কপালে ভাঁজ বেথুয়াডহরির দৃষ্টিহীন পান্তি মণ্ডলের। মাধ্যমিক পরীক্ষায় ‘রাইটার’ মিলবে কী ভাবে?
একই চিন্তা কৃষ্ণনগর-ঘূর্ণির দৃষ্টিহীন গৌর হালদারের। ভাল লেখক বা ‘রাইটার’ না-পেলে পরীক্ষার ফল ভাল হওয়ার তো সম্ভাবনাই নেই!
শক্তিনগরের দু’টি স্কুলের ওই দুই পড়ুয়া মাধ্যমিকে বসবে ২০১৫ সালে। কিন্তু এখন থেকেই দুর্ভাবনায় পড়ে গিয়েছে তারা। দুশ্চিন্তা পড়াশোনা নিয়ে নয়। এত দিন যা পড়েছে ও পড়ছে, উত্তরপত্রে কী ভাবে সেটা লিখে আসা যাবে, সেই ভাবনাতেই ঘুম ছুটেছে তাদের। কেননা, অন্য পরীক্ষার্থীদের মতো তারা নিজেরা তো উত্তর লিখতে পারবে না। তার জন্য রাইটারের মুখ চেয়ে থাকতে হয় তাদের। শুধু মাধ্যমিকের ওই দুই পরীক্ষার্থী নয়। একই ভাবে বিভিন্ন পরীক্ষায় বসতে ইচ্ছুক দৃষ্টিহীন পড়ুয়ারা ভুগছেন রাইটারের চিন্তায়।
যেমন দেবেন মাহাতো। তিনি পুরুলিয়ার মানবাজারের জগন্নাথ কিশোর কলেজের ছাত্র ছিলেন। বললেন, “রাইটারের অভাবে পরীক্ষা দিতে না-পেরে পড়ায় ছেদ পড়ে গিয়েছিল। যোগাযোগ করি কলকাতার কয়েক জনের সঙ্গে। কিছু সময় নষ্ট হওয়ার পরে আবার ভর্তি হয়েছি প্রথম বর্ষে। নেতাজিনগর ডে কলেজে।”
সমস্যাটা কলকাতার তুলনায় জেলায় অনেক বেশি। দৃষ্টিহীনদের কয়েকটি বিশেষ স্কুল ছাড়া রাইটার পাওয়া সত্যিই মুশকিল বলে জানান কৃষ্ণনগর হেলেন কেলার স্মৃতি বিদ্যামন্দিরের অধ্যক্ষ স্বপন সরকার। তিনি বলেন, “মাধ্যমিক পরীক্ষার ফর্ম পূরণের পরে পরীক্ষার্থীদের হয়ে আমরাই কিছু শিক্ষকের সহযোগিতায় স্কুলে ও কোচিং সেন্টারে অনুরোধ করে থাকি। কিন্তু তাতে সমস্যা থেকে রেহাই পাওয়া যাচ্ছে না।”
কারা রাইটার হতে পারেন?
নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশন ব্লাইন্ড বয়েজ অ্যাকাডেমির অধ্যক্ষ বিশ্বজিৎ ঘোষ জানান, নিয়ম অনুযায়ী কোনও দৃষ্টিহীন ছাত্র বা ছাত্রী মাধ্যমিকে বসতে চাইলে রাইটারকে নবম শ্রেণি বা তার থেকে নিচু ক্লাসের পড়ুয়া হতে হবে। উচ্চ মাধ্যমিকের ক্ষেত্রে রাইটারকে হতে হবে একাদশ শ্রেণি বা তার থেতে নিচু ক্লাসের পড়ুয়া। কিন্তু সমস্যা হল, রাইটার হতে গেলে মাধ্যমিক বা উচ্চ মাধ্যমিকের পাঠ্যক্রম ভাল ভাবে জানা দরকার। খুব নিচু ক্লাসের পড়ুয়ার পক্ষে সেটা জানা সম্ভব নয়। পরীক্ষার্থীরা তাই খুব নিচু ক্লাসের কাউকে রাইটার হিসেবে চায় না। ঠিক এক ক্লাস নীচের পড়ুয়াদেরই পেতে চায়। মুশকিল হল, মাধ্যমিক বা উচ্চ মাধ্যমিকের কাছাকাছি সময়েই নবম ও একাদশের ক্লাস টেস্ট চলে। মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী নবম শ্রেণির ও উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী একাদশের রাইটার পায় না। এই কারণে নবম, একাদশের ছাত্রদের রাইটার হতে দিতে চান না তাদের অভিভাবকেরাও।
সুরাহা হবে কী ভাবে?
ব্লাইন্ড পার্সন্স অ্যাসোসিয়েশনের প্রাক্তন সহ-সভাপতি অমিয় বিশ্বাস বলেন, “বিষয়টি নিয়ে আমরা অনেক বার বিভিন্ন স্কুল পর্ষদের কাছে আবেদন করেছি। কিন্তু লাভ হয়নি।”
আর্থিক অনুদান দিয়ে কি রাইটার হতে উৎসাহ দেওয়া যেতে পারে?
কৃষ্ণনগর হেলেন কেলার স্মৃতি বিদ্যামন্দিরের অধ্যক্ষ স্বপনবাবু বলেন, “মধ্যশিক্ষা পর্ষদ আগে রাইটারদের বিষয়-পিছু পাঁচ টাকা দিত। এখন সম্ভবত কিছু বেড়েছে। তাতেও বিশেষ সুফল পাওয়া যাচ্ছে না।” রাইটার বাছাইয়ে বয়ঃসীমা বা শিক্ষাগত যোগ্যতার সীমা তুলে দেওয়া হয়েছে বলে দৃষ্টিহীনদের অধিকার রক্ষায় কর্মরত একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের দাবি। ওই সংগঠনের দৃষ্টিহীন কর্মী নমিতা পাল বলেন, “রাইটার-সমস্যা নিয়ে ২০১১ সালে সুপ্রিম কোর্টে একটি মামলা হয়। তার পরিপ্রেক্ষিতেই ২০১৩ সালে কেন্দ্রের সামাজিক ন্যায় বিচার মন্ত্রক সার্কুলার দিয়ে রাইটার বাছাইয়ে বয়ঃসীমা ও যোগ্যতাসীমা তুলে দেয়।” তিনি জানান, সার্কুলারে জানানো হয়, কে রাইটার হবে, পরীক্ষার্থীই তা ঠিক করতে পারবে। রাইটার হতে হলে বয়স ও যোগ্যতা বাধা হবে না। অর্থাৎ এক জন মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী রাইটার হিসেবে একাদশ-দ্বাদশের পড়ুয়া বা অন্য কাউকে বেছে নিতে পারবে। নমিতাদেবীর অভিযোগ, “নির্দেশিকা সত্ত্বেও পরীক্ষায় এখনও পর্যন্ত তা মেনে চলা হচ্ছে না।”
সত্যিই কি বয়ঃসীমা রদ হয়েছে?
মধ্যশিক্ষা পর্ষদের প্রশাসক কল্যাণময় গঙ্গোপাধ্যায় বলেন, “রাইটারের বয়ঃসীমা তুলে দিয়ে কেন্দ্রের তরফে কোনও নির্দেশিকা দেওয়া হয়েছে কি না, আমার তা জানা নেই। যে-নিয়মে এত দিন রাইটার নিয়োগ করা হয়েছে, এখনও সেই ভাবেই নেওয়া হচ্ছে। তবে রাইটার-সমস্যাটা থেকেই গিয়েছে।” |