প্রবন্ধ...
বাংলার বাইরে বাংলার খোঁজে কয়েক দিন
শীতের ঝলমলে শিলং। জানুয়ারি মাসের শুরু। পুলিশ বাজারে খাসি ট্যাক্সি স্ট্যান্ডের কাছে দাঁড়িয়ে আছি। চোখে পড়ল ব্রাহ্মসমাজের উনিশ শতকীয় বাড়ি। জৌলুসহীন, পরিত্যক্ত। বাঙালিয়ানার হারানো চিহ্ন যেন তার শরীরে। যে শিলং পাহাড়ে ছুটি কাটাতে আসতেন রবীন্দ্রনাথ, সেই শহর শিলঙে বাঙালির সে কাল যে আর নেই। মেঘালয়ের পথে পথে স্বাধীন ভারতের ইতিহাস অন্য অভিমুখে এগিয়েছে। স্থানীয় জনজাতির মানুষেরা ইংরেজ আমলে অন্য প্রদেশ থেকে এখানে চলে আসা ভদ্রলোকদের তখন যে ভাবে বিচার করে দেখতেন, এখন আর সে ভাবে বিচার করেন না। বহিরাগতরা এসে উৎপাতের মতো দখল করেছিল তাঁদের আলয়— এই ‘অভিমান’, না কি ‘রাগ’, কাজ করে। শুধু বাঙালি কেন, ‘ভদ্রলোক অহমিয়া’দের প্রতিও কি মেঘালয়বাসীর মনে চাপা বিরূপতা নেই!
ইংরেজ উপনিবেশ তখন জমে উঠেছে। বাঙালি ভদ্রলোকরা ভারতের নানা ‘প্রভিন্স’-এ ছড়িয়ে পড়ছেন। তাঁদের ধর্ম আর সংস্কৃতির নিশান পুঁতে দিচ্ছেন অন্য প্রদেশের মাটিতে। ইংরেজি ভাল করে শিখেছিলেন তাঁরা। সাহেবদের সঙ্গে সম্পর্ক ভাল, তাই চাকরিবাকরিও দখল করছেন। তারই ফল বাংলা ভাষা আর সংস্কৃতির বিস্তার। এই বাঙালিরা অনেক সময় স্থানীয় মানুষদের খাটো চোখে দেখতেন, এ তো সত্য কথা। ইতিহাস তার সাক্ষ্য দিচ্ছে। ভদ্রলোক বাঙালি এক সময় ‘ওড়িয়া’ ‘অহমিয়া’দের ভাষাকে মর্যাদা দেননি। উত্তর পূর্বের নানা জনজাতির মানুষ ‘অসম্মানিত’ হয়েছেন। আবার ‘ওড়িয়া’ ‘অহমিয়া’দের মধ্যে ইংরেজি শিক্ষিত ভদ্রলোক শ্রেণি গড়ে উঠে বাঙালি ভদ্রলোকদের এই ‘দাদাগিরি’র বিরোধিতা করেছেন। বাঙালি ভদ্রলোকদের সঙ্গে নানা জনজাতির মানুষের যে দূরত্বের সম্পর্ক ছিল, অহমিয়া ভদ্রলোকদের সঙ্গেও মেঘালয়ের জনজাতির মানুষদের সেই দূরত্বের সম্পর্ক তৈরি হয়েছে এক সময়ে। মনে হয় ব্রিটিশরা আমাদের যে ভাবে ‘ভদ্রলোক’ হতে শিখিয়েছিল বা আমরা যে ভাবে নানা ভাষাগোষ্ঠীর মানুষেরা নানা সময়ে ‘ভদ্রলোক’ হতে শিখেছিলাম তার মধ্যে কোথাও ত্রুটি ছিল। নানা ভাষা আর জাতির দেশ ভারতবর্ষে যাঁরা যখন ভদ্রলোক হয়ে উঠছেন তাঁরা তখনই না-ভদ্রলোকদের ভাষা-সংস্কৃতিকে অনুকম্পার চোখে দেখছেন, অনেক সময় নিজেদের ভাষা এই না-ভদ্রলোকদের ওপর চাপিয়ে দিচ্ছেন। সমস্যার সূত্রপাত সেখান থেকেই।

আ মরি মাতৃভাষা। তবে ‘অন্য’দের ভাষার প্রতি সম্মান করতেও
শেখাক মাতৃভাষাদিবস। বর্ধমান, ২১ ফেব্রুয়ারি, ২০১৩।
