ বসু, বিমল কর, রমাপদ চৌধুরীতে মজেছি।
হঠাৎ একটি বই পেয়ে চমকে গিয়েছি। লেখকের নাম বরেন বসু, বইয়ের নাম ‘রংরুট’। লাইব্রেরির কল্যাণে পড়েছি দীপক চৌধুরীর ‘পাতালে এক ঋতু’, অদ্বৈত মল্লবর্মণের ‘তিতাস একটি নদীর নাম’, হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়ের ‘ইরাবতী’।
তার পর কখন কেমন করে লাইব্রেরিতে যাওয়া বন্ধ হয়ে গেল। কোনও বিশেষ বইয়ের দরকার হলে কলেজ স্ট্রিট যাই। বই পেয়ে যাই। যে বই দোকানে পাওয়া যেত না সেই বইয়ের জন্য দ্বারস্থ হতাম ‘সুবর্ণরেখা’র ইন্দ্রনাথদার কাছে। সমুদ্রের নীচ থেকে তিনি ঠিকঠাক মুক্তো এনে দিতেন।
লাইব্রেরির আসল চেহারাটা দেখতে পেলাম ওয়াশিংটনে গিয়ে। লাইব্রেরি অফ কংগ্রেস। পৃথিবীর কোথায় কোন উল্লেখযোগ্য বই লেখা হয়েছে তা বোতাম টিপলে এক নিমেষে পাওয়া যায় সেখানে।
কৌতূহলে আমি ইন্ডিয়ার সাহিত্যে গেলাম। তার পর বাংলাভাষায়। সতীনাথ ভাদুড়ির নাম করতেই পরপর তাঁর বইগুলোর তালিকা বেরিয়ে এল।
শুনলাম এই সব বই এঁরা কিনে এনে বইয়ের সংক্ষিপ্তসার যন্ত্রস্থ করে রাখেন। তার পর বিপুল বই রাখার জায়গা না থাকায় জাহাজে করে সমুদ্রে ফেলে দেন। সত্যি বা মিথ্যে জানা নেই। শুধু জানি কয়েকশো বছর পরেও উল্লেখযোগ্য সব লেখকের বইয়ের বিষয় ওখানে গেলেই পড়া যাবে।
সেই সময় কি বাংলা বই খুব বেশি বিক্রি হত? খবর নিয়ে জেনেছি, হত না। একটি কী দু’টি বই কিনে পাঠাগারে রাখলেই দু’শো পাঠক পড়ার সুযোগ পেতেন। বই কিনে কয়েক হাত ঘুরে এলেই বাঁধিয়ে ফেলা হত শক্ত করে। সেই বই একেবারে ছিঁড়ে গেলে আর কেনার প্রশ্ন নেই। কোন বই খুব বেশি ইস্যু হয়েছে, কোন বই খুব কম, তার উপর লেখকের জনপ্রিয়তা নির্ধারণ করা হত।
তখন বইমেলা ছিল না। ব্যক্তিগত সঞ্চয়ে কিছু রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র এবং নজরুলের ‘সঞ্চিতা’ রাখার চল ছিল। মানুষ বিয়েতে বই উপহার দিতেন বটে কিন্তু তা খুব বেশি নয়। ব্যক্তিগত ভাবে বই কেনার অভ্যেস চালু হল বইমেলার পরে। এখন তো জেলায় জেলায়, মহকুমায়, এমনকী গ্রামেও বইমেলা হয়ে চলেছে। বাংলা বইয়ের বিক্রি অবশ্যই বেড়ে গেছে।
পাঠাগারের আলো ক্রমশ যে নিভে যাচ্ছে তার এটাও একটা কারণ। কিছু দিন আগে খুব নামী একটি পাঠাগারে বিভূতিভূষণের জন্মদিন উপলক্ষে যেতে হয়েছিল। টিমটিমে আলোয় জনা দশেক মান শুধু ধুনোর গন্ধটাই যা নেই।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.