এক দিকে, ভূগর্ভস্থ জলস্তরের ভাণ্ডার কমছে। সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নামছে জলস্তরও। তবুও জলের সংরক্ষণ নিয়ে অধিকাংশ মানুষই এখনও ততটা সচেতন নন। জলকে ঘিরে মানবসভ্যতার সঙ্কটের কথা তাঁকে বারবারই ভাবিয়ে তুলত। ব্যস্ত থাকতেন পরবর্তী প্রজন্মের হাতে কোন সমাধান দিয়ে যেতে পারবেন, তার সন্ধানে। বহু গবেষণার পরে মুশকিল আসান করেছেন নানুরের সেই সন্তান, বর্তমানে পুরুলিয়া সৈনিক স্কুলের অঙ্কের শিক্ষক মহম্মদ মহসিন। জলসংরক্ষণের একটি অত্যাধুনিক পদ্ধতি বানিয়েছেন তিনি। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্তরে প্রশংসা মেলার পরে নিজের ওই প্রযুক্তির জন্য ইতিমধ্যেই মহসিন পেটেন্টের আবেদন করেছেন। এ বার ‘জল ধরো, জল ভরো’ প্রকল্পে তাঁর প্রযুক্তিকে কাজে লাগানোর অনুরোধ জানিয়ে খোদ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কেই চিঠি দিয়েছেন। |
নিজের হাতে গড়া প্রকল্পের মাঝে মহম্মদ মহসিন।—নিজস্ব চিত্র। |
এমনিতে জলসংরক্ষণের জন্য পৃথিবী জুড়ে হাজার একটা পদ্ধতি রয়েছে। ওই শিক্ষকের পদ্ধতি তা হলে কোন দিক থেকে অন্য রকম?
মহসিনের প্রতিক্রিয়া, “আমার প্রযুক্তি এদের সবার থেকে আলাদা এবং সম্পূর্ণ নতুন। এই পদ্ধতিতে শুধু জলসংরক্ষণ ও পরিশোধনই নয়, সংরক্ষিত জলকে মাটির নীচে পোঁছে দিয়ে জলস্তরকে বাড়তেও তা সাহায্য করবে।” গত দুই বছর ধরে তিনি পরীক্ষামূলক ভাবে নিজের গ্রামের পাশে শেরপুরে ওই পদ্ধতিতে জলসংরক্ষণ করেছেন। ওই পদ্ধতিতে বৃষ্টি ও অন্যান্য প্রাকৃতিক উত্সের অব্যবহৃত জল ধরে তাকে আর্সেনিক ও ফ্লোরাইড মুক্ত করে মাটির নীচের জলস্তরে পাঠিয়ে সংরক্ষণ করা হয়েছে। তাঁর দাবি, ‘ন্যাশনাল জিওফিসিক্যাল রিসার্চ ইন্সটিটিউট (এনজিআরই)’ ২০১৩ সালে ওই পদ্ধতিকে স্বীকৃতিও দিয়েছে। তাঁর ওই নতুন প্রযুক্তি নিয়ে তৈরি গবেষণাপত্র তিনি দু’টি আন্তর্জাতিক সেমিনারেও পাঠ করেছেন। ২০০৭ সালে তা নিয়ে পৌঁছে গিয়েছেন বাংলাদেশেও। এমনকী, ওই গবেষণা খড়গপুর আইআইটি কর্তৃপক্ষেরও প্রশংসা কুড়িয়েছে বলে তিনি দাবি করেছেন।
কী ভাবে কাজ করে ওই প্রযুক্তি?
