প্রবন্ধ ১...
সিরিয়ায় একটি নয়, দুটি যুদ্ধ চলছে
৫ লক্ষ নাগরিক দেশ ছেড়েছেন। প্রাণ গিয়েছে এক লক্ষ ৩০ হাজার নাগরিকের। জেনিভায় শান্তি আলোচনায় মুখোমুখি হয়েছেন সিরিয়ার বিবদমান দু’পক্ষ। পর পর দু’বার। বের হয়নি কোনও রফা-সূত্র। ফলে আরব বসন্তের সবচেয়ে রক্তক্ষয়ী এই সংঘর্ষ শেষের আশাও সুদূর। কেন? তা বুঝতে এক ঝলক সিরিয়ার ইতিহাসের দিকে তাকাতে হবে।
আজকের সিরিয়া ছিল ফ্রান্সের উপনিবেশ। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে ফ্রান্স এই অঞ্চলের অধিকার পেয়ে তাকে দু’ভাগে ভেঙে ফেলে। এক ভাগ লেবানন। অন্য ভাগ বর্তমান সিরিয়া। এই ভাগের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ছিল। সুন্নিপ্রধান লেবাননে ক্ষমতা দেওয়া হয় সংখ্যালঘু খ্রিস্টানদের। সিরিয়া থেকে যায় নানা জাতিগোষ্ঠীর জটিল মিশ্রণ নিয়ে। মধ্য-সিরিয়ায় সংখ্যাগুরু সুন্নিদের বাস। এখানে রয়েছে দামাস্কাস, হোমস, হামা-র মতো শহর। দক্ষিণে দ্রুজদের বাস। উত্তরে প্রধানত কুর্দ, আরবীয় খ্রিস্টান, আর্মেনিয়ান, ইহুদিদের বাস। এখানেই রয়েছে আলেপ্পো শহর। আর পশ্চিমে লেবানন ঘেঁষা এলাকায় আলাওয়াইটদের বাস। এখানকার প্রধান শহর লাতাকিয়া। সংখ্যালঘু আলাওয়াইট, দ্রুজ এবং ইসমালিয়া-রা শিয়া মুসলমান।
আলজিরিয়া আর টিউনিসিয়ায় উপনিবেশ স্থাপনের পরে ফ্রান্স সিরিয়ায় হাত দিয়েছিল। আলজিরিয়া আর টিউনিসিয়ার অভিজ্ঞতা ফ্রান্সকে সুন্নি আরব জাতীয়তাবাদের (বিশেষত মুসলিম ব্রাদারহুড) প্রতি বিরূপ করে তোলে। সিরিয়ায় এই আরব জাতীয়তাবাদকে আটকাতে তাই আলাওয়াইট ও দ্রুজ প্রধান অঞ্চলে স্বায়ত্তশাসনের অধিকার দেয় ফ্রান্স। ফলে দামাস্কাস-কেন্দ্রিক সুন্নি-প্রাধান্য থেকে তারা মুক্তি পায়। এই সংখ্যালঘুদের জন্য নানা উন্নয়নমূলক কাজ ও সুযোগসুবিধার ব্যবস্থা হয়। তাদের সামরিক বাহিনীতে নিয়োগ করা হয়।
অন্তহীন সর্বনাশ। আসাদের বাহিনীর আক্রমণের পরে। আলেপ্পো, ১৩ ফেব্রুয়ারি। ছবি: রয়টার্স
ধীরে ধীরে সামরিক বাহিনীতে এই গোষ্ঠীর প্রাধান্য তৈরি হয়। সুন্নিপ্রধান অঞ্চলগুলি এর কিছুই পায়নি। ফলে সংখ্যাগরিষ্ঠ সুন্নিদের সঙ্গে শিয়া সংখ্যালঘুদের টানাপড়েন সিরিয়ার সৃষ্টি থেকেই রয়েছে। বার বার দুইয়ের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয়েছে। প্রতি বার আলাওয়াইট-প্রধান সেনা তা দমন করেছে। এর মধ্যে তৈরি হয়েছে বাথ পার্টি, যাতেও আলাওয়াইট প্রাধান্য। এ পথেই ক্ষমতায় এসেছেন বায়ুসেনার অফিসার, আলাওয়াইট, হাফিজ আল আসাদ। কঠোর হাতে সুন্নিদের দমনে করেছেন তিনি। যেমন, ১৯৮২ সালে হামা শহরে সুন্নিদের বিদ্রোহ দমন করতে তিনি সেনা পাঠান। প্রায় ৩০,০০০ সুন্নিকে হত্যা করে সেনাবাহিনী পরিস্থিত নিয়ন্ত্রণে আনে। কিন্তু ২০১১ থেকে শুরু হওয়া বিদ্রোহ আজও নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেননি তাঁর পুত্র বাসার আল আসাদ। কারণ, এর সঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছে ইরান, সৌদি আরব, ইরাক, কাতার, লেবানন, তুরস্ক। সঙ্গে আমেরিকা, রাশিয়া ও ইউরোপের প্রধান শক্তিগুলি তো আছেই। তবে সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ প্রধানত ইরান ও সৌদি আরবের ছায়াযুদ্ধ হয়ে উঠেছে।
