তাক লাগিয়ে ফেসবুকের দখলে এল হোয়াটস্অ্যাপ
দেখাসাক্ষাৎ চলছিল বছর দুই ধরেই। কখনও কাছের কফিশপে, তো কখনও বাড়ির নৈশভোজে। শেষমেশ পাকা কথা ‘ভ্যালেনটাইন্স ডে’-র রাত্তিরে। যার ফল হিসেবে ১৯০০ কোটি ডলারে মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন সংস্থা হোয়াটস্অ্যাপ-কে কিনে নেওয়ার কথা ঘোষণা করল ফেসবুক!
বুধবার গভীর রাতের এই ঘোষণায় তামাম তথ্যপ্রযুক্তি দুনিয়াকে চমকে দিয়েছে ফেসবুক। সোশ্যাল নেটওয়ার্কিংয়ের ব্যবসায় নিজেদের পয়লা নম্বর জায়গা মজবুত করতে তারা যে বিভিন্ন অ্যাপ (মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন) কেনার দিকে নজর দিচ্ছে, তা নতুন নয়। কিন্তু ২০০৯ সালে জন্ম নেওয়া হোয়াটস্অ্যাপের জন্য তারা যে বিপুল অর্থ উপুড় করতে রাজি, তা-ই চোখ কপালে তুলে দিয়েছে সকলের।
সেই হোয়াটস্অ্যাপ, যারা গত দু’বছরে মার্কিন তথ্যপ্রযুক্তির পীঠস্থান সিলিকন ভ্যালিকেও তাক লাগিয়ে উঠে এসেছে উল্কার গতিতে। ইতিমধ্যেই ফি মাসে যার ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৪৫ কোটি। প্রতি দিন আবার তা বাড়ছে দশ লক্ষ করে। অনেকের মতে, যে কোনও স্মার্টফোন থেকে প্রায় নিখরচায় বার্তা (মেসেজ), ছবি, কিংবা ভিডিও পাঠানোর সুবিধা দিয়ে ‘মেসেজিং’ পরিষেবায় কার্যত বিপ্লব এনেছে তারা। টপকে গিয়েছে টুইটারকে। এক পক্ষ বলছেন, এ হেন সংস্থার জন্য ফেসবুক যে বড় অঙ্ক খরচ করবে, তাতে আর আশ্চর্য কী?
কিন্তু অন্য পক্ষের তেমনি প্রশ্ন, সংস্থা সম্ভাবনাময় সন্দেহ নেই। কিন্তু দামটা একটু বাড়াবাড়ি রকম বেশি নয় কি?
অবশ্য আর যার কাছেই বেশি ঠেকুক, এই আকাশছোঁয়া দরকে পাত্তা দেওয়ার কোনও লক্ষণই দেখাননি জ্যান কউম। হোয়াটস্অ্যাপের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। সংস্থার ৪৫% অংশীদারি পকেটে থাকায় এখন যিনি রাতারাতি ৬৮০ কোটি ডলারের মালিক। যোগ দিচ্ছেন ফেসবুকের পরিচালন পর্ষদেও। অথচ এত বড় চুক্তির কাগজ তিনি হেলায় সই করছেন দাঁড়িয়ে। কোনও মতে দরজায় ঠেসে ধরে। সেই ছবি আবার নিজেই পোস্ট করেছেন টুইটারে।
হেলায় স্বাক্ষর। ১৯০০ কোটি ডলারের চুক্তিপত্রে এমন
ভাবেই সই করলেন জ্যান কউম। ছবি: টুইটারের সৌজন্যে।
অবশ্য কউমকে যাঁরা চেনেন, তাঁরা জানেন, ১৬ বছর বয়সে ইউক্রেন থেকে মার্কিন মুলুকে আসা এই মুখচোরা ভদ্রলোক আদপে এমনই। যে ইউক্রেনে বৃহস্পতিবার সরকার-বিরোধী বিক্ষোভে প্রাণ হারিয়েছেন অন্তত ২১ জন, সে দেশেরই এই প্রাক্তন বাসিন্দাটি ছেলেবেলায় অসম্ভব দারিদ্রের মুখ দেখেছিলেন। সিলিকন ভ্যালির ‘দস্তুর মেনে’ কলেজের গণ্ডি পেরোননি। ইয়াহুতে বছর কয়েক চাকরি করেছেন। কিন্তু বরাবর করতে চেয়েছেন এমন কিছু, যার নেশায় বুঁদ হয়ে থাকা যাবে। হাজার প্রলোভনেও এখনও হোয়াটস্অ্যাপে বিজ্ঞাপন আনেননি। বরাবর এড়িয়ে চলেছেন সংবাদমাধ্যমকে। এমনকী, অফিসে সংস্থার একখানা লোগো লাগাতেও তাঁর বিস্তর আপত্তি। তাঁর মতে, ‘ওতে দেখনদারিই বেশি থাকে।’
কম আকর্ষণীয় নয় হোয়াটস্অ্যাপ তৈরিতে কউমের সঙ্গী ব্রায়ান অ্যাক্টনের জীবনও। স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তনী। কউমের সঙ্গে আলাপ ইয়াহুতে। সব থেকে মজার কথা, এক সময়ে আবেদন করে এই ফেসবুকেই চাকরি পাননি তিনি। সেই ব্যর্থতার কথা আবার ফলাও করে লিখেছিলেন টুইটারে। নিজের প্রতি সান্ত্বনা ছিল, “এটা হল না। জীবনে এ বার নতুন কিছুর খোঁজ করি।” খোঁজ হয়তো একটু বেশিই জোরালো হল। হোয়াটস্অ্যাপের ২০% শেয়ার এখন তাঁর হাতে। ফলে এক সময়ে খালি হাতে ফেরানো অ্যাক্টনকেই এ বার ৩০০ কোটি ডলার দিতে চলেছে ফেসবুক।
