শনিবারের নিবন্ধ ১...
বারবার ফিরে যাই
বাঙালির লেখা ইংরেজি গল্প উপন্যাসে বাংলা (এপার ও ওপার), বাঙালি জীবন কী ভাবে ঘুরেফিরে আসছে, থেকেও যাচ্ছে, ছেড়ে যাচ্ছে না, তা নিয়ে ভাবতে বসে সলিল চৌধুরীর একটা অপূর্ব গান মনে এল।
মনের কোণে গেঁথে থাকা গানটা একটা নতুন ছবি পেল ঝুম্পা লাহিড়ি, অমিতাভ ঘোষ, কুণাল বসুদের কাজের প্রসঙ্গে।
কী যে করি, দূরে যেতে হয় তাই
সুরে সুরে কাছে যেতে চাই
কী যে করি...

নিউ ইয়র্কে বসে লিখছেন ঝুম্পা বা অমিতাভ, অক্সফোর্ডে পড়ানোর কাজ থেকে ছুটি নিয়ে কলকাতায় বসে নতুন উপন্যাস করছেন কুণাল, ওঁদের বিষয় বাঁধা বাংলা ও বাঙালিতে।
ছাব্বিশ বছর আগে নানা ভূগোলে ছড়িয়ে পড়া বাঙালি জীবন নিয়ে ‘দ্য স্যাডো লাইনস’ উপন্যাস লিখতে গিয়ে অমিতাভ ওঁর রচনাকে দু’টি মস্ত ভাগে ভাগ করেছিলেন। এক, গোইং অ্যাওয়ে, চলে যাওয়া। আর দুই, কামিং হোম, বাড়ি ফেরা।
এই চলে যাওয়া, ফিরে আসা কিংবা ফিরতে না পারার উপাখ্যান নিয়ে বড় বেদনামধুর সাহিত্যসম্ভার তৈরি হয়ে গেল দেখতে দেখতে। বিভুঁইয়ে বসে লেখা এমনই এক উপন্যাসের নাম দিয়ে এই রচনাধারার সুন্দর ইঙ্গিত রাখা যায় অমিত চৌধুরীর ‘আ স্ট্রেঞ্জ অ্যান্ড সাবলাইম অ্যাড্রেস’। এক অচেনা, অপরূপ ঠিকানা।
শিকড়ে ফেরার এই টান নিয়ে এক অদ্ভুত মুহূর্ত আঁকা আছে ঝুম্পার প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘ইন্টারপ্রেটার অব ম্যালাডিজ’-এর প্রথম গল্প ‘আ টেম্পোরারি ম্যাটার’-এ (একটা অস্থায়ী ব্যাপার)।
ঝুম্পা লাহিড়ী
অস্থায়ী ব্যাপারটা দু’রকম। স্বামী সুকুমারের থেকে আলাদা থাকার জন্য শোভা একটা নতুন আস্তানা খুঁজে পেয়েছে। আর যে বাড়িতে ওরা আছে মার্কিন দেশের সেই শহরে বরফঝড়ে বিদ্যুতের হাল খারাপ। সাময়িক বন্দোবস্ত হল প্রতি সন্ধ্যায় এক ঘণ্টা করে বিদ্যুৎ ছাঁটাই।
ওই ঘুরঘুট্টি অন্ধকারে প্রতি সন্ধ্যায় সুকুমার ও শোভা পালা করে একে অপরকে নিজের নিজের গোপন করে রাখা গল্প শোনায়। ওই অন্ধকারে কেনই যেন সুকুমারের আক্ষেপ হয় মার্কিন দেশে জন্মে, বড় হয়ে, ওর কোনও শৈশবকথা নেই যেখানে ভারত উপস্থিত। যখন টিনএজার তখন গরমের ছুটিতে বাবা-মা’র সঙ্গে কলকাতা যেতে মন চাইত না। ক্যাম্পে গিয়ে নৌকো চড়ে আর আইসক্রিম খেয়েই দিনগুলো কাটল। অন্ধকারে ওই সন্ধেগুলোয় ঝুম্পা লিখছেন...