এনজিআরই এবং দুর্গাপুরের সেন্ট্রাল মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং রিসার্চ ইন্সটিটিউট (সিএমইআরআই) ওই পদ্ধতি বানাতে মহসিনকে প্রযুক্তিগত সাহায্য করেছে। মহসিন জানান, বৃষ্টি ও অন্যান্য প্রাকৃতিক উত্সের অব্যবহৃত জল প্রথমে ফিল্টার করে একটি বড় চৌবাচ্চার মধ্যে সংরক্ষণ করা হয়। বিশেষ পদ্ধতিতে তা পরিশোধন করে পাঠানো হয় চৌবাচ্চার নীচে ছ’টি গভীর কুয়োর মধ্যে। পরিশোধিত জল সেখানে ফের বিশেষ ভাবে পরিস্রুত করা হয়। ওই পরিশ্রত জল পাইপ দিয়ে ফের উপরের চৌবাচ্চায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়। উপরে আসা জলকেই মহসিন সাইফন পদ্ধতিতে কয়েকটি প্রক্রিয়া শেষে ভূগর্ভস্থ স্তরে পাঠিয়ে দেন। মহসিন বলছেন, “আমার উদ্দেশ্যকে সফল করতে আমি ‘সাইফন টেকনোলজি’র মতো সহজ পদ্ধতি ব্যবহার করেছি। যার ফলে ঘণ্টায় আনুমানিক ৫০ হাজার লিটার জল পরিস্রুত করে ভূগর্ভস্থ জলস্তরে পাঠানো সম্ভব।” এ ক্ষেত্রে বিদ্যুতের খরচও নামমাত্র বলে তিনি জানিয়েছেন। প্রযুক্তিটি চালাতে মাত্র ৩-৫ মিনিট বিদ্যুত্ই যথেষ্ট। মহসিন জানিয়েছেন, ওই প্রযুক্তি বানাতে তাঁর প্রায় ২২ লক্ষ টাকা খরচ হয়েছে। যার মধ্যে ১৫ লক্ষ আর্থিক সহায়তা দিয়েছে কেন্দ্রের ‘ডিপার্টমেন্ট অফ সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি’ মন্ত্রকের আওতাধীন ‘ডিপার্টমেন্ট অফ সায়েন্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিসার্চ’। আর নাবার্ড দিয়েছে ৩ লক্ষ।
প্রশাসন সূত্রে খবর, এমনিতে এই জেলার ভূগর্ভস্থ জলস্তরের হাল তেমন সন্তোষজনক নয়। নানুর এলাকায় ১৯৮৩ সালেও মাত্র ৮ ফুট নীচেই জল পাওয়া যেত। ২০ বছরের মধ্যেই ২০১৩ সালে জলস্তর নেমে গিয়েছে প্রায় ৮০ ফুটেরও নীচে। যার জন্য যথেচ্ছ পরিমাণে শ্যালো ও সাবমাসির্বল পাম্পের ব্যবহারকেই দুষছেন প্রশাসনের কর্তারা। ২০১১ সালের হিসেব অনুযায়ী শুধুমাত্র নানুর থানা এলাকাতেই ২,৮৮৭টি বৈধ শ্যালো পাম্পের সংযোগ রয়েছে। অবৈধ সংযোগের সংখ্যা ধরলে ওই সংখ্যা আরও কয়েকশো বেশি বলেই স্থানীয়দের দাবি। ফলে হুহু করে নামছে ভূগর্ভস্থ জলস্তর। যতটুকুও জল মিলবে, তাতে ফ্লোরাইড থাকার আশঙ্কাও দেখছেন সংশ্লিষ্ট মহল। কারণ ভূগর্ভস্থ জল যত গভীর থেকে তোলা হবে, ততই তাতে ফ্লোরাইডের মাত্রা বাড়বে। এই পরিস্থিতিতে ভবিষ্যতের সঙ্কটকে মাথায় রেখে ওই নতুন মডেল ইতিবাচক ভূমিকা নেবে বলেই মহসিনের দাবি। স্থানীয় নোয়ানগর-কডডা পঞ্চায়েতের প্রধান মনিজা বেগম বলেন, “মহম্মদ মহসিনের মডেল নিয়ে আমরা যথেষ্ট আশাবাদী। তাঁর ওই মডেল এলাকার জলস্তর পুনরায় বাড়তে সাহায্য করবে বলে আমরা মনে করি। পঞ্চায়েতের পক্ষ থেকে তাঁকে যতটা সাহায্য করা যায়, আমরা করব।” রাজ্যের মন্ত্রী চন্দ্রনাথ সিংহ বলেন, “ওই শিক্ষকের বিশেষ প্রযুক্তির কথা শুনেছি। সরকারি প্রকল্পে তা কাজে লাগানো যায় কি না, এ ব্যাপারে ভেবে দেখব।”
আর মহসিন নিজে চান, “আমাদের মুখ্যমন্ত্রী যদি মডেলটিকে মান্যতা দিয়ে তা গোটা রাজ্যে প্রয়োগ করেন, তাহলে বহু মানুষ উপকৃত হবেন। এই পদ্ধতিতে জল ধরে রাখার পাশাপাশি অব্যবহৃত জলকে ফের ভূগর্ভে ফিরিয়ে দিয়ে জলস্তরের পরিমাণও বাড়ানো যাবে।” |