পেপ গুয়ার্দিওলা যে দিন বায়ার্ন মিউনিখের দায়িত্ব নিয়েছিলেন, সে দিন থেকেই মুখিয়েছিলাম নতুন কিছু দেখব বলে। বুধবার রাতে চ্যাম্পিয়ন্স লিগের শেষ ষোলোর যুদ্ধে বায়ার্ন-আর্সেনাল ম্যাচ দেখার পর সেই আশা পূরণ হয়ে গেল।
গোটা ম্যাচে অনেক মুহূর্ত। প্রথমার্ধেই এই মরসুমে ঢাক-ঢোল পিটিয়ে আর্সেনালের জার্সি পড়া মেসুত ওজিলের পেনাল্টি মিস। তার আধঘণ্টার মধ্যেই বায়ার্নের হয়ে আলাবার পাল্টা পেনাল্টি বাইরে মারা বা আর্সেনাল গোলকিপার সেজনির মার্চিং অর্ডার পাওয়া। দ্বিতীয়ার্ধে টনি ক্রুজ আর থমাস মুলারের ছবির মতো সুন্দর দুটো গোল— এ রকম দুর্দান্ত কয়েকটা মুহূর্ত তো রয়েছেই। বরং আমার নজর কাড়ল বায়ার্নের খেলায় তিকিতাকার পরিমার্জিত সংস্করণটা।
সেটা কী? বার্সেলোনায় থাকার সময় গুয়ার্দিওলা দেখিয়েছিলেন, তিকিতাকার নিখুঁত প্রয়োগ। বিগত কয়েক বছরে যা অন্ধের মতো অনুকরণ করছে ফুটবল বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলো। ফুটবল দুনিয়ার কুলীনরাও যে সেই পথ ধরেনি তা নয়। এ বার দেখলাম তিকিতাকার একটা আধুনিক সংস্করণ আস্তিন থেকে জার্মান ফুটবলের জন্য বের করেছেন পেপ। বার্সার তিকিতাকা দেখতে দেখতে অনেক সময় বিরক্তি চলে আসে। কারণ, মেসিরা বল পজেসন নিজেদের কাছে রাখতে গিয়ে খেলাটাকে স্লো করে দেয় অনেক সময়।
গুয়ার্দিওলার বায়ার্ন কিন্তু তা করছে না। বায়ার্ন পাস, পাস আর পাসের মন্ত্র মাথায় রেখেও খেলাটার গতি ধরে রাখছে টানা নব্বই মিনিট। জার্মান ফুটবলের শক্তি, গতি, শুটিংয়ের পারফেকশনটাও গুয়ার্দিওলা মিশিয়ে দিয়েছেন সুন্দর ভাবে। ঘরের মাঠে বায়ার্নের এই পাসের বৈচিত্র্যই বিধ্বস্ত করল আর্সেন ওয়েঙ্গারের আর্সেনালকে।
কেমন সেই ভয়ঙ্কর সুন্দর পাসিং ফুটবল? গোটা ম্যাচে বায়ার্নের পায়ে বল রইল সত্তর শতাংশেরও বেশি সময়। তিকিতাকার সঙ্গে খেলাটাকে নিজেদের মর্জি মতো রিমোট কন্ট্রোলে যেন সুইচ ওভার করছিল লাম, রবেন, টনি ক্রুজরা। কখনও কখনও ওভারহেড বলটাও বুদ্ধি করে তুলে দিচ্ছিল বিপক্ষের অ্যাটাকিং থার্ডে। বায়ার্নের পেনাল্টিটাও ও ভাবেই পাওয়া। অনেকেই পেনাল্টি এবং আর্সেনাল কিপারকে লাল কার্ড দেখানো নিয়ে বিতর্ক তুলেছেন। আমার মতে ইতালীয় রেফারির ওই সিদ্ধান্ত নিয়ে কোনও ভুল করেননি।
