|
|
|
|
|
|
|
মুখোমুখি... |
|
অনেক অযোগ্য লোক আজেবাজে মন্তব্য করছে |
নাটক ‘মেফিস্টো’ ফিরিয়ে বিস্ফোরক আড্ডায় পরিচালক সুমন মুখোপাধ্যায়। সামনে দেবশঙ্কর মুখোপাধ্যায়। |
পত্রিকা: হাইল হিটলার!
সুমন: হা হা হা হা...
পত্রিকা: ১৯২৩-এর হিটলার জমানার হামবুর্গ। ২০১৪-র কলকাতা। কী এমন মিল বা মেটাফর পেলেন, যাতে আবার ‘মেফিস্টো’?
সুমন: না, না, সরাসরি কোনও মিল খুঁজে পাওয়া যাবে না। এখানে কোনও হিটলার নেই। তেমন কোনও রাজনৈতিক নেতার সঙ্গেও কোনও মিল নেই। কিন্তু শিল্পীর সঙ্গে রাষ্ট্রের বা রাজনীতির যে সম্পর্ক, তার কতগুলো ঈঙ্গিত একটা বড় ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট তৈরি করে। সেই জায়গাটা আমি ধরার চেষ্টা করেছি। এই সময়টায় দাঁড়িয়ে যখন ভারত বিশেষ একটা রাজনৈতিক মুহূর্তের সামনে, পশ্চিমবঙ্গও বিশেষ অবস্থার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে, তাতে শিল্পীদের একটা ভূমিকা নিতে দেখা যাচ্ছে, তার থেকে আমার মনে হচ্ছিল, শিল্পী-রাষ্ট্র সম্পর্কটা যদি আর একবার ইতিহাস থেকে পড়ে দেখতে পারি।
পত্রিকা: সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় আর কবীর সুমনকে শো দেখতে দেখলাম। কী বললেন ওঁরা?
সুমন: সৌমিত্রবাবু যা বললেন, তাতে একই সঙ্গে অস্বস্তি যেমন হয়েছে, তেমন শিহরনও...
পত্রিকা: কী রকম?
সুমন: বললেন, উৎপল দত্তর উত্তরাধিকার তোমার ওপর বর্তেছে।
পত্রিকা: দেখতে দেখতে কিন্তু অনেকেরই পিএলটি-র ‘ব্যারিকেড’-এর কথা মনে পড়তেই পারে.... বিশেষ করে যখন মোৎজার্ট-বিঠোফেন কি শুবার্ট বাজছে, আর অভিনয়টা অপেরার চেহারা নিচ্ছে...। কবীর সুমন কী বললেন?
সুমন: সুমনদা বলল, একটা দারুণ থিয়েট্রিকাল ইভেন্ট দেখলাম। অনেক কিছু নিয়ে গেলাম এখান থেকে।
পত্রিকা: স্বস্তিকা মুখোপাধ্য্যায় দেখলেন?
সুমন: হ্যাঁ, সে তো প্রথম শো-এ। কিন্তু হঠাৎ স্বস্তিকা কেন?
পত্রিকা: কেননা ইন্ডাস্ট্রির খবর, আপনি নাকি স্বস্তিকার প্রেমে...
সুমন: এই আলোচনায় এ প্রসঙ্গ অবান্তর।
পত্রিকা: ২০০২ সালে যখন প্রথম বার ‘মেফিস্টো’ করেছিলেন, তখন ইস্যুটা ছিল গোধরা কাণ্ড। এ বার লোকসভা নির্বাচনে মোদী হাওয়া...
