প্রবন্ধ ২...
পোলিয়োর সঙ্গে যুদ্ধটা চালিয়ে যেতে হবে
মরা জেনে গিয়েছি, ২০১১ সালের ১৩ জানুয়ারি হাওড়া জেলার পাঁচলা ব্লকে রুখসা খাতুনের রোগ নির্ণয়ের পর আমাদের দেশে আর নতুন কোনও পোলিয়ো রোগী পাওয়া যায়নি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা হতেও আর বেশি বাকি নেই। তা হলে পোলিয়ো-মুক্ত ভারতে আবার পালস পোলিয়োর তোড়জোড় কেন? এই সংশয়ের কারণ, রোগমুক্তির সঙ্গে আমরা রোগ নির্মূলকরণকে গুলিয়ে ফেলছি। আমরা ভুলে যাচ্ছি, পাকিস্তান, আফগানিস্তানের মতো পোলিয়ো-সংকুল প্রতিবেশী নিয়ে আমরা মোটেও নিশ্চিন্ত থাকতে পারি না, ঘনিষ্ঠ যোগাযোগের এই ভুবনগ্রামে নিরাপদ নই পোলিয়ো দূরীকরণে ব্যর্থ নাইজেরিয়া থেকেও। ভুলে যাচ্ছি, পোলিয়োর প্রত্যাবর্তনের রেকর্ড অতুলনীয়। এই শতাব্দীতেই টানা পাঁচ বছর বা তারও বেশি দিন ধরে শূন্য স্কোর করার পর পোলিয়ো ফিরে এসেছে কেনিয়া, বাংলাদেশ, নামিবিয়া, ইয়েমেন-এ। দীর্ঘ ন’বছর ধরে ইন্দোনেশিয়ায় আর নতুন কেস পাওয়া যাচ্ছে না বলে যখন সবাই ধরে নিয়েছে এই দেশ নিয়ে আর চিন্তা নেই, তখনই ২০০৫ সালে সেখানে ৩০৩ জন নতুন করে আক্রান্ত হয়। সুতরাং, পোলিয়ো-মুক্ত দেশের তকমা পেয়েও আমাদের নিশ্চিন্ত হওয়ার জো নেই। এই সাফল্যকে ধরে রাখার জন্য আমাদের পালস পোলিয়ো অভিযান এবং নিয়মিত টিকাকরণ কর্মসূচি: দুটিকেই সমান গুরুত্বে আপাতত চালিয়ে নিয়ে যেতে হবে, প্রয়োজন অনুসারে সংস্কার ঘটাতে হবে তার পদ্ধতিপ্রকরণে।
তবে টানা তিন বছর পোলিয়ো-শূন্য থাকা অবশ্যই বিশাল কীর্তি। ১৯৮০-র দশকের শেষ দিকে যখন গোটা বিশ্ব জুড়ে পোলিয়ো নির্মূল করার নানা পরিকল্পনা চলছিল, তখন আমাদের দেশে এমন পরিস্থিতি যে আদৌ কোনও দিন আসতে পারে, তা কল্পনা করতেও যথেষ্ট সাহস লাগত। ভারতে তখন প্রতি বছর গড়ে প্রায় তিন লাখ শিশু পোলিয়ো-আক্রান্ত হত। এবং তা হত আগের এক দশক ধরে সার্বিক টিকাকরণ কর্মসূচিতে শিশুদের তিন ডোজ করে ওরাল পোলিয়ো টিকা (ওপিভি) খাওয়ানো সত্ত্বেও। সুতরাং, সংশয় ছিল শুধু বিশাল জনসংখ্যা, ভৌগোলিক দুর্গমতা, রাজনৈতিক অসচেনতা বা প্রশাসনিক শৈথিল্য নিয়ে নয়, সবচেয়ে বড় সংশয় থাকত পোলিয়ো দূরীকরণ অভিযানের মূল অস্ত্রটিকে নিয়েই। তত দিনে বিশেষজ্ঞরা জানিয়ে দিয়েছেন, এমনকী ৫-৭ ডোজ ওপিভি খেয়েও কিছু শিশু পোলিয়োয় আক্রান্ত হয়। জানা গেছে, ওপিভি-তে উপস্থিত