বৃহস্পতিবার শাহরুখ খানের বাড়ি মন্নতের ঠিক সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন এক ভক্ত। কোন্নগর থেকে এসেছিলেন মুম্বই ঘুরতে। কিন্তু বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করেও দেখা মিলল না মহাতারকার। চলে যাওয়ার সময় নিরাশ গলায় বললেন, “বাড়িটা দেখাই বা কম কী! তবে একটা দুঃখ রয়ে গেল। এ বার কেকেআর দলে কেন যে লক্ষ্মী, শামি আর মনোজকে রাখলেন না শাখরুখ!” কোন্নগরের সেই ফ্যান জানতে পারলেন না যে, মন্নত থেকে ঠিক দু’পা দূরের এক হোটেলে বসে তাঁর এই আক্ষেপ নিয়েই বৃহস্পতিবার দুপুরে প্রথম মুখ খুললেন কেকেআর মালিক। আগামী সোমবার ডিসকভারি চ্যানেলে শুরু হচ্ছে তথ্যচিত্র‘লিভিং উইথ কেকেআর’। কেকেআর-এর উত্থানের গল্প। সাংবাদিকদের সঙ্গে বসে যার ক্লিপিংস দেখতে দেখতে শাহরুখ জানালেন, নানা ওঠা-পড়া পেরিয়ে নাইটদের এই পথচলা দেখতে দেখতে তাঁর চোখে নাকি জল এসে যায়, আজও দল নিয়ে এতটাই আবেগপ্রবণ! জানালেন, ফুটবলেও সুযোগ পেলে কলকাতার ফ্র্যাঞ্চাইজি কিনতে আগ্রহী। আর হ্যাঁ, কোনও দিনও কেকেআর বিক্রি করে দেবেন না।
|
প্রশ্ন: কেকেআর-এর নতুন দল হওয়ার পরে মনোজ বা লক্ষ্মীর সঙ্গে আপনার কথা হয়েছে?
শাহরুখ: না হয়নি। আরে আমি এই ডকুমেন্টারি দেখেই এত আবেগপ্রবণ হয়ে পড়লাম... কত কথা মনে পড়ছে। মনোজ, লক্ষ্মী, শামি ওদের মিস করি। চাই ওরা যেন আমাদের ম্যাচগুলো দেখতে আসে।
প্র: কেকেআরের এ বারের দল যা হয়েছে, তাতে আপনি খুশি?
শাহরুখ: আমার মনে হয়, দলটাকে আমরা যে ভাবে সাজাতে চেয়েছিলাম তার নব্বই ভাগ পেরেছি। কয়েক জন দারুণ ক্রিকেট-মস্তিষ্ক রয়েছে আমাদের। নেতৃত্বে গৌতম গম্ভীরের মতো অভিজ্ঞ তারকা। ওয়াসিম আক্রম, ট্রেভর বেলিসের মতো কোচ। আমাদের পরিকল্পনাটাই ছিল, দলে প্রথমে ভারতীয় প্লেয়ারদের নিয়ে ব্যাক আপ হিসাবে বিদেশি প্লেয়ার নেওয়া। পুণের দু’জনকে চেয়েছিলাম আমরা। যুবরাজ আর রবিন উথাপ্পা। কিন্তু যুবরাজের জন্য অনেক দূর লড়েও ওকে পাওয়া গেল না। বিদেশিদের মধ্যে যে তিন জনকে চেয়েছিলাম, পাওয়া গিয়েছে। নিলাম আসলে খুব জটিল ব্যাপার। আমরা তাই একটা বিশেষ সফ্টওয়্যারের সাহায্য নিয়েছি। তবে যে কোনও নিলামেই আপনি যা ভাববেন তার দশ-বিশ ভাগ এদিক-ওদিক হয়। সব মিলিয়ে যা টিম হয়েছে, তাতে আমরা খুশি।
দেখবেন, এই দলটার মধ্যে কলকাতার জন্য আবেগের অভাব হবে না। কারণ আমরা দলটাকে ভালবাসি, কলকাতাকে ভালবাসি। অনেক সময়েই কোনও একটা পক্ষ নেওয়া সহজ হয় না। যে প্লেয়ারদের আমরা এত ভালবাসি তাদের ছাড়তে মন চায় না। মনে হয়, চলুক বা না চলুক, একে রেখে দাও। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আবেগ আর পেশাদারিত্বের মধ্যে একটা ভারসাম্য তো রাখতেই হয়! আমি সৃজনশীল মানুষ, ঠিক পেশাদার নই। তাই দলের পেশাদার দিকটা দেখার জন্য বেঙ্কি আছে।
প্র: তা হলে কি লক্ষ্মী-মনোজ-শামিদের না নেওয়াটা সুপরিকল্পিত স্ট্র্যাটেজির অংশ? কলকাতায় অনেকে...