সুমন: হ্যাঁ, মোদী উত্থানের ব্যাপারটা মাথায় আছে।
|
|
ছবি: সুব্রত কুমার মণ্ডল। |
পত্রিকা: কেউ কেউ কিন্তু বলেন, এই ইস্যু-টিস্যু ব্যাপারগুলো সুমন মুখোপাধ্যায়ের পাবলিসিটি স্টান্ট।
সুমন: কে কী বলল, তা নিয়ে আমার কিচ্ছু যায় আসে না। আর এ নিয়ে তো কোনও প্রচার আমি করিনি।
পত্রিকা: অনেকে কিন্তু বলেন, এই বিরোধী-বিরোধী ভাবটা আপনার একটা ভান। বাজার ধরার ভান। আসলে আপনার কোনও দায়-দায়িত্ব নেই।
সুমন: বিরোধীদের দায়িত্ব নেই! এমন তরলীকৃত, অনৈতিহাসিক মন্তব্য কোন অর্বাচীনের? পশ্চিমবঙ্গে বহু দিন ভাল বিরোধী ছিল না বলে একটা সময় যাচ্ছেতাই রাজ্যপাট চালাতে পেরেছে বামফ্রন্ট। আর যাঁরা এ সব বলেন, তাঁদের বলব একবার বিরোধিতা করেই দেখুন না, কীসে ক্ষতি, কীসে লাভ। আমি আমার বিশ্বাসমতো সিনেমা বানাই। বাজারের কথা ভেবে নয়। থিয়েটারটাও সে ভাবেই করি।
পত্রিকা: সেটাই বা করছেন কোথায়? ২০১০ সালের পর ২০১৪। অথচ, সরকারি অনুদানটা না কি দিব্যি নিয়ে যাচ্ছেন।
সুমন: ২০০৮-এ যখন ‘বিসর্জন’ করলাম, তার পর থেকে আমি কোনও সরকারি অনুদান পাইনি। প্রথম যখন আবেদন করি, ৬ জন অভিনেতা আর ১ জন গুরুর নামে টাকা গ্র্যান্টেড হয়। প্রথম বার ৮ মাসের টাকা পেয়েছিলাম। তার পর আর নয়। ‘বিসর্জন’-এরও পুরো টাকা পাইনি। টাকা না পেলে প্রোডাকশনটা করব কী করে? অন্য কারও কাছ থেকেও টাকা নিতে চাইনি। অন্য দল ডেকেছিল অনেক বার পরিচালনা করতে। সেটা আমার ইচ্ছে করেনি। আর পরের পর নাটক নামাতেই হবে, এটা ভেবে আমি থিয়েটার করিনি কখনও। আমার ফিল্ম করাও ছিল।
পত্রিকা: প্রথম বার ১০-১২ দিনের প্রস্তুতিতে ‘মেফিস্টো’ নেমেছিল...
সুমন: একদিন দুপুরে সবাইকে ফোন করে বললাম, চল একদিন বসি। একটা নাটক করি। ১ মে স্ক্রিপ্ট পড়া হল। সবাই বলল, নাটকটা নামাতে। সময় নিয়ে অসুবিধে প্রায় প্রত্যেকের। ঠিক করলাম সারা রাত রিহার্সাল দেব। কেউ ভাবেইনি কে কী রোল প্লে করবে। ব্রাত্য একটা দু’মিনিটের রোল করত। কৌশিক পাঁচ মিনিট। অসম্ভব উছ্বাস ছিল সবার মধ্যে।
পত্রিকা: এ বার তো পুরনো অভিনেতাদের মধ্যে মাত্র দু’জন। অন্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন?
সুমন: দরকার পড়েনি। সে বার নাটক করার চেয়েও প্রতিবাদ করা, সবাই মিলে একসঙ্গে একটা ঘোষণা করার প্রয়োজন ছিল।
পত্রিকা: বাংলা থিয়েটারের এখনকার যে অশান্তির বাতাবরণ, তাতে সুমন মুখোপাধ্যায় এই ‘কল’টা যদি আবার দিতে পারতেন, ‘চল, বসি, একসঙ্গে নাটক করি...
সুমন: আমার কোনও অসুবিধে নেই। কিন্তু সেটা ‘মেফিস্টো’ নয়। অন্য নাটক। আর এখন সেটা হবে না। পারস্পরিক এত ক্লেদ মাঝখানে...