“কলেজের শেষ বছরে, বাবা মারা যেতেই, দেশের প্রতি টানটা চাড়া দিল। একদিন তো পাঠ্যপুস্তকে দেশ নিয়ে যা পাওয়া যেত তা-ই পড়া হত, যেমন পড়া হত আর যে-কোনও বিষয়ই। ওর মনে হওয়া শুরু হল ভারত নিয়ে ওর কিছু বাল্যস্মৃতি ও গল্প থাকলে কী ভালই না হত!”
দেশের এ রকম স্মৃতি না থাকা এক প্রাপ্তবয়স্ক যন্ত্রণা, আর ওই বয়সে এমনতর অভিজ্ঞতাও তো হতে পারে যা আরেক প্রকার যন্ত্রণা। যেমন স্মৃতি ‘দ্য স্যাডো লাইনস’-এর কথক-নায়কের যখন সে নিতান্তই বালক। সে বুঝতেই পারে না বিদেশে থাকা ঠাকুরমা ঢাকায় যাবার কথায় ‘বাড়ি আসছি’, ‘ঢাকায় আসছি’ বলে কেন। ঠাম্মা তো পড়াশুনো জানে, ইস্কুল টিচার ছিল, তাহলে ‘যাচ্ছি’ আর ‘আসছি’র মধ্যে গুলিয়ে ফেলে কেন ঢাকায় যাবার নামে!
বড় হয়ে ছেলেটির মনে পড়েছে আরও একটা সন্ধের কথা। সবাই ওরা বসেছিল বাগানে, যখন ঠাকুরমা জানতে চাইল প্লেনে করে যাবার সময় ভারত আর পূর্ব পাকিস্তানের মধ্যেকার সীমান্তরেখা দেখা যাবে কিনা। তখন বাবা হেসে বলেছিল, সে কী! তুমি কি ভাবো ম্যাপে যেমন দুই দেশকে সবুজ আর লাল দেখিয়ে মাঝখানে কালো লাইন টেনে দেওয়া থাকে তেমনই থাকে জমির চেহারায়?
ঠাকুরমা তাতে রাগ করেনি। ব্যাপারটা বুঝতে বেশ সমস্যায় পড়েছিল। এই যা!
দেশ কী ছিল, কী হল, এটা যেমন কিছু মানুষের সমস্যা, তেমনি কিছু মানুষের সমস্যা হল দেশ কী রকম, কী হতে পারে। এই সব কী ও কেনই বলা চলে ডায়াস্পরিক বাঙালি, ছড়ানো ছিটোনো বাঙালি জীবন নিয়ে উপন্যাসের উপজীব্য। যেখানে লেখকের স্মৃতি ও সত্তা নির্ধারণ করে কাহিনি, কথন ও শৈলী। সেই স্মৃতিকে, কখনও কখনও সত্তাকেও, পুনরাবিষ্কৃত করারও প্রয়োজন হয়।