শাহরুখ: ঠিক তা নয়। কেকেআর-এর সাফল্যে লক্ষ্মী-মনোজ-শামিদের বড় ভূমিকা ছিল। আমরা ওদের ভালবাসি। কিন্তু ওই যে বললাম না, নিলামে আবেগ আর পেশাদারিত্বের মধ্যে একটাকে বাছতেই হয়। মনে রাখবেন, কেকেআর-এ ছিল বলেই কিন্তু এ বছর নিলামে ওদের চড়া দাম উঠেছে। ওদের জন্য শুভেচ্ছা রইল। আশা করি যখনই সময় পাবে, ওরা আমাদের খেলা দেখতে আসবে। প্রতিপক্ষ হিসাবে ওরা যখন কলকাতায় আসবে, জোর দিয়ে বলতে পারি আমরা একসঙ্গে বসে আড্ডাও দেব।
আসলে মনোজকে যখন দিল্লি তুলে নিল, তার পর লক্ষ্মীকেও, বেঙ্কি আমাকে সঙ্গে সঙ্গে ফোন করে। বলে, স্যর দাম কিন্তু বেড়ে যাচ্ছে। আমাদের আরও কম দামে ভারতীয় প্লেয়ার নিতে হবে। যাতে অন্য প্লেয়ার কেনার টাকা হাতে থাকে। লক্ষ্মীরা আমার খুব কাছের বলেই ওদের ছাড়তে খুব কষ্ট হয়েছে। কিন্তু দলে যারা এসেছে তারাও ভাল প্লেয়ার। কয়েকজন প্রতিভাবান তরুণ আছে। বাংলার দেবব্রত দাস আছে। সায়নশেখর মণ্ডল আর বীর প্রতাপ সিংহও বাংলার প্লেয়ার। এদেরও আমরা ট্রেনিং দিয়ে বাংলার গর্ব করে তুলব। মনোজের ম্যাচ জেতানো রান, লক্ষ্মীর সেমিফাইনালের পারফরম্যান্স, কিছুই ভুলিনি। ওরা অসাধারণ। আমাদের তো ম্যাকালামকেও ছেড়ে দিতে হয়েছে। বিসলাও প্রায় হাতছাড়া হয়ে গিয়েছিল। শেষ মুহূর্তে ধরে রাখতে সফল হই। যত জনকে পেরেছি রেখেছি। কিন্তু দল গড়াটা সব দিক বিবেচনা করে নেওয়া পেশাদারি সিদ্ধান্ত। শুধু বাংলার কথা ভাবা নয়।
প্র: ফিল্ম তৈরি না আইপিএল জেতা? কোনটা বেশি তৃপ্তি দেয়?
শাহরুখ: নিজের ফ্লপ ছবিগুলোর অভিজ্ঞতা কখনও শোনাই না। শোনালে বুঝতেন, সেগুলোই গল্প হিসাবে অনেক বেশি আকর্ষণীয়। একটা ফিল্ম তৈরি করা অবশ্যই বেশি কঠিন। কারণ অভিনেতা হিসাবে ওটাই আমার রুজি-রুটি। আবার আমি অভিনেতা বলেই কেকেআর পরিচালনার কাজটা আমার জন্য দ্বিগুণ কঠিন। মনের দিক থেকে আমি একজন স্পোর্টসম্যান। কিন্তু যেখানে আমার প্রতিটা ক্রিকেটীয় সিদ্ধান্তকে অনুবীক্ষণ যন্ত্রে ফেলে কাটাছেঁড়া চলছে, সেখানে দাঁড়িয়ে থাকা সহজ নয়। এমন অনেক কিছু ঘটে, যার উপর আমার কোনও নিয়ন্ত্রণ নেই। কিন্তু লোকে আমার কাছেই উত্তর চায়। অনেক অস্বস্তিকর প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়। দল সংক্রান্ত প্রতিটা সিদ্ধান্ত নিয়ে সমালোচনা হয়। এমনও শুনেছি যে, আমি নাকি ক্রিকেটীয় যুক্তি-ই ধ্বংস করে দিয়েছি! কিন্তু তা সত্ত্বেও বলব, আমাদের আইপিএল জেতার কথা উঠলে যে ছবিটা মানুষের মনে প্রথমেই ভাসে সেটা কিন্তু গৌতম গম্ভীরের অসাধারণ ক্যাপ্টেনসি নয় (যদিও সেটাই হওয়া উচিত)। সেটা, জেতার পর আমার মেয়েকে কোলে তুলে নেওয়ার ছবি।
প্র: কেকেআর নিয়ে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?
শাহরুখ: ভবিষ্যতে দলটাকে আরও শক্তিশালী করতে চাই। আরও আবেগতাড়িত। কারণ এই দলটাই আমার শক্তি আর আবেগের উৎস। আমি মানে আমাদের গোটা টিম। ট্রফি জেতা তো ঘাড় থেকে একটা বোঝা নামার মতো ব্যাপার। এই যেমন চেন্নাই এক্সপ্রেসহো গয়া না দো শো করোড়! আর চাই এমন একটা জায়গা গড়তে যা এ দেশের তরুণদের খেলাধুলোয় উৎকর্ষে পৌঁছনোর প্রেরণা দেবে। এমন কিছু করতে চাই যাতে ছোটরা খেলাধুলোয় আসার কথা ভাবে।
প্র: এই তথ্যচিত্রের মাধ্যমে তরুণদের কাছে কী বার্তা পৌঁছে দিতে চান?