খেলাটা পুরো নব্বই মিনিট একই গতিতে হচ্ছে কেন জানেন? গুয়ার্দিওলার বায়ার্ন একাধিক পাস খেলার পর যে শেষ পাসটা খেলছে সেটা কিন্তু বিপক্ষের অ্যাটাকিং থার্ডে আছড়ে পড়ছে। ফলে খেলার গতিতে কখনই ঘাটতি হচ্ছে না। দ্বিতীয়ার্ধে টনি ক্রুজের গোলটা কিংবা শেষ বেলায় দুরন্ত হেডে মুলারের গোলটা এই পরিকল্পনারই ফসল। পাস খেলতে খেলতে ওদের থার্ড ম্যান মুভটাই দেখার মতো ব্যাপার। |
তবে আর্সেন ওয়েঙ্গার যে গুয়ার্দিওলার সঙ্গে মগজাস্ত্রের লড়াইয়ে একদম নক-আউট হয়ে গিয়েছেন, সেটা বলছি না। প্রথম দশ-পনেরো মিনিট বরং আক্রমণে ঝড় তুলে বায়ার্ন রক্ষণকে বেশ চাপেই ফেলে দিয়েছিল উইলশেয়ার, চেম্বারলেনরা। এই সময়ই ওজিলের পেনাল্টি পাওয়া। আর সেটা মিস করেই ওজিল নিজে খেলা থেকে তো হারিয়েই গেল। ম্যাচের রাশও সানোগো, ফ্ল্যামিনিদের হাত থেকে বেরিয়ে গেল। অবাক হলাম এটা দেখে যে, দ্বিতীয়ার্ধে ওজিল আর্সেনাল মিডফিল্ডে বাঁ দিক দিয়ে খেলা সত্ত্বেও ওর দিক থেকে রবেন আর পরিবর্ত হিসাবে নামা ব্রাজিলীয় রাফিনহা বারবার ঢুকে পড়ছিল! ওর কাজটা ঠিক কী সেটাই বুঝতে পারছিলাম না!
পোড় খাওয়া কোচ গুয়ার্দিওলা প্রথম দশ মিনিটেই ওজিলদের ঝড় সামলানোর ফাঁকে দেখে ফেলেছিলেন, ওয়েঙ্গারের লেফট ব্যাক লরেন্ট কসিলনি নড়বড় করছে। রক্ষণ সংগঠনেও একাধিক ভুলভ্রান্তি। ঠিক এই জায়গাটা দিয়েই পাল্টা আক্রমণের রাস্তায় হাঁটা শুরু ফিলিপ লাম, রবেনদের। আর মাঝমাঠে স্তম্ভ হয়ে উঠল টনি ক্রুজ। টিভিতেই দেখছিলাম গোটা ম্যাচে ওজিলরা খেলেছে শ’দেড়েক পাস। আর ক্রুজ একাই খেলল ১৪৪ টা পাস। শুধু তাই নয়। আর্সেনাল দ্বিতীয়ার্ধে খেলাটা কিছুটা ধরলেও ক্রুজের জন্যই কিন্তু এক সঙ্গে চারটের বেশি পাস কখনই খেলতে পারেনি বায়ার্ন মিডল থার্ডে। বল কাড়ার জন্যও ঠিক হাজির হয়ে যাচ্ছিল ও। আর বলটা কেড়েই দশ জনের আর্সেনাল রক্ষণকে লম্বা ডায়াগনাল পাস দিয়ে অস্বস্তি বাড়িয়ে দিচ্ছিল ক্রুজ।
এখন প্রশ্ন, অ্যাওয়ে ম্যাচে দু’গোলে এগিয়ে থাকায় শেষ আটে যাওয়ার ব্যাপারে গুয়ার্দিওলার দল কতটা এগিয়ে। অনেকেই এক্ষেত্রে বায়ার্নকে এগিয়ে রাখছেন। আমি কিন্তু কোনও ভবিষ্যদ্বাণী করব না। কারণ, বিপক্ষ কোচটার নাম আর্সেন ওয়েঙ্গার। তাঁর মতো পোড়খাওয়া, অভিজ্ঞ কোচকে আগেভাগে পিছিয়ে রাখলে পরে সেটা মূর্খামিতে দাঁড়াতে পারে। গত বার কিন্তু ঘরের মাঠে দু’গোলে পিছিয়ে থেকেও বায়ার্নের মাঠে গিয়ে অ্যাওয়ে ম্যাচটা ২-০ জিতেছিলেন তিনি। যদিও শেষ পর্যন্ত গোল পার্থক্যে ছিটকে যায় আর্সেনাল।
এ বার অ্যাওয়ে ম্যাচে আর্সেন ওয়েঙ্গার বায়ার্নের এই নতুন তিকিতাকার প্রতিষেধক বের করতে পারেন কি না, তা দেখার অপেক্ষায় রইলাম। |