যৌবনে ‘ইউলিসিস’ উপন্যাসের লেখক জেমস জয়েস সেই যে তাঁর শহর ডাবলিন ত্যাগ করলেন সেই থেকে সারা জীবন মগজে ডাবলিন নিয়ে ঘুরলেন বিদেশ-বিভুঁইয়ে। ফিরলেন না কখনও, কিন্তু লিখে গেলেন শুধু ডাবলিন, ডাবলিন আর ডাবলিন। এতটাই যে ‘ইউলিসিস’-কে বলা হয়েছে ডাবলিনের স্ট্রিট ডিরেক্টরি।
এখনকার ইংরেজি ভাষা ভারতীয় লেখকদের লেখার বড় সম্বল, সহজ করে বলতে, স্মৃতি ও গবেষণা। সামান্য জটিল করে বললে, স্মৃতির গবেষণা। যে জন্য স্মৃতির শহরে ফিরে ফিরে আসা, তালুকদারি কায়েম করা।
সম্প্রতি ‘দ্য লোল্যান্ড’ লিখে এবং কলকাতা ফিরে ছোটখাটো স্মৃতিচারণা করে এই আলোচনাই নতুন করে উস্কে দিলেন ঝুম্পা। এক সময়, ২০০৪ সাল, সুন্দরবন নিয়ে ‘দ্য হাংরি টাইড’ উপন্যাস লিখে প্রায় এমনই এক কথাবার্তার মহল তৈরি করেছিলেন অমিতাভ ঘোষ।
‘দ্য হাংরি টাইড’ বাস্তবিকই একটা গবেষণার উপর দাঁড়িয়ে, তার নায়ক-নায়িকা কানাই-পিয়া-ও গবেষণা দিয়ে শুরু করে এক জীবনজিজ্ঞাসাতেই এসে পৌঁছয়।
ডলফিন বা শুশুক নিয়ে কাজ করার জন্য সুন্দরবন আসা বাংলা-না-জানা আমেরিকাজাত বাঙালি পিয়ার। দিল্লিপ্রবাসী কানাইয়ের সুন্দরবন আসা প্রয়াত মেসোমশাইয়ের রেখে যাওয়া সব পাণ্ডুলিপি উদ্ধারের জন্য। ওদের সুন্দরবন প্রবেশে পাঠকের বাংলার মুখ দেখা শুরু হয়। ‘দ্য হাংরি টাইড’ একটু একটু করে হয়ে ওঠে অমিতাভ ঘোষেরও সুন্দরবন আবিষ্কার।
বিক্রম শেঠ উপমন্যু চট্টোপাধ্যায় অমিতাভ ঘোষ অমিত চৌধুরি কুণাল বসু
লন্ডনে জন্মে আর মার্কিন দেশের রোড আইল্যান্ডে বড় হয়ে ঝুম্পার বাঙালি ও বঙ্গভূমি চেনা শুরু ছোট্ট ছোট্ট রোজকার ঘটনার আঘাতে। সেই চিনে ওঠা নিয়েই সম্ভবত ওঁর ‘হোয়েন মিস্টার পিরজাদা কেম টু ডাইন’ গল্প।
বাচ্চা মেয়ে লীলা দেখে পিরজাদা সাহেব বাবার সঙ্গে বাংলায় কথা বলেন, একই ঠাট্টায় হাসাহাসি করেন, ওঁরা চেহারাতেও খুব কাছাকাছি, আমের আচার দিয়ে ভাত মেখে হাত দিয়ে খান। তা হলে বাবা কেন বারণ করেন ওঁকে ভারতীয় না বলতে?