শাহরুখ: আমার জন্য এটা অসম্ভব আবেগপূর্ণ সফর। কিন্তু একটা বিন্দুতে পৌঁছনোর পর আবেগগুলো ঝেড়ে ফেলে জয়ের জন্য ঝাঁপাতে শিখতেই হয়। জিততে না পারলে কেউ কিন্তু আপনাকে নিয়ে তথ্যচিত্র তৈরি করবে না! শুধু প্রার্থনায় হয় না, কঠিন পরিশ্রম লাগে। কারচুপি করে জেতা যায় না, তার জন্য অসম্ভব খাটতে হবে। আর আবেগের মাত্রা কমিয়ে মানসিক ভাবে মজবুত হয়ে উঠতে হবে।
প্র: খেলায় কুসংস্কার মানেন?
শাহরুখ: একেবারেই না। আপনারা জানেন জুহি আর আমার মধ্যে যে সিদ্ধান্তটা নিয়ে সবচেয়ে বেশি মতবিরোধ হয়েছিল, সেটা দলের জার্সি কালো হবে না বেগুনি। আইপিএল জেতার পরে জুহিকে ফোন করে বলি, জিতে তো গিয়েছি, এ বার জার্সিটা আবার কালো করে ফেলি? কত কথা শুনেছি! নাইটদের লোগোয় আগুনটা নাকি অশুভ, সব জ্বালিয়ে ছারখার করে দিচ্ছে। কিন্তু আমি এ সব কুসংস্কার মানি না। তবে হ্যাঁ, আমার টিম ব্যাট করার সময় প্রথম আধ ঘণ্টা খেলা দেখি না। যতই ভাল অভিনেতা হই না কেন, ওই প্রথম আধ ঘণ্টা ব্যাটিং দেখার টেনশন লুকিয়ে মুখে হাসি টেনে বসে থাকতে পারি না। প্রথম সাত ওভার কেটে যাওয়ার পরেই স্টেডিয়ামে ঢুকি।
প্র: ওয়াংখেড়ের ঘটনাটা তো তথ্যচিত্রে নেই!
শাহরুখ: তথ্যচিত্রটা আমি তৈরি করিনি। বিষয়বস্তু কী কী থাকবে সেটাও ঠিক করে দিইনি। এক নির্বোধ বাদে ঘটনাটা আর কেউ ক্যামেরায় তুলেও রাখেনি। তা ছাড়া কেকেআর মানে শুধু আমি নই। কেকেআর-এর নিজস্ব একটা সত্ত্বা আছে, ব্যক্তিত্ব আছে। তবে ওয়াংখেড়ের ঘটনাটা তথ্যচিত্রে থাকলেও আপত্তি করতাম না। আমাকে নিয়ে আজ পর্যন্ত পাঁচ-ছ’টা বই লেখা হয়েছে। আর যা লেখা হয়েছে তার সবটা তারিফ করে নয়। কিন্তু ঠিক আছে!
প্র: আপনি কি আর ওয়াংখেড়েতে যাবেন?
শাহরুখ: আমার পঞ্চাশ ইঞ্চি স্ক্রিনের টিভি জিন্দাবাদ! আমি তাতেই খুশি। এটাকে কিন্তু ইগো বা দম্ভ নয়।
প্র: কেকেআর-কে ক্রিকেটের বাইরেও ছড়িয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা আছে?
শাহরুখ: ফুটবল লিগে টিম করতে পারলে দারুণ হবে। কয়েকটা গোষ্ঠীর সঙ্গে কথা চলছে। হয়তো অম্বানীদের পাশে পাওয়া যাবে। আমি কলকাতার জন্য দল করতে চাই। ফুটবল নিয়ে কিছু করতে হলে কলকাতাই আসল জায়গা। তবে বিষয়টা এই মুর্হূতে স্রেফ চিন্তাভাবনার পর্যায়ে।
প্র: আপনি কি কখনও কেকেআর বিক্রি করে দেওয়ার কথা ভাবেন?
শাহরুখ: নেভার! কখনও না। এই দলটা আমি কোনও দিনও বিক্রি করব না। আর্থিক লাভের জন্য নয়। অন্য কোনও কারণেও নয়। কথাগুলো জয় আর জুহির হয়েও বলছি। আমাদের জন্য কেকেআর একটা অন্য আবেগ। কত সমালোচনা হজম করতে হয়, দোষারোপ চলে। সৌরভকে যখন ছেড়ে দিতে হল, তখন তো কলকাতায় আমাদের কুশপুতুল পর্যন্ত পোড়ানো হয়েছিল। কিন্তু এক মুহূর্তের জন্যও টিম বেচে দেওয়া কথা মনে আসেনি। কেকেআর আমাদের চিরকালের কমিটমেন্ট। আর চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর তো আরও বেশি করে। |