কিন্তু পুরোটাই কি সেই ইতিহাস, একমেটে একরঙা? আর কোনও বর্ণ নেই, বার্তা নেই? শুধুই বিচ্ছেদ, মিলনের কোনও প্রসঙ্গ নেই! মন দিয়ে দেখলে চোখে পড়ে উনিশ শতকের পুরনো হতশ্রী বাড়ির পাশেই নতুন গড়ে ওঠা ঘরদুয়ার। একটা ঘর আবার ‘রবীন্দ্র স্মৃতি গ্রন্থাগার’ নামে চিহ্নিত। কৌতূহলী মন ও শরীর পায়ে পায়ে এগিয়ে যায়। পাঠাগারের দরজা টানা, তবে তালা নেই। লোকজন চোখে পড়ছে না অবশ্য। ইংরেজিতে ফুকরে উঠি, ‘ইজ এনিবডি দেয়ার?’ মনে মনে বলি, ‘ডাজ এনিবডি কেয়ার?’ জবাব না পেয়ে দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকি। লম্বা টানা ঘর। সাজানো বই। পুরনো, নতুন। বাংলা ইংরেজি। মোটামুটি ’৯৩-৯৪ পর্যন্ত নিয়মিত বাংলা বই কেনা হয়েছে এখানে। অধিকাংশ বাংলা বইয়ের ওপর রাবার স্ট্যাম্প ‘চপলা সাহিত্য সদন’। অবশেষে দুজন এলেন। আমাকে দেখে তাঁরা অবাক। কথায় কথায় জানতে পারি ওঁদের একজন বাঙালি। সৌরভ দেব। দেবেরা শিলঙে অনেক দিনের বাসিন্দা। তিনি বললেন, শিলঙে বাঙালিদের সেই দিন আর ফেরার নয়। ভাঙা পুরনো বাড়ি, নতুন বাড়িতে বন্ধ পাঠাগার।
পর দিন খুঁজে-পেতে ‘চপলা সাহিত্য সদন’। জেল রোডে এ দোকানের পত্তন ১৯৩৬-এ। বই ব্যবসার সূত্রপাত বিভুভূষণ চোধুরীর হাতে। বিভুভূষণ পড়াশোনায় ভাল, কবিতাও লিখতেন। এখন দোকান দেখেন বিভুভূষণের ভাইপো বুদ্ধদেব চৌধুরী। দোকানের এক দিকের তাকে কিছু বাংলা বই। খোঁজখবর করতে বিভুভূষণের কবিতার বই ‘ভারতবর্ষ’ এগিয়ে দিলেন। এ বই যখন ছাপা হয়েছিল, শিলং তখন আসামের অংশ, মেঘালয় রাজ্য গড়ে ওঠেনি। বিভুভূষণ অবশ্য কেবল বাংলা বই ছাপতেন না, অহমিয়া ভাষায় বাঙালির বঙ্কিম-শরৎকে অনুবাদ করে ছাপতেন। চপলা সাহিত্য সংসদ মৌলিক অহমিয়া বইও প্রকাশ করত। বিভুভূষণ খাসি ভাষা জানতেন। চপলা খাসি সংস্কৃতি, আইন নিয়েও বই বের করেছে। ভারতবর্ষ যে নানা ভাষার দেশ, একপেশে ভাবে বাংলা ভাষার দাবি তোলা উচিত নয় সে কাণ্ডজ্ঞান চৌধুরীমশাইয়ের ছিল। তাঁর ‘ভারতবর্ষ’ কবিতার বইয়ের ‘একটি গৃহের কাহিনী’তে চোখ আটকে গেল।
কত ছাঁচে গড়া দেহ
বিচিত্র এ মানব গোষ্ঠীর
কত রকমারি রূপ
করোটি, নাসিকা, চক্ষু, চোয়াল-অস্থি-র।
কত ভাষা বলে ওরা
’।
বিভুভূষণ সবার মাতৃভাষার অধিকারের পক্ষে, এক ভারতীয় ভাষার সঙ্গে অন্য ভারতীয় ভাষার বন্ধুতার পক্ষে। ইংরেজ আমলে ভদ্রলোক বাঙালিদের মধ্যে অনেকেই অন্য প্রাদেশিক ভাষাগুলিকে গুরুত্ব দিতে চাননি। বিভুভূষণ আর তাঁর চপলা সে গোত্রের নয়। তবু বিভুভূষণের প্রয়াণের পর চপলা এখন ক্ষীণপ্রাণ, অস্তিত্বের সংকটে ভুগছে। ধীর পায়ে চপলা থেকে ফিরি। এ বার লক্ষ্য আফজল হোসেন।
রবীন্দ্র স্মৃতি গ্রন্থাগারে সৌরভ দেব বলেছিলেন আফজল হোসেনের কথা। নিজে থেকেই আফজল হোসেনের সঙ্গে আলাপও করিয়ে দিয়েছিলেন। শিলঙের বাঙালি সংস্কৃতির উত্থানপতন বুঝতে গেলে নাকি আফজল হোসেনের সঙ্গে কথা বলতে হবেই। শীত-সন্ধে। ঘরে অনুচ্চ আলো। দেওয়ালে আফজলের হোসেনের পূর্বপুরুষেরা, এখন ছবি। সুরেলা অমায়িক গলায় আফজল বললেন, তাঁদের আদি বাড়ি জনাইতে, হুগলির জনাই। সেখান থেকে ব্যবসাসূত্রে শিলঙে আসা। গোলাম হায়দার, তাঁর পুত্র হাজি কশিমুদ্দিন মোল্লা, তাঁর পুত্র আবার মওলা বক্স। এই বাঙালি মুসলমানরা উদ্যমী উদ্যোগী। আসাম থেকে