মিস্টার পিরজাদা বাঙালি কিন্তু ভারতীয় নন। তিনি বাঙালি কিন্তু লীলাদের মতো হিন্দু নন। তিনি যে ঢাকা শহর থেকে বছরখানেকের জন্য গবেষণায় এসেছেন আমেরিকায় সেই ঢাকায় বাঙালি মুসলমানদের মারছে পাকিস্তানি মুসলমানেরা। দেশে নিজের সাত-সাতটা মেয়েকে রেখে এসেছেন পিরজাদা সাহেব। ওদের মনে পড়ে বলে লীলার জন্য টফি নিয়ে ঢোকেন। বাবার সঙ্গে বসে টিভিতে দেখেন নিজের শহরটা জ্বলছে। বছরটা ১৯৭১। পিরজাদা সাহেবের সঙ্গে বাবাও সমান উৎকণ্ঠায় দেখছে ঢাকায় ঢুকছে যুদ্ধের ট্যাঙ্ক। সেদিন লীলাকে ক্লাসের পড়াশুনো রেখে ওই দৃশ্য দেখতে বলল বাবা।
তা হলে বাবা আর পিরজাদা সাহেবে তফাত কোথায়? ছোট্ট একটা তফাত অবশ্যই নজর করতে ভোলেনি লীলা। রোজ নৈশাহারের আগে বুক পকেট থেকে একটা রুপোর পকেট ঘড়ি বের করে সেটায় দম দেন পিরজাদা।
ঘড়িটার সময় নাকি মেলানো আছে ঢাকার সময়ের সঙ্গে। আমেরিকায় দৈনিক কাজকারবারের বাইরের বাকি সময়টা তিনি ওই বুকে ধরা সময়টা দিয়ে চলেন। লীলা ওই কিশোরীকালেই টের পায় যে মানুষটির হাতে বাঁধা সময় আর বুকে ধরা সময় দিয়ে ওঁর জীবনটা দু’ভাগে ভাগ হয়ে আছে।
ইংরেজিতে লেখা বাঙালিদের উপন্যাস এক অর্থে এই ভাগ হয়ে থাকা জীবনের গাথাঞ্জলি।
ঝুম্পার লেখা শুরু হয়েছিল বিদেশে, বলতে গেলে নির্বাসনে থাকা ভারতীয় জীবন নিয়ে। অমিতাভর কাহিনিমালায় নানা ভূগোলে খণ্ড-বিখণ্ড হয়ে বাঙালি-জীবনকথাই ফিরে ফিরে আসে। ‘সার্কল অফ রিজন’ বা ‘দ্য স্যাডো লাইনস’ উপন্যাসে কল্পিত চরিত্রদের দেশ হারানোর বিয়োগবেদনার ছবি তো আছেই, এমনকী আত্মস্মৃতি রূপায়ণ ‘ইন অ্যান অ্যান্টিক ল্যান্ড’ বইয়ে ‘নাশাউয়ি’ পরিচ্ছেদে এমন একটা রুদ্ধ বিলাপও কত যত্ন করে রাখা আছে। ওঁর কথাতেই শোনাই?...
“যখন ছোট ছিলাম তখন এমন একটা জায়গার বাসিন্দা ছিলাম যার অদৃষ্টে ছিল পৃথিবীর মানচিত্র থেকে ছেঁড়া পাতার মতন ঝরে পড়া।
জায়গাটি পূর্ব পাকিস্তান। যা ১৯৪৭-এ সৃষ্ট হয়ে মোটে পঁচিশ বছর টিকতে পারল আর তার পরই বাংলাদেশ নামে এক নতুন দেশ হয়ে জন্মাল। জায়গাটির এহেন মৃত্যুতে কারও মন কাঁদেনি, আর আমার স্মৃতিতে যদি তা বেঁচে থাকেও তা নিতান্তই দৈবক্রমে। কারণ আমার বয়স যখন ছয় তখন আমার বাবাকে ঢাকার ভারতীয় দূতাবাসে উপপ্রধান হিসেবে নিযুক্ত করে পাঠানো হল।
ঢাকায় আমাদের ‘বিদেশি’ হিসেবে থাকার মধ্যে একটা শ্লেষ ছিল, কারণ ঢাকায় আমার পূর্বপুরুষের ভদ্রাসন ছিল। আমার বাবা-মা দু’জনেই ঢাকার বর্ধিষ্ণু হিন্দু পরিবারের সন্তান। কিন্তু পাকিস্তান নামে মুসলমান রাষ্ট্র গঠনের বহু পূর্বে আমার পূর্বপুরুষরা আরও পশ্চিমে পাড়ি দিয়েছিলেন। আর তাঁদের সেই জন্য আমরা এখন ভারতীয় আর ঢাকা বিদেশ-বিভুঁই, যদিও আমরা আজও সেই বাগবুলিই বলি আর আমাদের অনেক আত্মীয়-পরিজনই শহরটার হিন্দু তল্লাটে বসবাস করেন।”
বিলেতে জন্ম নয় অমিত চৌধুরীর, তবু কলকাতা থেকে তো অনেকটাই দূরে মুম্বইতে। তার পর তো লন্ডনে, অক্সফোর্ডে পড়াশুনো। কিন্তু প্রথম উপন্যাস ‘আ স্ট্রেঞ্জ অ্যান্ড সাবলাইম অ্যাড্রেস’-এ মুম্বই থেকে বালক সন্দীপের কলকাতায় আসার যে বৃত্তান্ত তিনি এঁকেছেন তা পড়তে পড়তে খেয়াল থাকে না কোন ভাষায় পড়ছি। ইংরেজি নাকি বাংলা! ছবিটা তুলে দেবার মতো...
