অনাদায়ী ঋণ নিয়ে এই মুহূর্তে দেশ জোড়া বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে ইউনাইটেড ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া (ইউবিআই)। সমস্যা যাতে রাশ না-ছাড়ায়, তা দেখতে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া এবং কেন্দ্রীয় অর্থ মন্ত্রক ইতিমধ্যেই ব্যবস্থা নেওয়ার পথে হাঁটতে শুরু করেছে। অনাদায়ী ঋণের বোঝা বৃদ্ধি এবং লোকসানের বহরের পরিপ্রেক্ষিতে সম্প্রতি ইউবিআই-এর আর্থিক অবস্থা খতিয়ে দেখতে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক তদন্ত শুরু করেছে। এ জন্য উপদেষ্টা সংস্থা ডেলয়েটকে দিয়ে বিশেষ (ফরেন্সিক) অডিটও করিয়েছে শীর্ষ ব্যাঙ্ক। ডেলয়েট তাদের রিপোর্ট সস্প্রতি জমা দিয়েছে। কিন্তু রিপোর্টে কী আছে, সে ব্যাপারে মুখে কুলুপ এঁটেছেন ইউবিআই কর্তৃপক্ষ।
ইউবিআই-এর উচ্চ মহলের একাংশ এই পরিস্থিতিকে নেহাতই সাময়িক সমস্যা বলে উড়িয়ে দিতে চাইলেও, ব্যাঙ্কের তরফে সংবাদ মাধ্যমের প্রশ্নের সরাসরি উত্তর দেওয়া বন্ধ হয়ে গিয়েছে। তবে এই অনুুৎপাদক সম্পদের বোঝা যাতে আর না-বাড়ে, তার জন্য ইউবিআইকে আপৎকালীন ব্যবস্থা হিসাবে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক কোনও অ্যাকাউন্টে ১০ কোটি টাকার বেশি ঋণ দেওয়ার উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে।
ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষের একাংশ এই সমস্যাকে স্বল্পকালীন বলে মনে করছেন এবং তা অদক্ষতার জন্য তৈরি হয়েছে বলেও মানতে নারাজ। তাঁদের অভিযোগ, সমস্যার অন্যতম উৎস ব্যাঙ্কের কম্পিউটার ব্যবস্থা। কোন ঋণ ফেরত পাওয়া যাবে, কোনটাই বা যাবে না, তা হিসাব করার জন্য ইউবিআই ইনফোসিসের সফটওয়্যার ব্যবহার করে। ব্যাঙ্কের ওই মহলের অভিযোগ, ইনফোসিসের সফটওয়্যার ঠিক মতো কাজ না-করায় ব্যাঙ্কের এই বেহাল অবস্থা। ইনফোসিস অবশ্য এক বিবৃতিতে অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে দাবি করেছে, যে-কাজের জন্য ‘ফিনাকল’ শীর্ষক তাদের সফটওয়্যার ইউবিআইয়ে চালু হয়েছে, তা সঠিক ভাবেই সম্পন্ন হয়েছে। সফটওয়্যারটি রিজার্ভ ব্যাঙ্কের নির্দিষ্ট নিয়ম মেনেই তৈরি। ভারতে প্রথম সারির সব ব্যাঙ্কই এটি ব্যবহার করছে। কেউই অভিযোগ আনেনি বলে দাবি ইনফোসিসের।
ইনফোসিসের বিরুদ্ধে অভিযোগের ব্যাপারে ইউবিআইয়েরই কেউ কেউ বলেছেন, “ফিনাকল চালু হয় ২০০৮-এ ‘ট্রায়াল অ্যান্ড এরর মেথড’-এ। এত দিন তো এটিকে নিয়ে কোনও সমস্যা হয়নি।”
ইউবিআইয়ের ভবিষ্যৎ নিয়ে ইতিমধ্যেই ব্যাঙ্কিং মহলে নানা জল্পনা শুরু হয়েছে। তবে ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষ, ও প্রাক্তন কর্তাদের মধ্যেও অনেকের মত, সমস্যাটিকে বেশি বড় করে দেখানো হচ্ছে। তাঁদের আশা, কঠিন হলেও এই সমস্যা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব।
