তেহরিক-ই-তালিবান পাকিস্তান-এর সহিত নওয়াজ শরিফ সরকারের আনুষ্ঠানিক আলোচনা শুরু হইয়াছে। ঘোষিত লক্ষ্য: পাক তালিবানকে জেহাদি সন্ত্রাসের পথ পরিহার করাইয়া গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় শামিল করা। তালিবান নেতৃত্বও শান্তি-প্রক্রিয়ার পূর্বশর্ত হিসাবে অচিরে যাবতীয় সংঘর্ষ-বিরতির দাবি মানিয়া লয়। কিন্তু তাহার পরই ২০১০ সালে অপহৃত তেইশ জন পাক জওয়ানকে হত্যা করার তালিবানি ঘোষণা শান্তি-প্রক্রিয়ার ভবিষ্যৎকে অনিশ্চিত করিয়াছে। তালিবান কমান্ডার ওমর খালিদ খোরাসানি জানাইয়াছেন, পাক হেফাজতে তালিবান যোদ্ধাদের মৃত্যুর বদলা লইতেই এই কাজ। প্রতিহিংসার এই রাজনীতি অনুশীলন করিতে থাকিলে আলোচনার প্রক্রিয়ায় যোগদান করিয়া কী লাভ? স্বভাবতই ইসলামাবাদের তরফে আলোচনা চালাইতে ভারপ্রাপ্তরা পরবর্তী পদক্ষেপ করিতে দ্বিধাগ্রস্ত। তালিবানের সন্ত্রাস পাক জনজীবন ও সমাজকে যে-রূপ উত্ত্যক্ত করিয়া তুলিয়াছে, আইনের শাসন কায়েমে দায়বদ্ধ যে-কোনও সরকারেরই তাহা শিরঃপীড়া। তাহাদের নিয়ন্ত্রণ করিতে না পারিলে পাকিস্তানে গণতন্ত্রও বিপন্ন। অংশত সে জন্যই নওয়াজ শরিফ পাক তালিবানের সহিত রফায় বিশেষ আগ্রহী।
আফগানিস্তানের প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাই-ও বুঝিয়াছেন, এ বছর মার্কিন-বহুজাতিক বাহিনী ঘরে ফেরার পর আফগান রাজনীতিতে প্রাসঙ্গিক থাকিতে হইলে তাঁহাকে আফগান তালিবানের সহায়তা লইতেই হইবে। তাই তিনিও তালিবান কমান্ডারদের সহিত আলোচনার প্রক্রিয়া শুরু করিতে ব্যগ্র। তালিবানের অতএব এখন পৌষ মাস। নিজেদের শর্তে ওয়াশিংটনের পাশাপাশি এখন কাবুল সরকারের সহিত আলোচনাতেও তাহার আপত্তি নাই। তবে তালিবান সহসা হিংসা, সন্ত্রাস ও সশস্ত্র হামলার প্রতি বিরাগ ব্যক্ত করিতেছিল কেন, তাহা লইয়া সংশয় ছিলই। পাকিস্তানে বৈঠক চলার সময়েও একের পর এক যে সব সন্ত্রাসী হামলা ঘটিতেছে, সেগুলি তো তালিবানেরই অপকর্ম। পাক শাসকরা তথাপি নিরুপায়। তাঁহারা জানেন, মার্কিন বাহিনী ফিরিবার পর আফগানিস্তানে পাক প্রভাব ও নিয়ন্ত্রণ কায়েম করার একমাত্র মাধ্যম তেহরিক-ই-তালিবান-পাকিস্তান।
এই পরিস্থিতিতে ভারত রীতিমত অসুবিধায়। তালিবানকে বাদ দিয়া আফগানিস্তানে কোনও রাজনৈতিক সমীকরণ হইবে না, ইহা উত্তরোত্তর স্পষ্ট। অথচ নয়াদিল্লি ও তালিবানের পারস্পরিক বিরাগের ইতিহাস স্মরণে রাখিয়া কারজাইকেই সমর্থনের সিদ্ধান্ত লইয়াছে নয়াদিল্লি। কান্দাহারে দাঁড়াইয়া বিদেশমন্ত্রী সেই সমর্থন নূতন করিয়া ঘোষণা করিয়াছেন। গৃহযুদ্ধ-বিধ্বস্ত আফগানিস্তানের পরিকাঠামো, রাস্তা-ঘাট, রেলপথ, হাসপাতাল কিংবা কলেজ নির্মাণে ভারত যে-সহযোগিতা করিয়াছে, তালিবান কাবুলে ক্ষমতায় ফিরিলে তাহা অবান্তর হইয়া পড়িবে। প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাই এখন যতই নয়াদিল্লির প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করুন, নিজের গদি, নিদেনপক্ষে গর্দান বাঁচাইতে তিনিও যে তালিবানের তালেই তাল দিবেন, তাহা নিশ্চিত। অন্য কিছু করার অবকাশও তাঁহার থাকিবে না। ভারতের পক্ষে তালিবানের জেহাদি মতাদর্শ ও কর্মসূচি সমর্থন করারও প্রশ্ন নাই, তাই তালিবান-নিয়ন্ত্রিত কাবুলের সহিত তাহার বৈরিতা চলিবেই। কাশ্মীর-বিতর্ক ও তাহা মীমাংসার তালিবানি দাওয়াই লইয়াও সমূহ বিপত্তির আশঙ্কা। এই প্রেক্ষিতে উপমহাদেশের অস্থিরতা ক্রমশ বাড়িবারই সম্ভাবনা। |