“ও গলিটা দেখতে পেল। ছোট্ট ছোট্ট বাড়ি, ভাল দেখতে না, মনে রাখার মতোও না, সব মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। ছোটমামার বাড়ির ছোট্ট উঠোনে একটা বাতাবি লেবুর গাছ ছিল আর জানলায় জড়িয়ে থাকত মাধবীলতা। একটা ছেলে ঝুলে ছিল মরচে পড়া লোহার গেটটায়, আর আরেকটা ছেলে সেটাকে সমানে ঠেলছিল আর টানছিল। আর তাতে গেটে চড়া বাচ্চাটা শূন্যে, একটা ছোট্ট বৃত্তে যাচ্ছিল, আসছিল।
ট্যাক্সিটা যখন থামল ওরা কয়েক মুহূর্ত খুব গম্ভীর নজরে দেখল, তার পর ভয়ের চোটে দৌড় লাগাল। গেটটা তখনও মৃদুমন্দ আর বেওয়ারিশ ভাবে দুলে চলেছে। ওপরে একটা জানলা খুলল (হঠাৎ সব কিছু এত শান্ত হয়ে পড়েছিল যে সন্দীপ জানলা খোলার আওয়াজটাও শুনতে পেল) আর বাবলার মুখটা ধরা দিল শার্সির পিছন থেকে।”
বলা হয়, এই মনে পড়াগুলোই নাকি গল্প, আর তাদের বাঁধার জন্য যে স্মৃতি নির্মাণ, সে জন্যই গবেষণা। সে রকম স্মৃতির গবেষণার জন্য কুণাল বসু লম্বা সময় ধরে দক্ষিণ কলকাতার এক বহুতল ইমারতের প্রায় টং-এ বসে জানলা দিয়ে শহরের দৃশ্য দেখতে দেখতে উপন্যাস লেখেন।
জানলা দিয়ে তিনি শহরের অপেক্ষাকৃত অবস্থাপন্ন গলি ও গল্ফ খেলার সবুজ মাঠ দেখতে পান, কিন্তু মনে মনে গড়তে থাকেন বহু আগের স্মৃতি, যখন তিনি এই শহরেরই এক লাফিয়ে লাফিয়ে বড় হতে থাকা যুবক, যাকে রাস্তায় দেখে মৃণাল সেন স্থির করেন ওঁর ছবিতে নেবেন।
এ সব নিয়ে ‘দ্য ওপিয়াম ক্লার্ক’ বা ‘দ্য জাপানিজ ওয়াইফ’-লেখক কথা বললে মনে হয় তিনি যেন স্মরণ করা ও গড়ন করার মধ্যেকার ধূসর এলাকায় ঘুরে বেড়াচ্ছেন।
কে যেন বলেছিলেন যে, স্মৃতিই মানুষের অন্তরঙ্গতম কল্পনা ও নির্মাণ, যা তাকেই মুহূর্মুহু চমকিত করে। লালনের গানেও মানুষের এই বহুস্তর জীবনের ইঙ্গিত ছিল যখন বাঁধলেন, ‘তোমার মধ্যে বসত করে কয়জনা/ তুমি জান না।’
নিজেকে, বাঙালিকে, কলকাতাকে খোঁজার জন্য কলকাতায় আসার কথা হচ্ছিল। সম্পর্ক ছিঁড়ে ফেলার জন্যও কলকাতা পাড়ি ঘটেছে ভারতীয়ের লেখা বিশ্রুত ইংরেজি উপন্যাসে। বিক্রম শেঠের ‘আ ফুটবল বয়’-এ। কন্যা লতা কার একটা প্রেমে পড়েছে জেনে মাথায় আকাশ ভেঙে পড়েছে রূপা মেহরা’র। বিক্রম লিখছেন....