সমস্যাটি কী আকারের? তৃতীয় ত্রৈমাসিকের আর্থিক ফলাফলে দেখা যাচ্ছে যে, চলতি অর্থবর্ষের প্রথম ৯ মাসে ইউবিআই-এর অনুৎপাদক সম্পদ ৫৫৮১ কোটি টাকা বেড়ে হয়েছে ৮৫৪৬ কোটি। ওই অনুৎপাদক সম্পদ বৃদ্ধি থেকেই বাকি সমস্যার সৃষ্টি। কারণ, অনুৎপাদক সম্পদ বাড়লে আরবিআইয়ের নিয়ম মেনে তার জন্য আর্থিক সংস্থান করতে হয় ব্যাঙ্ককে। আর্থিক সংস্থান বাবদ বরাদ্দ টাকা মুনাফা থেকে বাদ দিয়েই তৈরি হয় ব্যালান্স শিট। যা করতে হয়েছে ইউবিআইকেও। চলতি ২০১৩-’১৪ অর্থবর্ষের তৃতীয় ত্রৈমাসিকের আর্থিক ফল তাই লোকসানের খাতায় চলে গিয়েছে। ক্ষতি ঠেকেছে ১২৩৮.০৭ কোটি টাকায়। আর তার বিরূপ প্রভাব পড়েছে ব্যাঙ্কের মূলধনে। ফলে তৃতীয় ত্রৈমাসিক শেষে তাদের ঋণের পরিপ্রেক্ষিতে মূলধনের অনুপাত (ক্যাপিটাল অ্যাডিকোয়েসি রেশিও) কমে দাঁড়িয়েছে ৯.০১%। ‘বাসেল-থ্রি’ বিধি অনুযায়ী ওই অনুপাত ন্যূনতম মাত্রায় রয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এটা বেশ উদ্বেগের। কারণ, তা ব্যাঙ্কের মূলধনের অবস্থা ভাল না-হওয়ারই ইঙ্গিত।
ব্যাঙ্কটি ২০১২-’১৩ অর্থবর্ষেও নিট মুনাফা করেছিল। কিন্তু আর্থিক অবস্থা চলতি ২০১৩-’১৪ অর্থবর্ষের ৯ মাসেই খারাপের দিকে গিয়েছে। শুধু প্রথম ত্রৈমাসিকে নিট মুনাফা হয়েছিল ৪৪.৭৩ কোটি টাকা। তার পর দু’টি ত্রৈমাসিকেই নিট লোকসান হয়েছে। ডিসেম্বর পর্যন্ত ৯ মাসে নিট হিসাবে ইউবিআইয়ের লোকসান ১৭২৭.৫৭ কোটি।
অবস্থা কেন এমন হল? এ ব্যাপারে ইউবিআইয়ের কর্তারা মুখে কুলুপ এঁটেছেন। ব্যাঙ্কের সিমএমডি অর্চনা ভার্গব টেলিফোন ধরেননি। এগ্জিকিউটিভ ডিরেক্টর দীপক নারাঙ্গ জানান, “আমি সংবাদ মাধ্যমের সঙ্গে কথা বলব না।” তবে ইউবিআইয়ের কিছু ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলে জানা গিয়েছে, অফিসারদের একটি বড় অংশের অভিযোগের তির সিএমডির দিকেই। তাঁদের মতে, ভার্গবের বেশ কিছু সিদ্ধান্ত ভুল ছিল। যেমন, তিনি চেয়েছিলেন সমস্ত অনুৎপাদক সম্পদই হিসাবে দেখানো হোক। ইউবিআই অফিসারদের ওই অংশের মতে, সাধারণত এমনটা কোনও ব্যাঙ্ক করে না। এমন বহু ঋণকে অনুৎপাদক সম্পদ দেখানো হয়েছে, যার কোনও প্রয়োজন ছিল না। কারণ, ওই সব ঋণ এ বছরেই আদায়ের সম্ভাবনা আছে। ব্যাঙ্কের এক ক্ষুব্ধ অফিসার বলেন, “আমরা যে-ভাবে অনুৎপাদক সম্পদের হিসাব তৈরি করেছি, কোনও ব্যাঙ্ক সাধারণত তা করে না। করলে দেশের ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থা ভেঙে পড়বে।”
এটা ঠিক, চলতি অর্থবর্ষে স্টেট ব্যাঙ্ক-সহ প্রায় প্রতিটি ব্যাঙ্কেরই অনুৎপাদক সম্পদ বেড়েছে। এমন কিছু ব্যাঙ্ক রয়েছে, যাদের অনুৎপাদক সম্পদ ইউবিআইয়ের থেকেও বেশি। কিন্তু ব্যাঙ্কিং শিল্পমহলের মতে, এক দিকে অনুৎপাদক সম্পদ বৃদ্ধি, অন্য দিকে ইউবিআই কর্তৃপক্ষের কিছু ভুল সিদ্ধান্ত অবস্থা ঘোরালো করে তুলেছে। বিশেষত যে-পরিমাণ লোকসান হয়েছে, তা পূরণ করে ফের মুনাফায় ফিরে আসা কর্তৃপক্ষের কাছে বাস্তবিকই বড় চ্যালেঞ্জ বলে মনে করছেন ব্যাঙ্কিং বিশেষজ্ঞরা।
সমস্যা থেকে বেরোতে কর্তৃপক্ষ কী ভাবছেন, তা জানা যায়নি। তবে ব্যাঙ্কিং বিশেষজ্ঞ ও ইউকো ব্যাঙ্কের প্রাক্তন এগ্জিকিউটিভ ডিরেক্টর বি কে দত্ত বলেন, “অনুৎপাদক সম্পদ দ্রুত কমাতে হবে। পুরো টাকা আদায় সম্ভব নয়। ঋণ ঢেলে সাজা, অ্যাসেট রিকনস্ট্রাকশন সংস্থার কাছে অনুৎপাদক সম্পদ বিক্রি ইত্যাদি রাস্তার কথা ভাবতে হবে। ঋণ আদায় না-হওয়ায় কার্যকরী মূলধনের একটা বড় অংশ আটকে গিয়েছে। দক্ষ ট্রেজারি ম্যানেজমেন্টের মাধ্যমেই ওই মূলধন বাড়ানোর ব্যবস্থা করতে হবে। জোর দিতে হবে কম সুদের আমানত সংগ্রহেও।” |