পত্রিকা: এ সব তো আগেও ছিল।
সুমন: ছিল, তবে ঠিক এ রকমটা নয়। মনে আছে, ধরণী ঘোষের সঙ্গে বিভাস চক্রবর্তীর উত্তপ্ত চিঠি-চালাচালি বা শম্ভু মিত্রর সঙ্গে উৎপল দত্তর তর্ক। পাশাপাশি তাঁরা কী সব নাটক করে গেছেন! সে দিক থেকে দেখলে বাংলা নাটকের যে মান ছিল, সেটা ক্রমশ অপসৃত হচ্ছে। নাটকে কত লোক আসছে, সেটা আমার কাছে বড় নয়, কী ভাবে সেটা তৈরি হচ্ছে সেটাই বড়। দল বেড়েছে, দর্শক বেড়েছে, কিন্তু নাটকের যে একটা বিস্তীর্ণ জগৎ ছিল, সেটা বোধহয় ক্রমাগত কমে যাচ্ছে। জানার ক্ষেত্রটা চলে যাচ্ছে। আগে যখন আমাদের জ্ঞান আঙুলের ডগায় ছিল না, তখন কত পরিশ্রম করে, বই সংগ্রহ করে, দেশে বিদেশে নতুন নাটক কী হচ্ছে দেখে থিয়েটার করতে হত। সেই অনুশীলনের জায়গা থেকে সরে গিয়ে আমরা বড্ড প্রাদেশিক জায়গার মধ্যে আটকে পড়ছি। এত অযোগ্য লোক এখন এত কথা বলার সুযোগ পাচ্ছে! যাঁরা বলতে পারবেন না কোনও একটা উচ্চমার্গের থিয়েটার তাঁরা করেছেন, তাঁরাও অন্যদের নিয়ে আজেবাজে সব মন্তব্য করছে। যাঁরা দক্ষ, তাঁরা তো বুঝতে পারছে... তাঁদের উচিত বলা, এ রকম কথা বলার আগে তুমি নিজের কাজটা আগে দেখো। এটা মনে করিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব তাঁদেরই, যাঁরা প্রমাণ করেছেন বছরের পর বছর। করছেন না। যে ভাবে প্রকাশ্যে ব্যক্তি আক্রমণও হচ্ছে, মিডিয়াতে খবর হচ্ছে, সেটা সত্যি কোনও কালে ছিল না।
পত্রিকা: সলমন-শাহরুখ হাতাহাতি হলে প্রকাশ্যে আসতে পারে, টলিউডের কারও সম্পর্ক ভাঙলে খবর হতে পারে, আর নাট্যকর্মীর ব্যক্তিজীবনে আলো পড়বে না?
সুমন: বুঝি এই যুগে ব্যক্তিজীবন নিয়ে টানাটানি চলবে। কিন্তু তার সঙ্গে অনুশীলনটা তো হবে। পারস্পরিক যোগাযোগ, আদানপ্রদানটা তো থাকবে।
|
|
মেফিস্টো |
পত্রিকা: অক্টোবর মাসে আপনি-ব্রাত্য-দেবশঙ্কর ‘পত্রিকা’-কে সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন। তখনই প্রথম ‘মেফিস্টো’ করার কথা বললেন। শুনে ওঁরাও খুব খুশি হয়েছিলেন। একজন তো বলেই ফেলেছিলেন, আমি হফগেনের চরিত্রটা করব। মশকরাই হচ্ছিল... অন্তত ‘মেফিস্টো’ নিয়ে একটা যোগাযোগের জায়গা তো ছিলই ...এ বার যখন নাটকটা নামছে, তখন ওঁদের সঙ্গে আপনার এক্সচেঞ্জ হয়েছে?
সুমন: এইটাই তো আমি বলছি। দর্শনের একটা ফারাক থাকতে পারে, নাটক করা সম্পর্কে মতামত নাও মিলতে পারে... কিন্তু পারস্পরিক যোগাযোগের ক্ষেত্রটা ক্রমাগত বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে। তবে এ বার আমার যোগাযোগ করার দরকার পড়েনি। সব সময় যে দরকার পড়বে, তা’ও নয়। যদি কোনও চরিত্রে মনে হয় ব্রাত্যকে আমার দরকার, তখন আমি নিশ্চয়ই যোগাযোগ করব। চলচ্চিত্র বা নাটকের প্রয়োজনটাই আমার শেষ কথা। আমি দেখেছি কাজ করার ক্ষেত্রে আমাদের কোনও অসুবিধে হয় না। আমি আগেও ওর সঙ্গে নাটক করেছি। এই তো ও আমার জন্য একটা নাট্যরূপ করে দিল... ‘চার অধ্যায়’...
পত্রিকা: সে তো বহু কাল আগে...
সুমন: বছরখানেক হয়তো হবে। না দেখুন, মূল ক্ষেত্রটা হল, ভাল থিয়েটার করতে হবে... তার জন্য যা করণীয় করতে হবে। সেটা না করে এমন একটা আকচাআকচির জায়গায় পৌঁছচ্ছে জিনিসটা...