“‘চোপ্! একটাও কথা বলবি না! কষে দু’টো চড় লাগাব তাহলে। ধোপা পাড়ার আশেপাশে বেহায়ার মতো বেরিয়ে ফুর্তি হচ্ছে....আর কোনও দিন বাড়ির বাইরে যাবি না তুই। শুনতে পাচ্ছিস? কানে গেল?,’ বলে উঠে দাঁড়ালেন রূপা মেহরা।
লতা বলল, ‘হ্যাঁ মা।’ কবীরের সঙ্গে দেখা করার জন্য মাকে মিথ্যে বলতে হল ভেবে ওর একটু লজ্জাই হল। ভাল লাগার আবেশটা যেন তছনছ হয়ে গেল। কেমন একটা আতঙ্ক হল, সঙ্গে একটা বিশ্রী ভাব।
‘কী নাম ওর?’
লতার মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল। বলল, ‘কবীর।’
‘কবীর কী?’
লতা চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। এক ফোঁটা চোখের জল ওর গাল বেয়ে নেমে এল।
শ্রীমতী রূপা মেহরার মধ্যে কোনও করুণার উদ্রেক হল না তাতে। এ সব ন্যাকা চোখের জল কী জন্যে? তিনি লতার একটা কান ধরে আচ্ছা করে মুচড়ে দিলেন। লতা ‘আহ্’ করে উঠল।
‘ওর একটা নাম নিশ্চয়ই আছে, তাই না? ও কী কবীর লাল, কবীর মেহরা, না কী? তুই কি চা-টা ঠান্ডা হওয়ার অপেক্ষায় আছিস? নাকি সব ভুলে মেরেছিস?’
লতা চোখ বন্ধ করে ফেলল।
‘কবীর দুরানি’ ও বলল, আর অপেক্ষায় রইল বাড়িটা ভেঙে পড়ার জন্য। ‘আমার সন্ন্যাসিনী হওয়াই উচিত ছিল। মনে আছে বাবা বলত আমাদের উচিত মনের কথাটাই শোনা।’
‘ফের কথা বলছিস?’ বাবার নাম আনাতে খেপে উঠলেন শ্রীমতী রূপা মেহরা। ‘তোকে দু’টো থাপ্পড় লাগাব।’
বলেই মেয়েকে জোরের সঙ্গে দু’টো চড় কষলেন আর হাউ হাউ করে কাঁদতে লাগলেন।
শ্রীমতী রূপা মেহরা বাড়ি ফিরে কিছু টাকা নিলেন আর সোজা ব্রহ্মপুর জংশন স্টেশনে গিয়ে কলকাতা যাবার সন্ধের ট্রেনের দু’টো টিকিট কাটলেন।
লতা মাকে কিছুই বলল না, চুপ করে শুনল যখন মা যাবার জন্য বাক্স গোছাতে বলল। ‘কাল সন্ধের ট্রেনে কলকাতা যাচ্ছি আমরা, ৬টা ২২-এর গাড়ি। একটাও কথা বলবি না,’ শ্রীমতী রূপা মেহরা শাসালেন।
লতা একটাও কথা বলল না, কোনও মনোভাবই প্রকাশ করল না। খুব যত্ন করে জিনিস গোছাল। রাতের খাওয়া একটু খেলও। ওকে সঙ্গ দিল মনের মধ্যে কবীরের মুখটা।”