‘সিরিয়াকে আমাদের নিয়ন্ত্রণে রাখতেই হবে। এখান থেকে লেবানন পর্যন্ত যে শৃঙ্খল, সেটা যদি ছিন্ন হয়, আমাদের পক্ষে তা খুব খারাপ হবে।’ ইরানের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট আলি আকবর হাসেমি রাফসানজানি-র এই উক্তির মধ্যেই বাসার আল আসাদের সঙ্গে ইরানের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের বীজ লুকিয়ে আছে। আফগানিস্তানের পশ্চিমাংশ থেকে লেবানন পর্যন্ত যে শিয়া-শৃঙ্খলের কথা রাফসানজানি বলছেন, পশ্চিম এশিয়ায় ইজরায়েল-আমেরিকার অক্ষকে ঠেকাতে ইরানের তা দরকার। সঙ্গে রয়েছে সৌদি আরব ও কাতারের ভয়। সুন্নিপ্রধান এই দুই দেশের সঙ্গে ইরানের ঐতিহাসিক বিরোধ। এদের মিলিত চাপে ক্রমাগত কোণঠাসা ইরানের পক্ষে আসাদের সিরিয়া হাতছাড়া করা অসম্ভব। অন্য দিকে, আমেরিকার আফগানিস্তান ও ইরাক অভিযানে ইরানের সুবিধে হয়েছে। এই দু’দেশেই সুন্নি শাসকরা সরে গিয়েছে। ইরাকে প্রেসিডেন্ট মালিকির নেতৃত্বে শিয়াপ্রধান সরকার ক্ষমতায় রয়েছে, যাদের ইরান-ঘনিষ্ঠতা নিয়ে ওয়াশিংটনের যথেষ্ট আপত্তি। তাই এই গৃহযুদ্ধের প্রথম থেকেই ইরান বাসার আল আসাদের পক্ষে। সাহায্য এসেছে দু’ভাবে। এক, নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও আসাদ সরকারকে ইরান মাসে প্রায় ৫০ কোটি ডলার দেয়, যা দিয়ে আসাদ সরকার খাদ্য ও জ্বালানি করছে। দুই, ইরান নিজেদের নিয়ন্ত্রণে থাকা হেজবোল্লা-র যোদ্ধাদের সিরিয়ায় পাঠিয়েছে। আসাদের নিয়ন্ত্রণে থাকা মিলিশিয়া সাবিহা আর আসাদের হয়ে লড়তে আসা ইরাকের শিয়া মিলিশিয়া আবু আল-ফাদল আল-আব্বাস ব্রিগেডের পিছনেও ইরানের মদতের অভিযোগ উঠেছে। ইরানের ইসলামিক রেভলিউশনারি গার্ড কর-এর কমান্ডার কোয়াসিম সুলেইমানি প্রয়োজনে আসাদের পক্ষে সরাসরি সামরিক হস্তক্ষেপের সম্ভাবনার কথাও জানিয়েছেন।
অন্য দিকে, এই শিয়া-শৃঙ্খলটি দীর্ঘ দিন ধরেই সৌদি আরবের মাথাব্যথার কারণ। ইরাকে সাদ্দামের পতনের পরে এই অঞ্চলে ইরানের প্রভাব বৃদ্ধি এবং ইরানের পরমাণু-পরিকল্পনাকে সৌদি আরব বরাবর সন্দেহের চোখে দেখে। পরমাণু প্রকল্প নিয়ে ইরানের সঙ্গে পশ্চিম দুনিয়ার বোঝাপড়া সৌদি আরবকে আরও অসহিষ্ণু করেছে। সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ শিয়া-শৃঙ্খলটি ভাঙার সুযোগ এনে দিয়েছে। সিরিয়ার সুন্নিদের রক্ষার পাশাপাশি সৌদি আরব প্রধান তিনটি লক্ষ্য নিয়ে আসাদ-বিরোধীদের মদত দিচ্ছে। এক, শিয়া-শৃঙ্খল ভেঙে আসাদের জায়গায় সিরিয়ায় সুন্নিপ্রধান সরকার প্রতিষ্ঠা। দুই, ততটা না হলেও ছায়াযুদ্ধ চালিয়ে ইরানকে দুর্বল করা। তিন, মুসলিম ব্রাদারহুডকে নিয়ন্ত্রণে রাখা। প্রথম দু’টি লক্ষ্য পূরণে সৌদি আরব প্রধানত বিরোধীদের অস্ত্র সাহায্যের পথে হেঁটেছে। ২০১২-য় সৌদি আরবের তত্ত্বাবধানে ক্রোয়েশিয়া থেকে প্রচুর অস্ত্র সিরিয়ার বিদ্রোহীদের হাতে পৌঁছয়। দক্ষিণ সিরিয়ায় সাঁজোয়া গাড়ি বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র পাঠাতেও সৌদি আরব সাহায্য করেছে।
