আলিনগরের রেজাউল করিম এখন দিনমজুরি করছেন। শোভানগরের দেবশ্রী কুমার পার্শ্বশিক্ষিকার কাজ নিয়েছেন।
সিভিক পুলিশ বনে গিয়েছেন কমলাবাড়ির ইফতিকার চৌধুরী।
গৌড়-আদিনায় ট্যুরিস্ট গাইডের কাজ করছেন শুভাশিস সেন।
এঁরা চার বছর আগে প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগের পরীক্ষা দিয়েছিলেন। ভেবেছিলেন, শিকে ছিঁড়বে। কিন্তু দুর্নীতির অভিযোগে গোটা নিয়োগ প্রক্রিয়াই বাতিল করে দেয় মালদহ জেলা প্রাথমিক বিদ্যালয় সংসদ। ফলে, ১৩৩১ শূন্যপদে নিয়োগের আশায় যে ১৬ হাজারেরও বেশি যুবক-যুবতী পরীক্ষা দিয়েছিলেন, তাঁরা যে ভাবে পেরেছেন খড়কুটো আঁকড়ে টিকে থাকার চেষ্টা চালিয়েছেন। হাইকোর্টের নির্দেশে ২ মার্চ নেওয়ার বিজ্ঞপ্তি জারি হতেই তাঁরা আশায় বুক বেঁধেছেন।
কালিয়াচকের আলিনগরের দিনমজুরের ছেলে রেজাউল করিমের কথায়, “২০১০ সালে খুব ভাল পরীক্ষা দিয়েছিলাম। পরীক্ষা বাতিল হওয়ার খবর শুনে ভেঙে পড়ি। ভেবেছিলাম, চাকরি পেলে বাবাকে আর কাজে পাঠাব না। সংসার চালাতে এখন বাবার বদলে আমিই দিনমজুরি করছি। গ্রামের এক বন্ধুর মুখে শুনলাম, আবার পরীক্ষা হবে। রাত জেগে পড়াশোনা করে যে ভাবে হোক চাকরি পেতে হবে।” হরিশ্চন্দ্রপুরের রানিপুরে দিনমজুরি করছেন সামসের আলিও।
অঙ্কে স্নাতোকত্তোর পাশ করে প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগের পরীক্ষা দিয়েছিলেন শোভানগরের দেবশ্রী কুমার। তাঁর দাবি, “এত ভাল পরীক্ষা দিয়েছিলাম, চাকরি পেতামই। পরীক্ষা বাতিল হওয়ার পরে এখন একটা স্কুলে পার্শ্বশিক্ষিকার কাজ নিতে বাধ্য হয়েছি।” এক মাস হল, মালদহ শহরে সিভিক পুলিশ হিসাবে কাজ যোগ দিয়েছেন কমলাবাড়ি গ্রামের ইফতিকার চৌধুরী। তাঁর আক্ষেপ, “২০১০ সালে পরীক্ষার ফল যদি বেরত, এখন হয়তো ছাত্র পড়াতাম। কপালের দুর্ভোগে রাস্তায় দাঁড়িয়ে ট্রাফিক সামলাচ্ছি।”
নেতাজি মোড়ের আজাহার রহমান কাজ করছেন কাপড়ের দোকানে। চার বছর পড়াশুনোর সঙ্গে যোগ নেই। “এই কয়েক দিন পড়ে কি চাকরি পাব?” সংশয় তাঁর। সানি পার্কের চিত্রলেখা মণ্ডল বলেন, “চাকরির জন্য অনেক দিন অপেক্ষা করছি। এ বারের সুযোগটা কাজে লাগাতেই হবে।” মালদহ ট্যুরিষ্ট লজের অস্থায়ী গাইড হিসেবে পর্যটকদের গৌড়-আদিনা দেখতে নিয়ে যান শুভাশিস সেন। পর্যটক এলে তবেই মজুরি মেলে। তিনি বলেন, “সমস্ত কাজ ছেড়ে এখন পড়াশুনো করব।”
প্রাথমিক শিক্ষা সংসদ সূত্রে জানা গিয়েছে, জেলায় ২৭টি ‘নিউ সেট-আপ’ প্রাথমিক বিদ্যালয়-সহ ১৯৩৬টি বিদ্যালয়ে ৬২২২ জন শিক্ষক রয়েছেন। ১৩৩১ জন শিক্ষক নিয়োগ হওয়ার পরেও প্রায় ১৯০০ পদ ফাঁকা থেকে যাবে। ২০১০ সালে বাম আমলে পরীক্ষা হলেও সেই সময়ে ফলপ্রকাশ করা যায়নি। ২০১১ সালে সরকার পরিবর্তনের পর জেলা প্রাথমিক শিক্ষা সংসদের চেয়ারম্যান বদল হয়। জেলা প্রাথমিক বিদ্যালয় সংসদের তৎকালীন চেয়ারম্যান রামপ্রবেশ মণ্ডল বলেন, “ফল বের করতে গিয়ে দেখি, খাতায় প্রচুর গরমিল রয়েছে। বিশেষ করে ১০ নম্বরের অনুচ্ছেদ লিখনে যে পরীক্ষার্থীর ৭ নম্বর পাওয়া উচিত ছিল তাকে ৩ নম্বর দেওয়া হয়েছে। যে পরীক্ষার্থী ৩ নম্বর পাওয়ার যোগ্য, তাকে ৭-৮ নম্বর দেওয়া হয়েছে। সেই কারণেই ওই পরীক্ষা বাতিল করে দেওয়ার জন্য বিদ্যালয় শিক্ষা দফতরে সুপারিশ করেছিলাম।”
কিছু পরীক্ষার্থী জেলা প্রাথমিক বিদ্যালয় সংসদের বিরুদ্ধে কলকাতা হাইকোর্টে মামলা দায়ের করেছিলেন। হাইকোর্ট ফের পরীক্ষা নেওয়ার নির্দেশ দেয়। আগামী ২ মার্চ দুপুর ১২টা থেকে ১টা পর্যন্ত জেলার ৪০টি স্কুলে ৩০ নম্বরের ওই পরীক্ষা হবে। গত চার বছরে বেশ কিছু পদপ্রার্থীর সরকারি চাকরি পাওয়ার বয়স পেরিয়ে গিয়েছে। কিন্তু এই পরীক্ষায় তা বাধা হচ্ছে না। জেলা প্রাথমিক বিদ্যালয় সংসদের সভাপতি স্বপন মিশ্র বলেন, “২০১০ সালের ২৫ জুলাই যে ১৬ হাজার ৩০০ পরীক্ষার্থী পরীক্ষা দিয়েছিলেন, তাঁরাই ফের বসার সুযোগ পাবেন।” অমৃতির কালীপদ গোস্বামী বলেন, “আগে বার যখন পরীক্ষা দিই, বয়স ছিল ৩৯। এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪৩-এ। প্রাইভেট টিউশনি করে সংসার চালাচ্ছি। আবার পরীক্ষা দিতে পারব ভেবে আমার খুব আনন্দ হচ্ছে।” |