পত্রিকা: তার জন্য প্যারালাল ডায়ালগও চলতে পারত। অন্তত ব্যক্তিগত স্তরে।
সুমন: তাও করেছি। ‘রাজা লীয়ার’ নিয়ে প্যারালাল ডায়লগের চেষ্টা তো অনেকবার করেছি। ব্যক্তিগত স্তরেই। ফোন করে বলেছি। ব্রাত্য, অর্পিতা দুজনকেই। তার চিঠিও আমার কাছে আছে। যে ই-মেলটা করেছিলাম, যে কী কী ভাবে এটা ঠিক করা যেতে পারে... আয় বোস...
পত্রিকা: সিনিয়রদের সাহায্য নিতে পারতেন। দু’পক্ষের সঙ্গে ভাল যোগাযোগ আছে এমন কারও...
সুমন: এখন নো বডি ইজ স্পেয়ারেবল্। রুদ্রদা’কে (রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত) নিয়ে যে ঝামেলাটা মাঝখানে হল... আক্রমণ করা হল... বিভাসদাও টুকটাক আক্রমণের মুখে পড়েছেন। এই আক্রমণ-প্রতি আক্রমণ চলতে পারে। কিন্তু দেখছি, সবাই না কেমন গুটিয়ে বসে গেছে। এ রকম একটা পরিস্থিতি দেখেই আমি, কৌশিক আর বিপ্লব (বন্দ্যোপাধ্যায়) একটা কমন এজেন্ডায় এলাম।
পত্রিকা: কী?
সুমন: ২৫ মার্চ একাডেমিতে সকাল থেকে রাত থিয়েটার করব। সকালে আমার ‘মেফিস্টো’, দুপুরে বিপ্লবের ‘ক্যালিগুলা’, সন্ধেয় কৌশিকের নতুন নাটক।
পত্রিকা: ‘মেফিস্টো’য় একটা কথা বার বার ঘুরে ফিরে আসছে। ‘শিল্পীদের ক্ষমতার কাছে যাওয়াটা মারাত্মক’। এখানে যদি কেউ বলেন, নাট্যকার, কবি, প্রাবন্ধিক ভাকলাভ হাভেল তো চেক প্রজাতন্ত্রের প্রেসিডেন্টও হয়েছেন। ‘মেফিস্টো’র হফগেনের মতো তিনি আত্মসমর্পণও করেননি। তা হলে ক্ষমতায় ঢুকে হফগেনই একমাত্র ভবিতব্য ধরব কেন?
সুমন: প্রথমত একজন হাভেল দিয়ে কিছু বোঝা যায় না। দুই, হফগেন একমাত্রিক চরিত্রও নয়। ওর মধ্যে নানারকম দ্বন্দ্ব আছে। শেষ দৃশ্যটা মনে করুন, বিধ্বস্ত নিঃসঙ্গ হফগেনের স্বগতোক্তি, ‘ওরা আমার কাছে কী চায়, আমি তো একজন সাধারণ অভিনেতা মাত্র, আমি তো সময়টা বদলে দিতে পারব না।’
পত্রিকা: দুটো প্রশ্ন, এক, প্রতিভাধর শিল্পী যাঁরা, স্বীকৃত যাঁরা, তাঁরা ক্ষমতার সঙ্গে যুক্ত হতে চান কেন? কী মনে হয়? দুই, হফগেনের ক্ষেত্রে তার বার্লিনে থিয়েটার করার একটা স্বপ্ন ছিল। কেরিয়ারটা একটা ব্যাপার ছিল। তা হলে কেরিয়ারটাই প্রায়োরিটি পেয়ে যায় বলবেন?
সুমন: দেখুন, থিয়েটারের অন্য একটা মজা আছে। সাহিত্যিক টমাস মান জার্মানি ছেড়ে চলে যেতে পারেন। কিংবা তাঁর পুত্র ক্লাউস মান ‘মেফিস্টো’ লিখে ছাপার জন্য প্রকাশক না পেয়ে পাণ্ডুলিপি কোথাও একটা রেখে দিতে পারেন। সেটা হয়তো পাঁচ বছর বাদে আবিষ্কৃত হল। কিন্তু হফগেনের মতো একজন থিয়েটারশিল্পীর পুরোটাই তো লাইভ আর্ট।
পত্রিকা: তার জন্যই ক্ষমতার সঙ্গে যুক্ত হতে চান তাঁরা?