বিশ্বের বৃহত্তম সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সংস্থা ফেসবুকের প্রতিষ্ঠাতা ও কর্ণধার মার্ক জুকেরবার্গের কথায়, “হোয়াটস্অ্যাপ ব্যবহারকারীর সংখ্যা কিছু দিনের মধ্যেই ১০০ কোটি পেরোবে। এর সঙ্গে আরও গভীর ভাবে একাত্মবোধ করবে নতুন প্রজন্ম। সেই কথা ভেবেই এই সিদ্ধান্ত।” তা ছাড়া, সোশ্যাল নেটওয়ার্কিংয়ের পাশাপাশি আজকের প্রজন্ম যে ভাবে ব্যক্তিগত বার্তা আদানপ্রদানের দিকে ঝুঁকছে, তার কথা মাথায় রেখে সেই বাজারের সব থেকে সম্ভাবনাময় সংস্থাকেও ফেলে রাখার ঝুঁকি নেননি তিনি। জানিয়েছেন, অধিগ্রহণের পরেও নিজেদের আলাদা পরিচিতি বজায় রেখে ব্যবসা চালিয়ে যাবে হোয়াটস্অ্যাপ।
তবে নতুন কেনা সংস্থার সম্ভাবনা সম্পর্কে জুকেরবার্গ যতই উচ্ছ্বসিত হোন না কেন, হোয়াটস্অ্যাপের জন্য ১৯০০ কোটি ডলার দাম অনেকটাই বেশি বলে মনে করছেন কেউ কেউ। তাঁদের প্রশ্ন, মাত্র পঞ্চান্ন জন কর্মীর সংস্থাটির উত্থানে কি একটু বেশিই ভয় পেয়ে গেল ফেসবুক? আস্থা রাখতে পারল না নিজেদের উদ্ভাবনী ক্ষমতায়? নইলে আজ পর্যন্ত তথ্যপ্রযুক্তি দুনিয়ার সব থেকে বেশি দাম প্রায় আনকোরা একটি সংস্থাকে দিতে তারা রাজি হল কেন? যেখানে এর থেকে অনেক কম দামে মোটোরোলার মতো বহুল পরিচিত সংস্থাকে কিনেছিল গুগ্ল। মাইক্রোসফট কিনেছিল স্কাইপকে। একই সঙ্গে সমালোচকরা মনে করিয়ে দিচ্ছেন যে বিজ্ঞাপন থেকে এখনও পর্যন্ত কোনও আয় করে না হোয়াটস্অ্যাপ। রোজগার বলতে এক বছর ব্যবহারের জন্য ব্যবহারকারীদের দেওয়া ১ ডলারেরও কম ‘সাবস্ক্রিপশন ফি।’ তাঁদের প্রশ্ন, জনপ্রিয়তা এক কথা, কিন্তু ব্যবসায়িক ভাবে এই চুক্তি ফেসবুকের পক্ষে আদৌ লাভজনক হবে তো? এর উত্তরে আবার অনেকে মনে করেন, প্রায় ধূমকেতুর মতো উঠে এসে তথ্যপ্রযুক্তি দুনিয়ার নকশাই বদলে দিয়েছে ফেসবুক নিজে। দেখেছে, কত তাড়াতাড়ি আকর্ষণীয় কোনও নতুন প্রযুক্তিকে আঁকড়ে ধরে নতুন প্রজন্ম। তাঁদের মতে, এই কারণেই কোনও ঝুঁকির রাস্তায় হাঁটতে চায়নি তারা। শুরুতেই ঝুলিতে পুরতে চেয়েছে সম্ভাব্য প্রতিদ্বন্দ্বীদের। যার উদাহরণ একশো কোটি ডলারে ছবি আদানপ্রদানের অ্যাপ ‘ইনস্টাগ্রাম’ কিনে ফেলা। সফল না হলেও আর এক মেসেজ সংস্থা ‘স্ন্যাপচ্যাট’কে তিনশো কোটি ডলারে কেনার প্রস্তাব দেওয়া। এবং হোয়াটস্অ্যাপের দখল নিতে মাথা ঘুরিয়ে দেওয়া অঙ্ক খরচ। চুক্তির অঙ্ক যদি চমকপ্রদ হয়, তবে তার পিছনের ঘটনাও রূপকথা।
কারণ, কেনার ঘোষণা বুধবার হল ঠিকই। কিন্তু ২০১২ থেকেই হোয়াটস্অ্যাপের দিকে হাত বাড়াতে থাকেন জুকেরবার্গ। বার বার দেখা করেন কউমের সঙ্গে। ৯ ফেব্রুয়ারি খাওয়া আর ঘণ্টা দেড়েক হাঁটার শেষে কেনার প্রথম প্রস্তাব। ১৪ ফেব্রুয়ারি ভ্যালেনটাইন্স ডে-র রাতে স্ত্রীর সঙ্গে ‘রোম্যান্টিক ডিনার’ আর সারা হল না জুকেরবার্গের। হঠাৎই বাড়িতে হাজির কউম। বাকিটা ইতিহাস।
কউম-ই ঠিক ছিলেন। নিজেরাই ইতিহাস গড়লে অফিসের গায়ে লোগোর দরকার কী?



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.