যে রাস্তা উঠে এসেছে শিলং পাহাড়ে, সেই রাস্তায় মোটর সার্ভিস চালু করেছিলেন। ছিল টাঙা, ডিপার্টমেন্টাল স্টোর, কন্ট্রাকটরি। কে বলে বাঙালির ব্যবসা হয় না! আফজলদা বলেন, ভাই আপনি হিন্দুর ঘরে জন্মেছেন, আমি মুসলমানের ঘরে। এতে তো আমাদের হাত নেই। তা বলে বিরোধ থাকবে কেন? ছিলও না। আমি শিলং রেডিয়োতে নাটকে রামকৃষ্ণের ভূমিকা নিয়েছিলাম। বাঙালি আর খাসিরা তো পাশাপাশিই থাকত। সব পরে কেমন হয়ে গেল। দুজনেই চুপ করে থাকি। আফজল হোসেন শিলঙে বাঙালি সংস্কৃতির চেহারা কী ছিল, বাঙালিদের ভূমিকা এই শহরে কী ছিল তা নিয়ে বই লিখেছিলেন। এনে দিলেন। আস্তে আস্তে বাইরে আসি। উল্টো দিকে ওয়ার্ডস লেক। তার গা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে হোটেলে ফিরি। শিলং ক্লাব হোটেলের হাসিখুশি খাসি রিসেপশনিস্ট ভদ্রলোক জিজ্ঞাসা করেন, ‘ডিড ইউ ফাইন্ড চপলা?’
মেঘালয়ের শিলং থেকে আসামের গুয়াহাটির পথ ধূলিধূসর। রাস্তা বড় হচ্ছে টুরিস্টদের জন্য। নামতে নামতে মনে হয়, এই যে নানা ভাষার দেশে এক ভাষা সংস্কৃতির প্রতি অন্য সংস্কৃতির বিরাগ এ তোমার আমার পাপ। গুয়াহাটি স্টেশনে এলেন নাইন্থ কলামের প্রসূন বর্মন। তাঁর সঙ্গে কথায় টের পাই, ওপরে আমি দেখে এলাম ব্রিটিশ আমলের ইতিহাসের চেহারা— বাঙালি ভদ্রলোকদের ওঠা-পড়া। বাঙালির আর এক ইতিহাস দেশভাগের দেশত্যাগের। উত্তর পূর্ব ভারতের নানা অংশে দেশভাগ পরবর্তী ছিন্নমূল বাঙালিরা ছড়িয়ে রয়েছেন। তাঁরা সে কালের বাঙালি ভদ্রলোকদের মতো সুবিধে প্রাপ্ত নন। প্রসূন এই ছিন্নমূল বাঙালির লেখা গদ্য পদ্যের বই দেন। দেন আধুনিক অহমিয়া কবিদের মধ্যে অগ্রগণ্য সমীর তাঁতির কবিতার বাংলা অনুবাদ। সমীর জন্মেছেন স্বাধীনতার পরে ১৯৫৬ সালে। লিখেছেন,
কোনও একটি শহরও আমার শহর নয়
তবু তোমার মতন প্রতিটি শহরকেই ভালোবাসি
’।
কথা থামাই। পশ্চিমবঙ্গে ফেরার সময় হল। যোরহাটে জগন্নাথ বরুয়া কলেজে পড়ান, বন্ধু শালিম আলি আহমেদ। বললেন, ‘জানো আমরা আশির দশকে খুব মন দিয়ে ভাস্কর পড়তাম। অ্যাডভেঞ্চার— কিশোরদের মন ভরানো এই কাহিনি যিনি লিখতেন তিনি বাঙালি। রবিন দে। বাঙালিদের খেদানোর সময় তিনি এখান থেকে বাধ্য হয়ে চলে যান। তাঁর উত্তরপুরুষেরা কলকাতায় থাকবেন। একটু খোঁজ নেবে? আমরা তাঁর লেখার মূল্যায়ন করতে চাই।’
যোরহাট বিমানবন্দরে নিরাপত্তা রক্ষীরা আমাদের নানা ভাবে মাপেন। রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা ভাষাদাঙ্গায়, জাতিদাঙ্গায় যেন বিঘ্নিত না হয়। অথচ স্বাধীনতার এত দিন পরে আমরা নানা ভাষার মানুষেরা তো অনেকেই ভারতের প্রতিটি শহরকেই ভালবাসতে চাই, আমার শহর বলে দাবি করে অন্যদের গলা ধাক্কা দিতে চাই না। এও তো প্রজাতন্ত্রের আর এক ইতিহাস।

বিশ্বভারতীতে বাংলার শিক্ষক


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.