সুমন: না না। এই ক্রাইসিসের কথাটাও কিন্তু নাটকের মধ্যে আসছে। ক্ষমতার সঙ্গে যুক্ত না হলে রাষ্ট্রের সঙ্গে সংঘাত বাঁধবে, তখন কাজ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এখন সেই সংঘাতটায় যাবেন, কী যাবেন না। আমি যেমন ‘কাঙাল মালসাট’-এর জন্য ঝামেলায় পড়ে ছ’টা মাস পিছিয়ে গেছি। উল্টো দিকে রাষ্ট্র্রের সঙ্গে থাকলে অনেকগুলো সুবিধে। তবে এমনও তো হয়েছে অনেক বড় বড় শিল্পী রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে গেছেন। ব্রেখট থেকে গার্সিয়া মার্কেজ... তালিকা বিশাল। কেউ অন্য দেশে গিয়েও আশ্রয় নিয়েছেন। তবে ক্ষমতার ভিতরে থাকার মধ্যে অনেক রকম ক্রাইসিসও আছে। ব্রেখটের একটা কবিতা আছে জানেন তো?... যখন ফ্যাসিস্তরা বই পোড়াচ্ছে... তখন একজন কবি দেখলেন, তার নাম ব্ল্যাকলিস্টে নেই। তার বই পোড়ানোও হচ্ছে না। তখন দৌড়ে গিয়ে শাসককে জিজ্ঞেস করেছিলেন, জীবনে একটা বইও কি লিখিনি যেটা পোড়াবার যোগ্য? এই ক্রাইসিসটা ভাবুন একবার। এই যন্ত্রণাটাও তো রয়েছে একজন আর্টিস্টের। সেখান থেকে আমি বলছি হফগেনকে কোনও ছোট জায়গায় ধরলে হবে না। শিল্পীর সঙ্গে রাষ্ট্রের সম্পর্ক, দেখতে হবে। যদি তিনি নাট্যকর্মী হন, তার এই প্রশ্নটা থাকা উচিত, আমি কার জন্য থিয়েটারটা করছি? আমি কি চোখ বন্ধ করে থাকব, যখন হিটলার হাজার হাজার মানুষকে পুড়িয়ে মারছে? তখন কি বলব এই লোকটার সঙ্গে আমি থিয়েটার করছি? নরেন্দ্র মোদীর উত্থান হচ্ছে দেখেও আমি চোখ বন্ধ করে থাকব?
পত্রিকা: শিল্পী-সাহিত্যিকদের রাজনীতি করার জায়গাটা নিশ্চয়ই আপনি অস্বীকার করছেন না?
সুমন: তা করছি না।
পত্রিকা: তা হলে সেই পার্টিটা যদি ভোটে দাঁড়ায়, তাঁর তো একটা আহ্বান থাকতেই পারে মন্ত্রী হওয়ার।
সুমন: একজন শিল্পী যদি সেই সিদ্ধান্ত নেন, তাঁকে কিছু বলার নেই। কথাটা তা নয়। আর এত সরলীকৃত আলোচনা ভুল বার্তা দিতে পারে। আমার কথা হল, শিল্পী রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত হতেই পারেন, কিন্তু তার ফলে কতগুলো বাধানিষেধ আপনা থেকেই আরোপিত হয়। তিনি সেখান থেকে বেরোতে পারেন বলে আমার মনে হয় না। যদি পারেন, তা হলে তিনি খুব বুদ্ধিমান, বড় মাপের বুদ্ধিমান।
পত্রিকা: যেটা হচ্ছে না?
সুমন: জানি না। আমার কথা হচ্ছে যে, কেউ যদি তাঁর ‘সোল’টাকে সেল না করে দিয়ে থাকতে পারেন, সেটা একটা বিশাল ব্যাপার। কিন্তু ক্ষমতা কাউকে ছাড়ে না। সেই কারণেই ‘মেফিস্টো’টা ফিরিয়ে আনা। ক্ষমতায় থেকে একজন হয়তো মনে করছেন, যে ক্ষমতার সঙ্গে সুন্দর সম্পর্কে রয়েছে, শেষমেশ সেই ক্ষমতা তাঁকে গ্রাস করবেই।
পত্রিকা: বলতে চাইছেন, হফগেনের মতো তখন একা দাঁড়িয়ে বলতে হবে, যে...
সুমন: আমার কাছে এরা কী চায়..
পত্রিকা: এ রকম একটা ফাঁকা জায়গা, অসম্ভব একাকীত্ব...