সৌদি আরবের তৃতীয় লক্ষ্যটি এই যুদ্ধে বিরোধীদেরও ভাগ করে দিয়েছে। ছোট ছোট বিদ্রোহী সংগঠন এক ছাতার তলায় এসে ‘ফ্রি সিরিয়ান আর্মি’ গড়ে। পশ্চিমী বিশ্ব তাদের বিদ্রোহের মুখ বলে মেনেও নিয়েছিল। এফএসএ-এর ধর্মনিরপেক্ষ ভাবমূর্তি তাদের পক্ষে সমর্থন জোটাতে সাহায্য করে। পশ্চিম বিশ্ব তাদের অর্থ ও অস্ত্র সাহায্যও শুরু করে। এফএসএ-তে প্রথম দিকে মুসলিম ব্রাদারহুডের মতাদর্শে বিশ্বাসী সংগঠনগুলির প্রাধান্য ছিল। সৌদি আরবে রাজপরিবারের শাসন নিয়ে মুসলিম ব্রাদারহুডের আপত্তি। ফলে ব্রাদারহুডের প্রতি সৌদি আরবের তীব্র বিদ্বেষ। মিশরে মুসলিম ব্রাদারহুডের প্রেসিডেন্ট মোরসিকে সরানোর পিছনে সৌদি মদতের অভিযোগও ছিল। সিরিয়ার বিদ্রোহীদের মধ্যে মুসলিম ব্রাদারহুডের প্রভাব কমাতে প্রথমেই সৌদি আরব সিরিয়ার সালাফি বিদ্রোহীদের নিয়ে নতুন সংগঠন তৈরি করে। পাশাপাশি এফএসএ-র উপরে প্রভাব বাড়াতে মুসলিম ব্রাদারহুডের প্রার্থীকে সরিয়ে নিজেদের প্রতিনিধি আহমেদ জারবা-কে এফএসএ-র প্রধান হতে সাহায্য করে। উল্টো দিকে, বিদ্রোহীদের আর এক মদতদাতা কাতার আবার মুসলিম ব্রাদারহুডের সংগঠনগুলিকেই সাহায্য করছে। ইসলামিক স্টেট অব ইরাক অ্যান্ড আল-সাম (আই এস আই এস), আল-নুসরার মতো সুন্নি জঙ্গি মৌলবাদী সংগঠনও সিরিয়ার লড়াইয়ে যোগ দেওয়ায় পরিস্থিতি আরও জটিল হয়। আল কায়দার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রেখে চলা ইরাকের এই জঙ্গি সংগঠনগুলির (যদিও সম্প্রতি এদের সঙ্গে আল-কায়দা সম্পর্ক ছিন্ন করেছে) মূল লক্ষ্য ইরাকে, আমেরিকা এবং ইরান প্রভাবিত শিয়াপ্রধান সরকারের বিরুদ্ধে লড়াই করা। সিরিয়ার লড়াই এদের কাছে ইরানকে দুর্বল করার সুযোগ। অনেক বিদেশি যোদ্ধা (ইউরোপের কয়েকটি দেশ থেকেও) এদের হয়ে লড়তে আসছেন। কিন্তু তাদের অন্য উদ্দেশ্যও আছে। তারা সিরিয়ায় কঠোর ইসলামি অনুশাসন চালু করার পক্ষে।
লড়াইয়ের ময়দানে প্রভাব বাড়ানোর জন্য আসাদের পাশাপাশি এফএসএ-র ছাতার তলায় থাকা সংগঠনগুলিকেও আক্রমণের নিশানা বানাচ্ছে এরা। একাধিক এফএসএ অফিসারকে হত্যার অভিযোগও এদের বিরুদ্ধে। এফএসএ-র কাছে থাকা অস্ত্রও এদের কাছে চলে যায়। সৌদি ও কাতারের দেওয়া অস্ত্রও এদের কাছে মিলছে। ফলে আমেরিকা-সহ পশ্চিম বিশ্ব সিরিয়ার বিদ্রোহীদের অস্ত্র সাহায্য বন্ধ করেছে। এদের একত্র করার চেষ্টা সে ভাবে সফল হয়নি। এদের হাত ধরে লড়াই ছড়িয়ে পড়েছে লেবাননেও। বেইরুটে ইরানি দূতাবাস আক্রান্ত হয়েছে। পশ্চিমী বিশ্বের কাছে এরা অনেক বেশি বিপজ্জনক।
সব মিলিয়ে সিরিয়ায় এখন প্রায় এক হাজার সংগঠনের এক লক্ষেরও বেশি যোদ্ধা আসাদের বিরুদ্ধে লড়ছেন। চলছে এক সঙ্গে দু’টি যুদ্ধ। একটি আসাদ সরকারের সঙ্গে সিরিয়ার বিরোধীদের, অন্যটি বিরোধীদের নিজেদের মধ্যে। তার উপরে রয়েছে ইরান ও সৌদি আরবের ছায়া। ফলে সমাধানসূত্র খুঁজে পাওয়া খুবই কঠিন। সাধারণ সিরিয়াবাসীর ভবিষ্যৎ বিশ বাঁও জলে।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.