প্রতিষেধক ভাইরাস নিজেই প্রতি দশ লাখের মধ্যে ৪ জনের পোলিয়ো রোগ ঘটায়। পোলিয়ো ভাইরাস সাধারণত খাদ্য ও পানীয় জল বাহিত খাদ্যনালীতে প্রাথমিক সংক্রমণ ঘটালেও, কখনও কখনও হাঁচি-কাশির মাধ্যমে শ্বাসনালিতেও আক্রমণ শানাতে পারে। দ্বিতীয় ক্ষেত্রে ওপিভি-র তুলনায় ইঞ্জেকশনে দেওয়া প্রতিষেধক (আইপিভি) বেশি কার্যকর। এই সব নেতিবাচক তথ্য মাথায় রেখেও বিশেষজ্ঞরা শেষ পর্যন্ত সহজে ও সুলভে প্রস্তুতযোগ্য ওপিভি-র ওপরেই ভরসা রেখেছিলেন।
তাঁদের সিদ্ধান্তই যে ঠিক ছিল, আজ প্রমাণিত। বাকি দেশগুলির পোলিয়ো-মুক্তির জন্যও পাঁচ বছরের কমবয়সি শিশুদের নির্দিষ্ট দিনে লাগাতার পালস পোলিয়ো হিসেবে ওপিভি খাইয়ে যাওয়ার ভারতীয় নীতিকেই শিরোধার্য করা হয়েছে। আমাদের বিশাল দেশে এই পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করা শুধু স্বাস্থ্যকর্মী দিয়ে অসম্ভব। তাই প্রশাসন, পঞ্চায়েত, পুরসভা, স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ইত্যাদি নানা সূত্র থেকে সংগৃহীত হয় কর্মিবাহিনী। ওপিভি’কে পোলিয়ো দূরীকরণের মূল অস্ত্র বলছিলাম। ভুল বলছিলাম। আসল অস্ত্র এই বিশাল কর্মিদল। এঁরা বছরের পর বছর রোদ-বৃষ্টি-শীত উপেক্ষা করে, পারিবারিক দায়-দায়িত্ব সামলে, ধর্ম-ভাষা-রাজনৈতিক আনুগত্যের তোয়াক্কা না করে প্রচার চালিয়েছেন, প্রতিষেধক বয়েছেন, সকাল থেকে বিকেল ‘বুথ’ খুলে রেখেছেন, পরের তিন-চার দিন বাড়ি বাড়ি ঘুরে সংবাদ সংগ্রহ করেছেন।
কত বার? ৯ ডিসেম্বর ১৯৯৫ তারিখে প্রথম পালস পোলিয়ো দিবসের পর থেকে কত বার এই বিপুল আয়োজন সম্পাদন করতে হয়েছে? পুরনো কাগজপত্র, ফাইল, কম্পিউটার আতিপাঁতি না খুঁজলে উত্তর দিতে পারবেন না কেউই। কারণ, কিছু পালস পোলিয়ো দিবস হয়েছে গোটা দেশ জুড়ে। কখনও ১৭ কোটি ৪০ লক্ষ পাঁচ বছরের কম-বয়সি শিশুকে মোট প্রায় ৪৮ কোটি বার ওপিভি খাওয়ানো হয়েছে।
অথচ পোলিয়ো-মুক্তির উদ্যাপনে এই কর্মীদের ভূমিকার কথা কোথাও স্বীকার করা হচ্ছে না, কখনও হয়ওনি। পোলিয়ো টিকা খেয়ে বাচ্চা প্রজনন ক্ষমতা হারাবে— এমন ভ্রান্ত প্রচারে বিভ্রান্ত হয়ে কিছু মানুষ তাঁদের সন্তানকে টিকা দিতে অস্বীকার করেছেন। নিজেদের এলাকার কোনও দাবিদাওয়া সংক্রান্ত অসন্তোষে কিছু মানুষ এই কর্মসূচি সাময়িক ‘বয়কট’ করেছেন। সংবাদমাধ্যম এই সব নেতিবাচক খবরকে বরাবর প্রয়োজনের অতিরিক্ত গুরুত্ব দিয়েছে। কিন্তু তৃণমূল স্তরে নামমাত্র পারিশ্রমিকে যাঁরা গোটা কাজ সুষ্ঠু ভাবে সম্পাদন করে চলেছেন, তাঁদের কোনও বাহবা জোটেনি— না সংবাদমাধ্যমে, না প্রশাসনিক স্তরে।
