|
|
|
|
দেড় কোটি মানুষের ভাষা কুড়মালির স্বীকৃতি নেই আজও |
কিংশুক গুপ্ত • ঝাড়গ্রাম |
ছ’টি রাজ্যে ছড়িয়ে থাকা প্রায় দেড় কোটি মানুষ যে ভাষায় কথা বলেন, তার স্বীকৃতি মেলেনি এখনও। ভাষাটির নাম কুড়মালি। পশ্চিমবঙ্গ, ঝাড়খণ্ড, ওড়িশা, অসম এবং ছত্তীসগঢ় ও বিহারে বসবাসকারী কুড়মিরা (মাহাতো) এই ভাষায় কথা বলেন।
প্রায় এক বছর আগে লোকসভায় প্রশ্নোত্তর পর্বে রাজ্যের শাসক-দল তৃণমূলের সাংসদ শুভেন্দু অধিকারী সেই কুড়মালি ভাষার স্বীকৃতি দাবি করেছিলেন। গত বছর মার্চে ঝাড়গ্রাম রাজবাড়িতে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছেও এই সব দাবি নিয়ে দাবি-সনদ দেয় একাধিক কুড়মি-সংগঠন। ওই দিন জঙ্গলমহলের বিনপুরের সভায় এসে মুখ্যমন্ত্রী জানিয়েও দিয়েছিলেন, কুড়মিদের দাবিগুলি খতিয়ে দেখে সরকার উপযুক্ত পদক্ষেপ করবে। ঝাড়খণ্ড রাজ্য সরকারও একাধিক বার কেন্দ্রীয় সরকারকে চিঠি দিয়ে কুড়মালি ভাষার সাংবিধানিক স্বীকৃতির দাবি জানিয়েছে। কিন্তু তারপরেও সেই ভাষা সাংবিধানিক স্বীকৃতি পায়নি।
অল ইন্ডিয়া কুড়মালি চিসইআ সোসাইটির সম্পাদক জয়ন্ত মাহাতো বলেন, “২০০৯ সালের শিক্ষার অধিকার আইনে বলা আছে, শিশুর শিক্ষার মাধ্যম হবে তার মাতৃভাষা। ভাষাগত সংখ্যালঘু ও পিছিয়ে পড়া শিশুরা যাতে কোনও মতেই শিক্ষার অধিকার থেকে বঞ্চিত না হয় সে কথাও আইনে বলা আছে। কিন্তু কুড়মি-শিশুরা তাদের মাতৃভাষায় শিক্ষালাভে বঞ্চিত হচ্ছে। ঝাড়খণ্ডেও কিন্তু এখনও পর্যন্ত সরকারি ভাবে প্রাথমিক স্তরে কুড়মালি ভাষায় পঠন পাঠন চালু করা হয়নি।”
শুভেন্দুর দাবি, এ রাজ্যের পশ্চিম মেদিনীপুর, পুরুলিয়া ও বাঁকুড়া জেলার জঙ্গলমহলে বসবাসকারী মোট জন সংখ্যার ৪২ শতাংশ মানুষ কুড়মালি ভাষায় কথা বলেন। তবে পশ্চিমবঙ্গে সরকারি স্তরে কুড়মালি ভাষায় পঠনপাঠনের কোনও ব্যবস্থা নেই। অথচ প্রতিবেশী ঝাড়খণ্ড রাজ্যে ১২টি দ্বিতীয় সরকারি ভাষার অন্যতম হল কুড়মালি। আশির দশক থেকেই রাঁচি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রীয় আদিবাসী ভাষা বিভাগে কুড়মালি ভাষা পড়ানো হচ্ছে। পরে ঝাড়খণ্ডের আরও দু’টি বিশ্ববিদ্যালয়ে (চাঁইবাসার কোলহান বিশ্ববিদ্যালয় ও হাজারিবাগের বিনোবাভাবে বিশ্ববিদ্যালয়) এই ভাষা পড়ানো হচ্ছে। ঝাড়খণ্ডের বেশ কিছু স্কুলে নবম শ্রেণী থেকে কুড়মালি ভাষা পড়ানো হয়।
তবে কুড়মালি ভাষার নিজস্ব কোনও লিপি নেই। অঞ্চল বিশেষে দেবনাগরী, বাংলা ও ওডিশি হরফ ব্যবহার করা হয়। ঝাড়খণ্ডের বেশ কিছু কলেজে আইএ থেকে স্নাতক স্তরে এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে এমএ পর্যন্ত কুড়মালি ভাষাটি পড়ার সুযোগ রয়েছে। স্নাতকোত্তর স্তরে অবশ্য কেবল দেবনাগরী ও ইংরেজি রোমান হরফে পঠনপাঠনের ব্যবস্থা রয়েছে। তবে বেসরকারি উদ্যোগে কুড়মালি হরফ তৈরির দাবি করেছেন একাধিক ব্যক্তি ও সংগঠন।