বিক্রমের লেখা কলকাতার কথা অবলীলায় মনে এনে দেয় আরও দু জন ইংরেজি ভাষা ভারতীয় লেখকের কথা। প্রথম জন বেদ মেহতা যিনি যৌবনে কবিবন্ধু ডম মোরেজ-এর সঙ্গে কলকাতা টহল দিতে এসেছিলেন। সেই যুগলভ্রমণ নিয়ে ডম সে সময় একটা দারুণ রোম্যান্টিক একটা ভ্রমণ কাহিনি লিখেছিলেন‘গন অ্যাওয়ে’।
সে বৃত্তান্তে ডম ও বেদের বৌবাজারের বাইজিবাড়ি যাবার কথা আছে। রেকর্ড চালিয়ে হাবিজাবি নাচছিল মেয়েটা। আর দালালটা শুধু রাতে থেকে যাওয়ার পরামর্শ দিচ্ছিল। শেষে ঢের হয়েছে মনে করে দাম চুকিয়ে দু’জনে তরতরিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নামা ধরেছি। ওই নামার মধ্যেই দালালের চাকুতে বেদের শার্ট ফালা হয়ে গেল।
এর পঁচিশ বছর পর সেই বাড়ির সেই সিঁড়ি দিয়ে উঠতে হয়েছিল এই নিবন্ধকারকে। কারণ শহরের শেষ বাইজিদের নিয়ে লেখার উদ্যোগ। ডমের সেই বর্ণনার সঙ্গে সমানে মেলাতে হচ্ছিল জায়গাটাকে। আর মনে পড়ছিল আরেকটা সিঁড়ির কথা। নবনীতা দেবসেনের ‘ভাল বাসা’ বাড়ির সিঁড়ি।
সেই সফরের অনেক পরে ফের কলকাতা এসেছিলেন অন্ধ বেদ মেহতা। ওঠার সময় দিব্যি মনে মনে গুনে নিয়েছেন ক’টা সিঁড়ি পেরিয়ে দোতলা। নামার সময়ে দিব্যি টকটক করে নেমে এলেন এবং কোনও একটা ধাপিতে এসে দৃষ্টিহীন বেদ সতর্ক করলেন গৃহকর্ত্রীকে, ‘মাইন্ড ইয়োর স্টেপ, নবনীতা।’
হাসতে হাসতে নবনীতা বলেছিলেন, ‘ওর কথা শুনে বোঝা গেল না কে দেখে আর কে দেখে না।’
কলকাতার ফেরে পড়েছিলেন ডম। শেষ জীবনে খুব আসতেন, একবার তো বিলেতের চ্যানেল ফোর-এর জন্য তথ্যচিত্রের চিত্রনাট্য লিখতে এলেন। বিষয় ‘রাজ’ আমলের কলকাতা। আর খোঁজ নিচ্ছিলেন লাশিয়স লোলা নামের এক অ্যাংলো ইন্ডিয়ান ক্যাবারে শিল্পীর। যিনি ডমের মতে ছিলেন ফ্লোর শো আর্টিস্ট হিসেবে এদেশে তুলনাহীন।
সেই তুলনাহীনা যখন লাশিয়াস লোলা হননি, নিতান্তই জনৈকা লোরেন সুইস্টন, তিনি বাস করতেন নিবন্ধকারের বাড়ির পিছনে। মধ্য কলকাতার অ্যাংলো ইন্ডিয়ান জনগোষ্ঠী অধ্যুষিত মধ্যবিত্ত পাড়ায়। ডমকে জানাতে হয়েছিল যে সেই পরমাসুন্দরীটিও বহু কাল দেশছাড়া, সম্ভবত অস্ট্রেলিয়ায়।
হতাশ হয়ে ডম নিজের বইয়ের নামটাই উচ্চারণ করেছিলেন ‘গন অ্যাওয়ে’।
