দেশের প্রধানমন্ত্রীর ঘাতকরাই যদি মুক্তি পায়, তবে আম আদমি এই দেশে ন্যায়বিচারের প্রত্যাশা করিতে পারে কি? —সুপ্রিম কোর্টের স্থগিতাদেশের ফলে যদিও রাজীব গাঁধী হত্যাকাণ্ডের সাত অপরাধী এখনই মুক্তি পাইতেছে না, তবু রাহুল গাঁধীর প্রশ্নটি হারাইয়া যায় না। বরং, আশ্চর্য ভাবে, প্রশ্নটি তাঁহাদের দিকেই ধাবিয়া আসে। প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত চার আসামি প্রাণভিক্ষার আবেদন করিবার পর যে এগারো বৎসর কাটিয়া গিয়াছে, তাহার মধ্যে দশ বৎসর কেন্দ্রে ইউপিএ সরকার ক্ষমতাসীন ছিল। এই দশ বৎসরে আবেদনগুলির নিষ্পত্তি করিবার সময় হইল না কেন? বিষয়টির গুরুত্ব যদি থাকেই, তবে এত দিন বিলম্বের হেতুটি ঠিক কী? দীর্ঘসূত্রিতাই ইউপিএ-র অভিজ্ঞান, বহু বার প্রমাণিত। আর পাঁচটি প্রশ্নের ন্যায় রাজীব-আততায়ীদের মৃত্যুদণ্ডের প্রশ্নটিও তাহা প্রমাণ করিতেছে। এই বিলম্বের কারণেই সুপ্রিম কোর্ট যখন মৃত্যুদণ্ড মকুব করিয়া দিল এবং জয়ললিতা সাত আসামিকে মুক্তি দেওয়ার সিদ্ধান্ত করিলেন, তখন ‘বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে’ বলিয়া বিলাপের অর্থ কী? জাতীয় মঞ্চে এই কুনাট্যের পিছনে সর্বাপেক্ষা বড় দায় ইউপিএ-রই। রাজীব গাঁধীর আততায়ীদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করিবার সিদ্ধান্তটিও তাহারা ঠিক সময়ে লইতে পারে নাই।
প্রশ্ন আরও। দেশের সর্বোচ্চ আদালত অপরাধীদের মৃত্যুদণ্ড মকূব করিয়াছে। সুপ্রিম কোর্টের প্রতি সম্পূর্ণ শ্রদ্ধা বজায় রাখিয়াও মৃত্যুদণ্ড মকুব করিবার সিদ্ধান্তটিতে বিস্ময় প্রকাশ না করিয়া উপায় নাই। মৃত্যুদণ্ডের আদেশ হইবার পর অহেতুক দেরি ঘটিয়াছে: ইহাই কি সেই আদেশ প্রত্যাহারের যথেষ্ট কারণ হইতে পারে? অপরাধ যখন অপরিবর্তিত আছে, শুধুমাত্র বিলম্বের কারণেই শাস্তি বদলাইবে কেন? সন্ত্রাসের ঘটনায় মৃত্যুদণ্ডে শীর্ষ আদালতের কোনও নীতিগত আপত্তি আছে, তাহাও ভাবিবার উপায় নাই। সাম্প্রতিক অতীতেই আজমল কসব ও আফজল গুরুর ফাঁসি হইয়াছে। এই ক্ষেত্রে মাদ্রাজ হাইকোর্ট কয়েক বৎসর পূর্বে ফাঁসি কার্যকর করিবার ক্ষেত্রে স্থগিতাদেশ জারি করিয়াছিল। তবে কি নিম্নতর আদালতের সিদ্ধান্তের সম্মানেই সুপ্রিম কোর্টের রায়? সে যুক্তিও ধোপে টেঁকে না, গত কিছু কালের মধ্যেই অন্যান্য ক্ষেত্রে হাইকোর্টের সিদ্ধান্ত আমূল বদলাইয়া গিয়াছে সুপ্রিম কোর্টের বিচারকক্ষে। সুতরাং প্রশ্ন উঠিবেই, রাজীব-আততায়ীদের প্রাণদণ্ড মকুব করিবার সিদ্ধান্তটির যৌক্তিক ও নীতিগত ভিত্তিটিক ঠিক কী?
প্রত্যাশিত ভাবেই তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী জয়ললিতা ঘোলা জলে মাছ ধরিতে নামিয়া পড়িয়াছেন। তামিল খণ্ড জাতীয়তাবাদের হাওয়া নিজের পালে টানিতে তাঁহার উৎসাহ প্রত্যাশিত হইলেও তাহার মাত্রা ও প্রকার নিশ্চয় গোটা দেশে দৃষ্টিকটু ঠেকিতেছে। অপরাধীদের মুক্তি দেওয়ার তড়িঘড়ি সিদ্ধান্তটি অবশ্য ইতিমধ্যেই সুপ্রিম কোর্টে আটকাইয়া গিয়াছে। কিন্তু সিদ্ধান্তটি তিনি কী করিয়া লইয়াছিলেন, ইহাই আশ্চর্য। আদালত প্রাণদণ্ড মকুব করিলেও অপরাধীদের তৎক্ষণাৎ বেকসুর খালাস করিবার অধিকার রাজ্য সরকারের আছে কি না, তাহা একটি গুরুতর প্রশ্ন। এই মামলায় যে কেন্দ্রীয় সরকারের বক্তব্য শুনিবার অবকাশটি জরুরি, সাধারণ বুদ্ধিই তাহা বলিয়া দেয়। আরও একটি জরুরি প্রশ্ন— অপরাধীদের মুক্তি দিবার ক্ষেত্রেও রাজ্য সরকার কতগুলি পদ্ধতি পালন করিতে বাধ্য। এই ভাবে রাতারাতি সে কাজ করা যায় না, এমনকী ভোটের দিকে তাকাইয়াও নয়। তবে কি না, জয়ললিতা যাহা করিতেছেন, তাহা অতি বিপজ্জনক হইলেও অভাবনীয় নহে। যে কোনও পরিস্থিতিকে নির্বাচনী ফায়দা তুলিতে ব্যবহার করা এখন ভারতীয় রাজনীতির দস্তুর। লোকসভা নির্বাচনের পূর্বে ইউপিএ তাঁহার হাতে এই সুবর্ণসুযোগটি তুলিয়া দিয়াছে। কেবল দীর্ঘসূত্রিতাই নয়, রাজনৈতিক অদূরদৃষ্টিও ইউপিএ-র অতিপরিচিত বৈশিষ্ট্য কি না! |