এর মধ্যে ঝাড়গ্রামের বাসিন্দা জয়ন্তবাবুর তৈরি করা কুড়মালি হরফটি (কুড়মালি চিসই) পশ্চিমবঙ্গ ও ওডিশার ৫৪টি বেসরকারি ও ব্যক্তিগত উদ্যোগে স্থাপিত প্রাথমিক স্কুলে কুড়মালি ভাষা পড়ানোর জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে। নিজের আবিষ্কার করা কুড়মালি লিপি ও ব্যাকরণ সংক্রান্ত বিস্তারিত তথ্য কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারকে জানিয়েছেন জয়ন্তবাবু। এখনও স্বীকৃতি মেলেনি। জয়ন্তবাবুর বক্তব্য, ভাষার নিজস্ব লিপি না-থাকলে সাংবিধানিক স্বীকৃতির ক্ষেত্রে সমস্যা হয়। সাঁওতালি ভাষার নিজস্ব অলচিকি লিপি থাকায় ভাষাটি স্বীকৃতি পেয়েছে। পুরনো নথি বলছে, পরাধীন ভারতে কুড়মিরা তফসিলি উপজাতি তালিকাভুক্ত ছিলেন। স্বাধীনতার পরে অবশ্য সেই তালিকা থেকে কুড়মিরা বাদ পড়ে যায়। পরে ১৯৯৪ সালে কুড়মিদের ওবিসি তালিকাভুক্ত করা হয়। কুড়মিরা অবশ্য দীর্ঘ কয়েক দশক ধরে তপশিলি উপজাতি তালিকাভুক্ত হওয়ার দাবি করে আসছে।
কুড়মালি ভাষার উৎপত্তি নিয়ে গবেষকদের মধ্যে নানা মতভেদ রয়েছে। কেউ বলেন এটি বাংলার অপভ্রংশ। কারও মতে ওডিশি ভাষার অপভ্রংশ হল কুড়মালি। মালদহের গৌড় কলেজের বাংলার অধ্যাপক ক্ষিতীশ মাহাতোর দাবি, চতুর্দশ শতকে বড়ু চণ্ডীদাসের ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’-এ কুড়মালি শব্দ এবং ধ্বনিতত্ত্ব ও রূপতত্ত্বের লক্ষণ স্পষ্ট ভাবে রয়েছে। কুড়মালি লোকসাহিত্য ও ঝুমুর গানের ধারাটিও যথেষ্ট সমৃদ্ধ। এই সব এলাকায় ঝুমুরগানের জনপ্রিয়তা আকাশচুম্বী। কুড়মালি ভাষায় লিখিত সাহিত্যের সংখ্যা অপ্রতুল। গত তিন দশক ধরে অবশ্য বেশ কিছু সাহিত্য সৃষ্টি হয়েছে।
পুরুলিয়ার বাসিন্দা বিশিষ্ট কুড়মালি সাহিত্যিক ও গবেষক সুনীল মাহাতোর কথায়, “ঝাড়খণ্ডের মতো এ রাজ্যেও কুড়মালি ভাষা প্রসারের জন্য সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে।” পশ্চিম মেদিনীপুরের জঙ্গলমহলের অন্যতম বিশিষ্ট কুড়মি সাহিত্যিক ও গবেষক বিভূতিভূষণ মাহাতো জানান, বাম জমানাতেও ১৯৮৩ সালে কুড়মালি ভাষা পরিষদের পক্ষ থেকে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুকে কুড়মালি ভাষার প্রসারের নানা দাবিতে স্মারকলিপি দেওয়া হয়েছিল। কিছুই হয়নি। রাঁচির গোসনার কলেজের অর্থনীতির প্রাক্তন অধ্যাপক তথা ‘মুলকি কুড়মালি ভাখি বাইসি’ (কুড়মালি ভাষা পরিষদ)-এর সভাপতি শশীভূষণ মাহাতো জানান, জঙ্গলমহল ছাড়াও দুই চব্বিশ পরগনা, নদিয়া, মুর্শিদাবাদ, মালদহ ও দুই দিনাজপুরেও প্রায় ৩০ লক্ষের বেশি কুড়মি রয়েছেন। আদিবাসী কুড়মি সমাজের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য অশোক মুতরুয়ার বলেন, “কুড়মিদের পুনরায় এসটি তালিকাভুক্ত করা ও কুড়মালি ভাষার সাংবিধানিক স্বীকৃতির দাবিতে আমরা লাগাতার কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারগুলিকে স্মারকলিপি দিয়ে চলেছি। ঝাড়খণ্ডের বেতার ও দূরদর্শনে কুড়মালি ভাষায় অনুষ্ঠান সম্প্রচার করা হয়। ঝাড়খণ্ডকে দেখে কুড়মি ভাষা প্রসারে পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষা নেওয়া উচিত।” তবে সিধো কানহো বীরসা বিশ্ববিদ্যালয়ে কুড়মালি পড়ানোর প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। |
|
|
|
|
|