বলির খড়্গ দিয়ে ভয় দেখিয়ে রাজমাতা মন্দিরের বিগ্রহের অলঙ্কার চুরি করে পালাল এক দল দুষ্কৃতী।
দেবোত্তর ট্রাস্ট বোর্ড এবং পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, গত রবিবার রাত ৩টে নাগাদ অন্তত ১৩ জনের একটি দুষ্কৃতী দল রাজ আমলের ঐতিহ্যবাহী রাজমাতা মন্দিরের প্রবেশদ্বারের তালা ভেঙে ঢোকে। বারান্দার একটি ঘরে ওই মন্দিরের প্রহরী তেরেন দাস ও তাঁর স্ত্রী বুলবুলি দাস থাকেন। দুষ্কৃতীদের শব্দ শুনে বুলবুলিদেবী এগোতেই তাঁকে ঘিরে ধরে অলঙ্কার সামগ্রী কোথায় রাখা হয়েছে তা জানতে চায় দুষ্কৃতীরা। |
বুলবুলিদেবী আপত্তি করায় তাঁর মাথায় মন্দির চত্বর থেকে তুলে নেওয়া বলির খড়গ ঠেকিয়ে ভয় দেখিয়ে মারধর করা হয়। তেরেনবাবু এগিয়ে গেলে তাঁকেও ভয় দেখিয়ে দুষ্কৃতীরা মন্দিরের ভিতরে ঢুকে রাধাগোবিন্দ ও তারা বিগ্রহের অলঙ্কার নিয়ে পালিয়ে যায়। বুধবার বুলবুলিদেবী বলেন, “তারা বিগ্রহের কানের সোনার দুল, নাকছাবি ছাড়াও রাধাগোবিন্দের রূপোর মুকুট, বলির খড়্গ সহ বেশ কিছু সামগ্রী নিয়ে দুষ্কৃতীরা চম্পট দেয়। সকাল হতেই ঘটনার কথা কর্তৃপক্ষকে জানাই। ঘটনার পর আতঙ্কে ভুগছি।”বুধবার বিকাল পর্যন্ত দেবোত্তর কর্তৃপক্ষ অবশ্য পুলিশের কাছে লিখিত অভিযোগ জানাননি। ট্রাস্ট কর্তাদের দাবি, খোয়া যাওয়া সামগ্রীর তালিকা চূড়ান্ত না হওয়ায় লিখিত অভিযোগ জানাতে দেরি হচ্ছে। জেলাশাসক তথা দেবোত্তর ট্রাস্ট বোর্ডের সভাপতি মোহন গাঁধী বলেন, “পুলিশকে ঘটনার পরেই সব জানানো হয়েছে। লিখিত অভিযোগ করা হবে।” কোচবিহারের পুলিশ সুপার অনুপ জয়সওয়াল বলেন, “বিষয়টি দেখা হচ্ছে।”
বোর্ডের সদস্য তথা সদর মহকুমাশাসক বিকাশ সাহা জানান, দুষ্কৃতীরা বড় জোর চার হাজার টাকার সামগ্রী নিয়েছে। ওই ব্যাপারে তাঁরাও খোঁজখবর নিচ্ছেন। কিছু সূত্র মিলেছে। পুলিশকেও পুরো বিষয়টি জানানো হয়েছে। ঘটনায় উদ্বিগ্ন দেবোত্তর ট্রাস্ট বোর্ডের সদস্য প্রাক্তন সাংসদ প্রসেনজিৎ বর্মন। তিনি বলেন, “প্রশাসনিক ভাবে তদন্ত হচ্ছে। পুলিশে অভিযোগ জানানো হবে। পুলিশের নজরদারিও বাড়ানো প্রয়োজন।”
স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, কোচবিহার বাসস্ট্যান্ড লাগোয়া রাজমাতা দিঘি লাগোয়া এলাকার এই মন্দিরটিতে দু’মাস আগেও এক জন পুলিশকর্মী রাতে পাহারায় থাকতেন। তাঁকে তুলে নিয়ে যাওয়ার পরে আর কোনও পুলিশকর্মী থাকতেন না। এমনকী ঘটনার তিন দিন পরেও মন্দিরে পুলিশ মোতায়েন করা হয়নি। এলাকার বাসিন্দা দেবাশিস হাজরা, বাপ্পা ধর বলেন, “নিরাপত্তার দাবিতে আন্দোলনের কথা ভাবা হচ্ছে।”
এলাকার বাসিন্দারা জানান, আনুমানিক ১৮৮৪ সালে কোচবিহারের মহারাজা নরেন্দ্রনারায়ণের স্ত্রী নিস্তারিণীদেবী রাজমাতা দিঘির পাড়ে ওই মন্দিরের প্রতিষ্ঠা করেন। কোচবিহারের ভারতভুক্তির পরে রাজাদের আমলে তৈরি অন্য মন্দিরের সঙ্গে ওই মন্দিরটিও দেবোত্তর ট্রাস্ট বোর্ডের আওতায় আসে। সেগুলির নিরাপত্তা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে টালবাহানা চলছে বলে অভিযোগ। কোচবিহারের বাসিন্দা ইতিহাস গবেষক নৃপেন পাল বলেন, “রাজ আমলের ঐতিহ্য রক্ষায় প্রশাসন উদাসীন বলেই এ ভাবে পরপর ইতিহাস হারিয়ে যাচ্ছে।” কোচবিহার হেরিটেজ সোসাইটির সম্পাদক অরূপজ্যোতি মজুমদারের বক্তব্য, “প্রতিবার এ ধরনের ঘটনার পর মন্দিরগুলির নিরাপত্তা নিয়ে নানা আশ্বাস দেওয়া হয়। কিন্তু পরে তা বাস্তবায়িত হয় না।”
|
দেবালয়ে চুরি |
• ১৯৯৩ মদনমোহন মন্দির থেকে রাজাদের কুলদেবতার প্রাচীন বিগ্রহ। ২০০৩ তুফানগঞ্জের নাটাবাড়িতে বলরাম মন্দিরে বিগ্রহ।
• ২০১১ সিদ্ধেশ্বরী মন্দিরে পুলিশকে ভয় দেখিয়ে, তালা কেটে অষ্টধাতুর কালীমূর্তি।
• ২০১১ মাথাভাঙা মদনমোহন মন্দিরে প্রণামীর বাক্স ভেঙে চুরি। ২০১৪ সাল- রাজামাতা মন্দিরে ঢুকে বিগ্রহের অলঙ্কার সামগ্রী লুঠের অভিযোগ।
• এছাড়াও চিলাখানার অয়রাণি চিতলিয়া মন্দির, দিনহাটার গোসানিমারি মন্দির-সহ একাধিক মন্দিরে চুরি হয়। |
|