ডম বা বেদের মতো অবাঙালি নন বাঙালি লেখক উপমন্যু চট্টোপাধ্যায়। ইংরেজিতে তার যে প্রথম উপন্যাস তা বঙ্গ বা বাঙালি অভিমুখের নয়।
ওঁর প্রেক্ষাপট সর্বভারতীয়, যা ওঁর প্রথম উপন্যাসের শিরোনামেই প্রকট ‘ইংলিশ অগস্ট: অ্যান ইন্ডিয়ান স্টোরি’। মুম্বইবাসী এই ১৯৮৮ সনের উপন্যাসে তাঁর কয়েক বছর আগের ইন্দিরা গাঁধী হত্যা ও দিল্লি শহর জুড়ে শিখ নিধনের মর্মন্তুদ বর্ণনা কী ভাবে যেন অমিতাভ ঘোষের ঢাকার বাঙালি বুদ্ধিজীবী হত্যা ও ঝুম্পা লাহিড়ীর গল্পে আমেরিকা বসে টিভিতে সেই বর্বরতা দেখার স্মৃতির উদ্রেক করে, কী ভাবেও যেন তাদের এক সূত্রে গাঁথে।
মজার সঙ্গে লক্ষ করি এও যে, নায়ক পাঞ্জাবি যুবা বানি দিল্লির ওই জটিল সময়ে সেলুনে চুল ছাঁটতে বসে কী ভাবছে? না, আট বছর আগের এক চুল ছাঁটার কথা। কোথায়? না দার্জিলিং-এ। বাঙালির প্রিয় যে শহরটি এর কিছু দিনের মধ্যেই নিজস্ব এক জটিলতায় জড়িয়ে যাবে।
এ ভাবেই বাঙালি ও কলকাতা আধুনিক লেখকদের স্মরণে মননে গবেষণায় ভর করে কখনও ঘর, কখনও বাহির হয়ে ধরা দিচ্ছে রচনায় রচনায়। ইংরেজিতে বাংলা, বাঙালি, কলকাতা নিয়ে পড়লে নির্বাসনের ছবিটা বার বার ফিরে আসে। এত ঘন ঘন কেন। তাও বুঝি না। তখন বাঙালির এক প্রিয়তম ইংরেজ কবির ক’টা লাইন মনে আসে। লিখেছিলেন আফ্রিকায় যুদ্ধ করতে গিয়ে শহিদ হওয়া ভারতীয় সৈন্যদের স্মরণে...
এভরি কান্ট্রি ইজ হোম টু ওয়ান ম্যান
অ্যান্ড এগজাইল টু অ্যানাদার।

আজ যখন ঝুম্পা, অমিতাভ, কুণালদের ফিরে ফিরে আসতে দেখি শহরে ছোটখাটো তথ্যের টানে, সেই আসা ও আবর্তনকেও অভিযান বলে ঠাহর হয়। এই আসা-যাওয়ার পথের ধারেই টুকরো টুকরো সত্য ছড়িয়ে আছে, আমরা দেখি বা না দেখি। শুধু লিখে ফেলাই নয়, এই অভিযানও সাহিত্য। ফের স্মরণ করতে হয় সেই প্রিয় এলিয়টকে, যখন ওঁর মহৎ কাব্য ‘ফোর কোয়ার্টেট’-এর শেষ পর্বে লিখছেন...
উই শ্যাল নট সিজ ফ্রম এক্লপ্লোরেশন
অ্যান্ড দ্য এন্ড অব অল আওয়ার এক্সপ্লোরিং
উইল বি টু অ্যারাইভ হোয়্যার উই স্টার্টেড
অ্যান্ড নো দ্য প্লেস ফর দ্য ফার্স্টটাইম।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.