বাহবা জোটেনি এই সাফল্যের অন্য কারিগরদেরও, পাঁচ বছরের কম-বয়সি শিশুর অভিভাবকদের। ভেবে দেখুন, ১৯৯৫ সালে প্রথম পালস পোলিয়ো খাওয়া অনেক শিশু আজ দেশের দায়িত্বশীল নাগরিক, তাদের সন্তানকে এখন তারা পোলিয়ো খাওয়াতে নিতে আসছে। এত বিরুদ্ধ প্রচার আর সংশয় সত্ত্বেও এত দীর্ঘকাল ধরে এত বিশাল সংখ্যক দেশবাসী এই কর্মসূচির ওপর ভরসা রাখছেন। অথচ ‘আপনারাই আমাদের শীর্ষে নিয়ে গেছেন’ জাতীয় উপভোক্তাকে ধন্যবাদজ্ঞাপক প্রচারে আজ পর্যন্ত কোনও উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। উল্টে ‘কেউ যেন বাদ না যায়’ প্রচারের মহার্ঘ বিজ্ঞাপনে লক্ষ্য স্থির করা হচ্ছে শুধু গ্রহীতার অতি ক্ষুদ্র ভগ্নাংশকে, পোলিয়ো নিতে যাঁদের আপত্তি। আজ এই কীর্তি স্পর্শের লগ্নে দরকার সেই পাপক্ষালনের। দরকার কর্মী ও উপভোক্তারূপ সেই বিপুলসংখ্যক দেশবাসীকে কৃতজ্ঞতা জানানোর। এই সাফল্যকে ধরে রাখার জন্য ভরসা রাখতে হবে এঁদের ওপরই। পালস পোলিয়োর অভ্যস্ত কর্মসূচি আর ওপিভি-র সঙ্গে আইপিভি’কেও শামিল করা ছাড়া এ বার বাড়তি গুরুত্ব দিতে হবে নির্মূলকরণের পরবর্তী পদক্ষেপের ওপর। ১৫ বছরের কম-বয়সি যে কোনও বাচ্চার হঠাৎ অঙ্গশৈথিল্য বা অ্যাকিউট ফ্ল্যাসিড প্যারালিসিস (এএফপি) দেখা দিলেই খবর দিতে হবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার জেলা-স্থিত অফিসে। শৈথিল্য দেখা দেওয়ার ১৪ দিনের মাথায় রোগীর মলের নমুনা সংগ্রহ করে বিশেষ ব্যবস্থায় সংরক্ষণ করে তা পাঠাতে হবে দেশের মধ্যে নির্দিষ্ট কয়েকটি অত্যাধুনিক গবেষণাগারের একটিতে। হিসেব মতো, পোলিয়ো নির্মূল হয়ে যাওয়ার পরেও ১৫ বছরের কম-বয়সি প্রতি ১ লক্ষ জনের মধ্যে গড়ে ১ জন প্রতি বছর এই এএফপি-তে আক্রান্ত হবে। জনসংখ্যার অনুপাতে এএফপি ঠিকঠাক সংখ্যায় খুঁজে এনে, পরীক্ষা করিয়ে বছরের পর বছর যদি তাদের কারও শরীরেই পোলিয়ো ভাইরাস পাওয়া না যায়, তবেই আমাদের পোলিয়ো নির্মূলকরণ নিশ্চিত হবে। আর তার জন্য আমাদের ভরসা দেশ জুড়ে ছড়িয়ে থাকা সেই সব অগণিত সচেতন কর্মী, যাঁদের জন্য আজ আমরা পোলিয়ো-মুক্ত... আপাতত।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.