সুমন: হ্যাঁ। তবে আবার বলছি, এটার কোনও প্যারালাল রেফারেন্স আমি টানছি না। নাটকটাকে জোর করে সমকালীনও করতে চাইনি। আমি বড় পার্সস্পেকটিভে ব্যাপারটা দেখতে চাই। কী হলে কী হতে পারে তার সম্ভাবনার কথা বলতে চাই।
পত্রিকা: হঠাৎ তপন থিয়েটার বেছে নেওয়ার কারণটা কী?
সুমন: কারণ ওখানে একমাত্র রিভলভিং স্টেজ আছে। ওটাকে ব্যবহার করতে চাইছিলাম। তা ছাড়া ওখানে আমাকে অনেক দিনই থিয়েটার করতে ডাকা হচ্ছে। সবাই করেছে। আমিই একমাত্র করিনি।
পত্রিকা: এগুলোই কারণ, নাকি হল না-পাওয়ার ঝক্কি থেকে দূরে থাকতে এটা আপনার ট্যাকটিকাল গেম।
সুমন: না, না একেবারেই তা নয়।
পত্রিকা: তবে এটা সত্যি, রিভলভিং স্টেজটার জন্য অদ্ভুত একটা ম্যাজিক তৈরি হচ্ছে...
সুমন: সৌমিত্রবাবু তো বলে গেলেন এটা তপন থিয়েটার-এ করতে। উনি নিজে ওঁর নাটক ‘দর্পণে শরৎশশী’-তে এর ব্যবহার করেছিলেন। তারপর ভেবেছিলেন ওটা খারাপ হয়ে গেছে। এখন উনিও ‘রিভলভিং’ স্টেজটা ব্যবহার করতে চান। কমার্শিয়াল থিয়েটারে তো লাগাতার এই চলটা ছিল। উৎপল দত্তর ‘টিনের তলোয়ার’-এ ‘রিভলভিং-এর কী অসাধারণ অ্যাপ্লিকেশন ছিল, ভাবুন!
পত্রিকা: সেটটাকে একদম পিছন দিকে গ্রিনরুম পর্যন্ত খুলে রাখাটাও বেশ...
সুমন: এটা আমার বরাবরের স্বভাব স্টেজটাকে কী করে এক্সটেন্ড করা যায়...এটা ওই চিন্তা থেকেই। যে কারণে হলের করিডরটাকেও বার বার ব্যবহার করেছি।
পত্রিকা: আচ্ছা, এই হল না পাওয়ার গল্পটা ঠিক কী? আড়ালে আবডালে অনেকের নাকি অভিযোগ। কিন্তু প্রকাশ্যে তাঁদের প্রায় কেউই মুখ খুলতে চান না। ভয়?
সুমন: ভয়টা বড্ড বড় কথা হয়ে যাচ্ছে। আমার মনে হয় কোথাও একটা আশঙ্কা রয়েছে, আমি যদি বেশি কথা বলি, হয়তো আরও ডেট পাব না, হল পাব না। এই আশঙ্কাটা কোথা থেকে আসছে, আমি বলছি। ধরুন, ‘নাট্যস্বজন’ বলে একটা নাটকের প্ল্যাটফর্ম, তাদের ইচ্ছে বাংলা নাটকের উন্নতি সাধন করা, একটা কমন প্ল্যাটফর্ম, যেখানে গ্রাম-মফস্সল একসঙ্গে দাঁড়াতে পারবে, ... এই প্রয়াসটা আমিও ওয়েলকাম করি। কিন্তু একটা অদ্ভুত ব্যাপার খেয়াল করি, ২০/২৫ বছর ধরে কাজ করে রীতিমতো প্রমাণ দিয়েছেন এমন বেশ কিছু নাট্যদল বা পরিচালক এর মধ্যে নেই। তাঁদের ডাকাই হয়নি। অথচ এটা নাকি বাংলা থিয়েটারের প্রতিনিধিত্বমূলক একটা প্ল্যাটফর্ম! আমরা যখন আগে আলোচনা করতাম...আমি ব্রাত্য, কৌশিক, গৌতম, বিপ্লব, দেবশঙ্কর, দেবেশ... বলতাম, আগে যে ব্যাপারটা ছিল, ভীষণ ভাবে নিজেদের লোক ডাকা হত ... যেজন্য আমি কখনই স্বচ্ছন্দ বোধ করতাম না, সেই অস্বাচ্ছন্দ্যটা কিন্তু আবার দেখা যাচ্ছে, যারা ‘নাট্যস্বজন’-এ নেই, তারা একটা চাপ অনুভব করছে। আমি যদি নাট্যস্বজন-এর অংশ না হই, আমি কতগুলো সুবিধে পাব না। হল পাওয়া তার মধ্যে একটা। আবার ধরুন, কতগুলো থিয়েটার ফেস্টিভ্যাল হচ্ছে চারদিকে। এই ফেস্টিভ্যালে তারা যোগ দিতে চায়, দেখা যাচ্ছে, খবরাখবর আমার কাছে যা আসছে, সত্যাসত্য জানি না। পরোক্ষ ভাবে নাট্যস্বজন-এর সঙ্গে যুক্ত দলকে নিতে হবে বলে চাপ আসছে। নইলে নাট্যস্বজন-এর কেউ উইথড্র করছে।
পত্রিকা: দেবেশ চট্টোপাধ্যায়কে জড়িয়ে যে ঘটনা বিতর্ক তৈরি করেছে, তার কথা বলছেন?
সুমন: হ্যাঁ, এরকম একটা ঘটনা শুনেছি, যেখানে দেবেশ উইথড্র করেছে ওর দল। এইগুলোই হয়তো মাথার পেছন কাজ করছে।
পত্রিকা: ‘মেফিস্টো’য় একটা খুব ইন্টারেস্টিং সংলাপ আছে। চট করে আপনার নাটকে এতটা সরাসরি সংলাপ দেখা যায় না ‘মানুষের সবচেয়ে বড় ক্ষমতা যে চিন্তার ক্ষমতা, তাতে লাগাম লাগানো চলছে, চলবে...’
সুমন: ওটা গ্যেয়েটের ‘ফাউস্ট’-এর লাইন। এইটাই তো মূল কথা। হোয়াট পাওয়ার ডাজ টু অ্যান আটির্র্স্ট। হোয়াট পাওয়ার ডাজ টু দ্য পিপ্ল। এই যে আমরা কালচারাল হেজিমেনির কথা বলি, হেজিমেনিটা কী? চিন্তায় লাগাম লাগানো। এই দেখুন না, একটা দেশের ক্ষমতা বদলের সঙ্গে কী ভাবে ইতিহাসের বই পাল্টে যায়! চিন্তাকে ম্যানুভার, ম্যানুপুলেট করার জন্য। ইতিহাসটাকে অন্য ভাবে পড়তে হবে, এটাই তো শাসকের কাজ। লাগাম লাগিয়ে মানুষকে তার পক্ষে আনতে চায় সে। যখন বিজেপি সরকার এসেছিল কেন্দ্রে, তখন ইতিহাস পালটে দেওয়া হয়েছিল। যখন বামপন্থীরা ক্ষমতায় এসেছিল, তারাও তাদের মতো করে ইতিহাস পাল্টে দিয়েছে। এটা শাসকরা করে। কিন্তু আমার শিল্পী হিসেবে তো উচিত, পার্সস্পেকটিভটাকে খোলা রাখা। ইতিহাস অমন করে একবগ্গা ভাবে পড়ব না। আমার দায়িত্ব মানুষকে এই ইন্টার্যাকশনের মধ্যে নিয়ে যাওয়া, তাকে ইতিহাসের দুটো মুখই দেখানো। এ বার যেই কেউ শাসকের পক্ষে যাবে, শাসক বলবে, আমি যে ইতিহাসটা বলছি সেটাই আপনাকে বলতে হবে। না হলে আপনি আমার সঙ্গে আছেন কেন?
পত্রিকা: এগুলো কি পুরোনো বন্ধুরা যারা ক্ষমতায় গেছেন, তাঁদের প্রতি আপনার মেসেজ? বার্তা?
সুমন: আমি ঠিক ওই ভাবে দেখিনি। সামগ্রিক দিক থেকেই বার্তা। তাতে আমার বন্ধুরা যদি মনে করে যে আমাকে বলা হল... ওদের বুদ্ধির প্রতি আমার যথেষ্ট আস্থা রয়েছে। তারা এক রকম ভাবে বুঝবে। আমার বন্ধুরা যারা থিয়েটারটা করে নিজেদের প্রমাণ করেছে, তাদের ইনটেলেকচ্যুয়াল পার্সেপশনটা আছে, তারা বুঝতে পারে। |
|
|
|
|
|